জুয়েলারি শিল্পখাতের হালচাল- ৪

বাস্তবায়ন হয়নি স্বর্ণ নীতিমালা

মোঃ এমদাদ উল্যাহ, চৌদ্দগ্রাম (কুমিল্লা) : বাংলাদেশে স্বর্ণের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ৪০ টন। বৈধভাবে স্বর্ণের চাহিদা পূরণ করার ক্ষেত্রে বড় বাঁধা কাঁচামালের উচ্চ মূল্য, অতিরিক্ত উৎপাদন ব্যয়, শিল্প সংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতির উচ্চ আমদানি শুল্ক। বর্তমানে জুয়েলারি শিল্পের প্রায় সকল ধরণের পণ্য ও যন্ত্রপাতির আমদানি শুল্ক ৩০ থেকে ৬০ শতাংশ। যা স্থানীয় অন্যান্য শিল্পে আরোপিত শুল্কের চেয়ে অনেক বেশি। এতে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। পাশাপাশি ৫ শতাংশ হারে উচ্চ ভ্যাট হার ও অতিরিক্ত উৎপাদন খরচের কারণে ভোক্তা পর্যায়ে আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে দামের পার্থক্য হচ্ছে। এতে ক্রেতা হারাচ্ছেন জুয়েলারি ব্যবসায়ীরা। আর সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন ছোট ছোট জুয়েলারী ব্যবসায়ী। এই নেতিবাচক প্রভাব পড়ার ক্ষেত্রে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের নীতি নির্ধারকদের উপর অনেকখানি দায় বর্তায়। অবাস্তব নীতি প্রণয়ন, শুল্ক নির্ধারণে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের গোঁড়ামি, ভ্যাট ও আয়কর কর্মকর্তাদের কর্তৃক ব্যবসায়িদের হয়রানি এবং আমদানির ক্ষেত্রে কাস্টমস্ সদস্যদের ক্ষমতার অপব্যবহার এই শিল্পের সাথে সংযুক্ত ব্যবসায়ীদের ভোগান্তি ও আতংকের প্রধান কারণ। এতে সরকার প্রত্যাশিত রাজস্ব আয় থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে।

বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতির অভিমত, বাংলাদেশের স্বর্ণ শিল্পীদের হাতে তৈরী গহনা স্থানীয় ও বিশ্ব বাজারে সমানভাবে সমাদৃত হয়ে থাকে। তাই স্থানীয় স্বর্ণ শিল্পীদের টিকিয়ে রাখার জন্যে সরকারের এই পদক্ষেপ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। গত ৪ এপ্রিল বাজুস প্রাক-বাজেট সংবাদ সম্মেলনে ১২টি প্রস্তাব উত্থাপন করেছিল। যা ছিল জুয়েলার্স মালিকদের আশার প্রতিফলন। কিন্তু ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ১২টি প্রস্তাবের ১টি বাদে অন্য কোন প্রস্তাবই সংযুক্ত হয়নি। যা শুধু আশাহতই করেনি, পাশাপাশি জুয়েলারী শিল্পকে হুইকর মুখে ফেলেছে। স্বর্ণের অলংকার বিক্রয়ের ক্ষেত্রে আরোপিত ৫ শতাংশ ভ্যাট, ক্রেতা সাধারণের উপর বোঝা হিসাবে পরিলক্ষিত হয়। যার জন্যে অনেক ক্রেতা ভ্যাট প্রদানে অনীহা প্রদান করে থাকে। এর প্রভাব পড়ে সরকারের রাজস্ব আয়ে। বাজেটের ঘাটতি মেটাতে সরকারের প্রয়োজন রাজস্ব আয়ের নতুন উৎস। জুয়েলারি শিল্প বাজেটের ঘাটতি মেটাতে অনেকাংশেই সাহায্য করতে পারে, যদি এই খাতের উপর আরোপিত ভ্যাটের হার কমানো হয়। তাই বাংলাদেশ জুয়েলার্স এসোসিয়েশন-বাজুস আবারো প্রস্তাব করছে স্বর্ণের অলংকার বিক্রয়ের ক্ষেত্রে আরোপিত ৫ শতাংশ ভ্যাট হার কমিয়ে ৩ শতাংশ করা হোক। তাতে একদিকে ক্রেতা সাধারণ ভ্যাট প্রদানে উৎসাহিত হবে, অন্যদিকে সরকারের রাজস্ব আয়ের ঘাটতি কিছুটা হলেও পূরণ হবে।

