পিবিএ ডেস্ক: চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বালিশের দাম হার মানিয়েছে রূপপুরের বালিশের দাম। রূপুরের একটি বালিশের দাম দেখানো হয়েছিলো ৬ হাজার টাকা আর চট্টগ্রামের একটি বালিশের দাম দেখানো হয়েছে ২৭ হাজার ৭২০ টাকা। রূপপুরে বালিশ উঠাতে খরচ দেখানো হয়েছিলো ৭৬০ টাকা। আর চট্টগ্রামে বালিশের কাভারের দাম দেখানো হয়েছে ২৮ হাজার টাকা। বিশ্ববিদ্যালয়টির সামগ্রিক অবকাঠামো নির্মাণ ও ১ হাজার শয্যার হাসপাতালের যন্ত্রপাতি কেনাসহ মোট সম্ভাব্য নির্মাণ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা।
প্রচলিত সরকারি বিধিবিধান অনুসারে ৫০ কোটি টাকার ওপর কোনো প্রতিষ্ঠানের স্থাপন প্রকল্প পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানোর আগে প্রস্তাবিত স্থানের সম্ভাব্যতা (ফিজিবিলিটি স্টাডি) যাচাই করা বাধ্যতামূলক।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন প্রকল্পটি অনুমোদনের জন্য স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় থেকে তড়িঘড়ি করে পরিকল্পনা কমিশনের আর্থসামাজিক অবকাঠামো বিভাগে পাঠানো হয়। তবে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন প্রকল্পের চিকিৎসা সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতি ক্রয়ের খরচের যে প্রস্তাবনাটি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে সেই প্রস্তাবে ‘সম্ভাব্য দুর্নীতি’ রূপকথার গল্পকেও হার মানিয়েছে।
চলতি বছরের মে মাসে দেশের অন্যতম মেগা প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বসবাসের জন্য নির্মিত গ্রিন সিটিতে আসবাবপত্র ও অন্যান্য জিনিসপত্র ক্রয়ে লাগামছাড়া দুর্নীতির তথ্য ফাঁস হয়। একটি বালিশের পেছনে ব্যয় দেখানো হয় ৬ হাজার ৭১৭ টাকা। এর মধ্যে এর দাম বাবদ ৫ হাজার ৯৫৭ টাকা আর সেই বালিশ নিচ থেকে ফ্ল্যাটে ওঠাতে খরচ ৭৬০ টাকা উল্লেখ করা হয়।
এবার সেই বালিশের চেয়ে পাঁচগুণ বেশি দামি বালিশ কেনার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সম্ভাব্য নির্মাণ প্রকল্প ব্যয় তালিকায়। এ প্রকল্পে একটি ২ হাজার টাকা দামের পিলোর (বালিশ) দর ২৭ হাজার ৭২০ টাকা আর কভারের দাম ধরা হয়েছে ২৮ হাজার টাকা। কিন্তু ওই কভারের আসল দাম ৫০০ থেকে ১৫০০ টাকা। একটি সার্জিক্যাল ক্যাপ ও মাস্কের বর্তমান বাজারমূল্য সর্বোচ্চ ২০০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা হলেও, প্রতিটির দাম ৮৪ হাজার কোটি টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে। একইভাবে সর্বোচ্চ ৫০ টাকা দামের টেস্টটিউব প্রতিটির দাম ৫৬ হাজার টাকা, ২০ থেকে ৫০ টাকা দামের একটি স্টেরাইল হ্যান্ড গ্লোভসের দাম ধরা হয়েছে ৩৫ হাজার টাকা। এছাড়া ডিসপোজেবল সার্জিক্যাল ক্যাপ ও মাস্ক প্রতিটির মূল্য ধরা হয়েছে ৮০ হাজার টাকা।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) তৈরি করে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়। গত ২ সেপ্টেম্বর পরিকল্পনা কমিশনে আর্থসামাজিক অবকাঠামো বিভাগের সদস্য আবুল কালাম আজাদের সভাপতিত্বে প্রকল্পের মূল্যায়ন কমিটির বৈঠকে যন্ত্রপাতি ও চিকিৎসা সরঞ্জাম ক্রয়ে সম্ভাব্য দুর্নীতির বিষয়টি ধরা পড়ে। বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের জন্য ১২টি চিকিৎসা সরঞ্জামের দাম অতিরঞ্জিত ও যথেচ্ছভাবে প্রাক্কলন করা