বাসে ৫০ ভাগ যাত্রীর ৮০ ভাগ বেশী ভাড়া অযৌক্তিক


পিবিএ, ঢাকা : সীমিত আকারে ৫০ ভাগ যাত্রী নিয়ে গণপরিবহন চালুর সীদ্ধান্ত হয়েছে পূর্বেই। পরিবহন মালিকদের দাবির মুখে সেই ৫০ ভাড় যাত্রীকে ৮০ ভাগ বাড়তি ভাড়া গুণতে হবে।

গাজীপুর চৌরাস্তা থেকে গুলিস্তান যেতে বাসভাড়া ৬০ টাকা এখন একজন যাত্রীর পকেট থেকে বাড়তি ৮০ ভাগ আরো ৪৮ টাকা যাবে। অর্থাৎ তাকে মোট দিতে হবে ১০৮ টাকা।

যাত্রীদের ওপর এত বাড়তি ভাড়া চাপিয়ে দেওয়া কতটা যৌক্তিক, এই প্রশ্ন উঠেছে। কারণ, এক ঘণ্টার বৈঠকে চুলচেরা ব্যয় বিশ্লেষণ না করেই ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া বাড়তি ভাড়ার বিষয়টি আপৎকালীন সিদ্ধান্ত। তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর ভাড়া কমবে এই নিশ্চয়তা দিতে পারছে না কেউ। ফলে সার্বিক বিবেচনায় সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় পরিবহনমালিকদের দাবির মুখে অনেকটা তড়িঘড়ি করেই বাড়তি ভাড়ার বোঝা যাত্রীদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে।

সরকার সীমিত আকারে গণপরিবহন চালুর ঘোষণা দেওয়ার পর বাস-মিনিবাসে ৫০ শতাংশ আসন ফাঁকা রাখার সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)।

এ পরিস্থিতিতে পরিবহনমালিকেরা লোকসান এড়াতে ভাড়া বাড়ানোর দাবি জানান। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আজ সকালে বিআরটিএ কার্যালয়ে সংস্থাটির স্থায়ী ব্যয় বিশ্লেষণ কমিটির ঘণ্টাখানেকের বৈঠকে রাজধানী ঢাকাসহ দূরপাল্লার পথের বাসের ভাড়া ৮০ শতাংশ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়। ১ জুন থেকে তা কার্যকর হবে।

সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় ও বিআরটিএ পরিবহনমালিকদের চাপে শুরুতেই ভাড়া বাড়িয়ে দিয়ে সেই পর্যবেক্ষণের সুযোগটা হাতছাড়া করেছে বলে মনে করছেন খোদ মন্ত্রণালয়েরই কোনো কোনো কর্মকর্তা।

অপরদিকে, সরকারের সংস্থা রেল কর্তৃপক্ষ প্রায় ৩০০ ট্রেনের মধ্যে ১৯ জোড়া ট্রেন চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এসব ট্রেনের আবার ৫০ শতাংশ আসন ফাঁকা রাখা হবে। পাশাপাশি ট্রেন জীবাণুমুক্ত করাসহ স্বাস্থ্যবিধির প্রায় সবই মানার মূল দায়িত্ব রেল কর্তৃপক্ষের। কিন্তু তারা ভাড়া না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় ও বিআরটিএ সূত্র বলছে, করোনা পরিস্থিতির আগেই ভাড়া বাড়ানোর একটা প্রস্তাব তৈরির জন্য পরিবহনমালিকেরা চাপ দিয়ে আসছিলেন। বিআরটিএ ৪০ শতাংশ বাড়ানোর একটা খসড়াও তৈরি করেছিল। কিন্তু পরিবহন খাতে নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার কারণে সরকার তা প্রকাশ করেনি। এখন করোনা পরিস্থিতির সুযোগে ভাড়া দ্বিগুণ বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

যাত্রী অধিকার নিয়ে কাজ করেন, এমন ব্যক্তিদের মতে, পরিবহনমালিকেরা স্বাস্থ্যবিধি মানতে টাকা খরচ করছেন, ৫০ শতাংশ আসন সত্যি ফাঁকা রাখা হচ্ছে এটা নিশ্চিত হয়েই ভাড়া বাড়ানো যেত। এ ছাড়া বাসের ভাড়া বাড়ানোর আগে ব্যয় বিশ্লেষণ করার রীতি আছে। সেটা পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করলে ভাড়া কম বাড়িয়ে যাত্রীদের ওপর চাপ কমানো যেত। এখন যে ভাড়া বাড়ানো হয়েছে, সেটার চেয়ে বাড়তি ভাড়া আদায় করা হতে পারে। কারণ, অতীতেও তা-ই হয়েছে। এ ছাড়া পরিবহন খাতে বছরে দুই হাজার কোটি টাকার বেশি চাঁদা আদায় হয়। এগুলো বন্ধ না করা গেলে ভাড়া বাড়িয়ে লাভ হবে না। কারণ, লাভের গুড় চাঁদাবাজেরাই খেয়ে ফেলছে।