অপরিশোধিত স্বর্ণ আমদানি এবং স্বর্ণ পরিশোধনাগার স্থাপনের সুযোগ রেখে ‘স্বর্ণ নীতিমালা-২০১৮ (সংশোধিত-২০২১)’ নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি। নীতিমালা অনুযায়ী ব্যবসায়ীরা স্বর্ণবার এবং স্বর্ণালঙ্কার আমদানির পাশাপাশি অপরিশোধিত স্বর্ণ আমদানি করতে পারবেন। ২০২১ সালের ২৮ জানুয়ারি বুধবার বিকালে অনলাইনে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাবের নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। দীর্ঘ সময়েও এ নীতিমালার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হয়নি। এর অন্যতম প্রতিবন্ধকতা ছিল স্বর্ণ আমদানিতে শুল্কহারে অসামঞ্জস্য। বাংলাদেশের জুয়েলারি শিল্প বিকাশের বড় অন্তরায় হিসাবে কাজ করে থাকে প্রাথমিক কাঁচামালের আমদানীর উপর উচ্চ শুল্ক হার। প্রাথমিক কাঁচামালের উপর আরোপিত শুল্ক কমানো না হলে এই শিল্পের বিকাশ স্থবির হয়ে থাকবে এবং চোরাচালান বাড়বে।
স্বর্ণ নীতিমালার ফলে দেশীয় স্বর্ণ ব্যবসার সঙ্গে চোরাই স্বর্ণের সংযোগ নিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়বে। কারণ এতে অনুমোদিত ডিলারের মাধ্যমে স্বর্ণ আমদানি ও স্বর্ণকারদের কাছে তা বিক্রয়ের তথ্যাদি সরকারের নজরদারিতে থাকবে। কোথাও কোনো অভিযোগ উত্থাপিত হলে এখতিয়ার সম্পন্ন সংস্থা তা যাচাই-বাছাই করে দেখতে পারবে। সরকারের যথাযথ রাজস্ব আহরণের পথ উন্মুক্ত হবে। অন্যদিকে সরকার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হিসাবে মোট স্বর্ণের স্থিতি ও চাহিদা সম্পর্কে তথ্যভিত্তিক পরিসংখ্যান তৈরি করা এবং এ খাতে প্রয়োজনীয় নীতি সহায়তা দিতে পারবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এ শিল্পকে এগিয়ে নিতে পারলে দেশীয় চাহিদা পূরণ করে বিদেশে রফতানি করার অপার সম্ভাবনা তৈরি হবে। এজন্য বন্ড সুবিধা প্রদান, শুল্ক রেয়াত এবং প্রত্যর্পণ ও প্রণোদনার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে নীতিমালায়।

দুই বছর আগে যে গতিতে নীতিমালাটি প্রণয়ন করা হয়েছিল, সে গতিটি ধরে রাখা যায়নি। এখনো এর পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন সম্পন্ন না হওয়ায় অনেকের মাঝে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। জুয়েলারি ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তারা এটির দ্রুত বাস্তবায়ন চান। তাদের স্বার্থেই এর দ্রুত বাস্তবায়ন জরুরি হয়ে পড়েছে। কারণ এর ফলে তাদের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্যবাহী ব্যবসা একটা নৈতিক ও আইনি ভিত্তির ওপর দাঁড়াবে। তারা মাথা উঁচু করে ব্যবসা করতে পারবেন। প্রায় ২০ লাখ লোকের কর্মসংস্থানের এ শিল্প আরো বিকশিত হবে। নীতিমালার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, এতে ভোক্তার স্বার্থ সংরক্ষণের ওপর জোর দেয়া হয়েছে। একজন ক্রেতা তার কষ্টার্জিত অর্থ দিয়ে যে গহনা কিনছেন, তার বিশুদ্ধতা সম্পর্কে তিনি নিশ্চয়তা পাবেন। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী প্রতিটি স্বর্ণালংকারে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্দিষ্ট হলোগ্রামযুক্ত ও যথাযথ চালান প্রদান করে লেনদেন করার কথা বলা হয়েছে। প্রণীত নীতিমালাটি নিঃসন্দেহে দেশের স্বর্ণ ব্যবসায় অধিকতর বৈধতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করবে। এজন্য স্বর্ণ নীতিমালার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের দাবি করেছে স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা।

বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতি কুমিল্লা জেলা সভাপতি শাহ মোহাম্মদ আলমগীর খান বলেন, ‘স্বর্ণ নীতিমালার বাস্তবায়ন না হওয়ায় স্বর্ণ চোরাচালান ও হুন্ডি ব্যবসা বন্ধ হচ্ছে না। এতে সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে। অবিলম্বে স্বর্ণ নীতিমালার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের দাবি জানাই’।

আরও পড়ুন...