হয়েছে। মূল্যায়ন কমিটির ওই বৈঠকে এই প্রকল্পের খরচের হিসাব নিয়ে অসন্তোষ ও চরমভাবে আপত্তি জানিয়ে ডিপিপি রিভাইসের জন্য স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে ফেরত পাঠানো হয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অগ্রাধিকারভিত্তিক এ প্রকল্পের নির্মাণ ব্যয়ে এ ধরনের পুকুরচুরি ও দুর্নীতির প্রস্তাব কীভাবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কিংবা উপাচার্যের মাধ্যমে এলো, সেটাই ভাবছে সারা দেশের মানুষ। চলছে নানা হিসাব নিকেশ।
চিকিৎসা সরঞ্জামাদির নাম, প্রতিটি পণ্যের প্রস্তাবিত মূল্য (একক হিসাবে) ও সম্ভাব্য বাজারমূল্য (সরবরাহকারীর লাভ, ভ্যাট ও ট্যাক্সসহ) নিচে দেয়া হলো-
১. স্টেরাইল হ্যান্ড গ্লোভসের দাম ধরা হয়েছে ৩৫ হাজার টাকা, যার বাজারমূল্য ২০ টাকা থেকে ৫০ টাকা
২. টেস্টটিউব-গ্লাস মেড, সাইজ ৫ এমএল ৫৬ হাজার টাকা, যার বাজারমূল্য ১৫ টাকা থেকে ৫ হাজার টাকা
৩. মাল্টিপ্লাগ উইথ এক্সটেনশন কর্ড, থ্রি-পিন ফ্লাগ বা রাউন্ড প্লাগ ৬ হাজার ৩০০ টাকা, যার বাজারমূল্য ২৫০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা
৪. রাবার ক্লথ ১০ হাজার টাকা, যার বাজার মূল্য ৫০০ টাকা থেকে ৭০০ টাকা
৫. রেক্সিন ৮৪ হাজার টাকা, যার বাজারমূল্য ৩০০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা
৬. কটন টাওয়েল ৫ হাজার ৮৮০ টাকা, যার বাজারমূল্য ২৫০ টাকা থেকে ১ হাজার টাকা
৭. হোয়াইট গাউন ৪৯ হাজার টাকা, যার বাজারমূল্য ১০০ টাকা থেকে ২০০ টাকা
৮. ডিসপোজেবল সার্জিক্যাল ক্যাপ ও মাস্ক ৮৪ হাজার টাকা, যার বাজার মূল্য ১ হাজার থেকে ২ হাজার টাকা
৯. ডিসপোজেবল সু কভার ১৭ হাজার ৫০০ টাকা, যার বাজারমূল্য ২০ টাকা থেকে ৫ হাজার টাকা
১০. বালিশ ২৭ হাজার ৭২০ টাকা, বাজারমূল্য ৭৫০ টাকা ২ হাজার টাকা
১১. বালিশের কভার ২৮ হাজার টাকা, বাজারমূল্য ৫০০ টাকা থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা।
সরেজমিন পর্যালোচনায় দেখা যায়, ৫৪ ইঞ্চি আকারের একটি সাদা গাউনের দাম ধরা হয়েছে ৪৯ হাজার টাকা, যার বর্তমান বাজারদর সর্বোচ্চ ২ হাজার টাকা। প্রকল্পে ২২ ইঞ্চি বাই ৩৬ ইঞ্চি আকারের কটন টাওয়েলের দাম ধরা হয়েছে ৫ হাজার ৮৮০ টাকা, যার বাজারমূল্য হলো মানভেদে ২৫০ থেকে সর্বোচ্চ এক হাজার টাকা। ৫৪ ইঞ্চি আকারের একটি রেক্সিনের দাম ধরা হয়েছে ৮৪ হাজার টাকা, যার বাজারদর ৩শ থেকে ৫শ টাকা। ৫৪ ইঞ্চি আকারের রাবার ক্লথ ধরা হয়েছে ১০ হাজার টাকা। বাজারে গিয়ে দাম জানা গেছে ৫শ থেকে ৭শ টাকা।
ডিপিপি থেকে জানা গেছে, দেশের স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে চট্টগ্রামে আন্তর্জাতিক মানের মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণ করতে যাচ্ছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এ জন্য ২২ তলাবিশিষ্ট এক হাজার বেডের দুটি হাসপাতাল ভবন নির্মাণ করা হবে। এছাড়া ২০ তলাবিশিষ্ট দুই বেজমেন্টের প্রশাসনিক ভবন করা হবে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চট্টগ্রাম বন্দর বাইপাস সড়কের পাশে ২৮ দশমিক ৪২ একর জায়গা জুড়ে হবে বিশ্ববিদ্যালয়টি। প্রাথমিকভাবে প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। অনুমোদন পেলে চলতি বছর থেকে ২০২২ সালের জুন মাসের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হওয়ার কথা।
পিবিএ/বাখ