জানতে চাইলে বিআরটিএর পরিচালক (প্রশাসন) ইউসুফ আলী মোল্লা (চেয়ারম্যানের দায়িত্বে) বলেন, ৫০ শতাংশ যাত্রী কম পরিবহন এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষায় পরিবহনমালিকেরা ব্যয় করবেন এই বিবেচনায় ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। মালিকেরা তা মানছেন কি না, সেটা দেখে ভাড়া বাড়ানো যেত কি না, এমন প্রশ্নের তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। এ ছাড়া করোনা পরিস্থিতির পর ভাড়া কীভাবে আগের জায়গায় নিয়ে আসা হবে, সেটিও পরিষ্কার করেননি তিনি। শুধু বলেছেন, যে নিয়ম অনুযায়ী তো আগের জায়গায় এমনিতেই চলে আসার কথা।

৮০ শতাংশ বৃদ্ধি কতটা যৌক্তিক

বিআরটিএ সূত্র বলছে, বাস-মিনিবাসের ভাড়া নির্ধারণের ক্ষেত্রে বাস ক্রয়, ব্যাংকঋণ, জ্বালানি খরচসহ ২০ ধরনের ব্যয় বিশ্লেষণ করা হয়। কোনো একটা উপকরণের ব্যয় বাড়লেই ভাড়া বাড়ানোর প্রশ্ন আসে। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে কোনো কিছুর ব্যয় বাড়েনি। ফলে ভাড়া বাড়ানো হয়েছে শুধু যাত্রী কম বহনের আশ্বাসের ভিত্তিতে।

বর্তমানে ঢাকায় কিলোমিটারপ্রতি মিনিবাসে ১ টাকা ৬০ পয়সা এবং বড় বাসে ১ টাকা ৭০ পয়সা ভাড়া নির্ধারিত আছে। দূরপাল্লার পথে কিলোমিটারপ্রতি ভাড়া ১ টাকা ৪২ পয়সা। ঢাকায় সর্বনিম্ন ভাড়া আছে মিনিবাসে ৫ এবং বড় বাসে ৭ টাকা। আর দূরপাল্লার পথে ফেরি বা সেতুর টোল যুক্ত হয়।

ঢাকায় প্রতিটি বাস-মিনিবাসে ২০ শতাংশ এবং দূরপাল্লার পথে ১০ শতাংশ আসন ফাঁকা থাকবে—এটা ধরে নিয়েই এই ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে। ফলে ঢাকার বাসে এমনিতেই ২০ শতাংশ এবং দূরপাল্লার বাসে ১০ শতাংশ আসন ফাঁকা থাকার কথা।

আইন অনুসারে মিনিবাসের আসন ৩০টি। আর বড় বাসের ৫১টি। ঢাকার প্রতিটি বাস-মিনিবাসে ২০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত আসন বাড়িয়ে নিয়েছেন মালিকেরা। অর্থাৎ সরকার যে হিসাব করে ভাড়া নির্ধারণ করেছে, তাতে বিদ্যমান বাস-মিনিবাসের ৫০ শতাংশ ফাঁকা রাখলেও লোকসান হওয়ার কথা নয়। এ ছাড়া ঢাকাসহ বড় শহরগুলোতে পরিবহনমালিকেরা ‘সিটিং সার্ভিস’সহ নানা নামে আগে থেকেই শতভাগ বা এরও বেশি ভাড়া আদায় করে আসছেন। নতুন করে ৮০ শতাংশ বাড়তি ভাড়া সেই আগের বাড়তি ভাড়ার সঙ্গেই যুক্ত করে আদায় করবেন পরিবহনমালিক-শ্রমিকেরা।

অন্যদিকে দূরপাল্লার বাসের মধ্যে সরকার শুধু শীতাতপনিয়ন্ত্রণবিহীন (নন-এসি) বাসের ভাড়া নির্ধারণ করে। বিলাসবহুল ও এসি বাসের ভাড়া মালিকেরা নিজেরাই ঠিক করে থাকেন। অর্থাৎ বাজারে চাহিদা-জোগানের ওপর ভাড়া নির্ভরশীল। এসব বাসের ভাড়া আগে থেকেই এত বেশি যে কখনো কখনো ২০-৩০ শতাংশ আসন ফাঁকা থাকলেও তাঁদের লোকসান গুনতে হয় না। সবার জন্য ৮০ শতাংশ ভাড়া বাড়িয়ে দেওয়া অযৌক্তিক। এ ছাড়া দূরপাল্লার পথের নন-এসি বাসগুলোও সব সময় সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে বেশি আদায় করে থাকে। ফলে এখন ৮০ শতাংশ বাড়তি মানে হচ্ছে আগের বাড়তি ভাড়ার ওপর আরও ভাড়া বাড়ানো।

পিবিএ/এমএ

আরও পড়ুন...