বিকেএসপির কোচ__নাজমুল আবেদীন মুশফিককে নিয়ে যা লিখেছেন

পিবিএ ডেস্কঃ ইংল্যান্ড বিশ্বকাপের বাংলাদেশ দলে আছে আমার পাচঁজন সরাসরি ছাত্র, যাদেরকে বিকেএসপিতে পেয়েছি আমি।

একজন শিক্ষকের কাছে নিজের ছাত্রদের কাউকে আলাদা করে দেখা সম্ভব নয়। তবু এদের মধ্যে আমাকে যদি আলাদা করে বাছতেই হয়, তাহলে মুশফিকুর রহিমকেই বাছব আমি। কেন, সেটা বলতে গেলে পেছনে যেতে হবে।

বিকেএসপিতে আমি প্রায় সতেরো বছর কাজ করেছি। এই সতেরো বছরের মধ্যে একটা লম্বা সময় ক্রিকেট যাদের ভর্তি করা হবে, সেই বাছাই-প্রক্রিয়া আমি একাই সামলেছি।সেই সময়ের পুরোটা তো বটেই, আমার ক্যারিয়ারজুড়ে পাওয়া একমাত্র ছাত্র মুশফিকুর রহিম,যাকে দেখেই আমার মনে হয়েছিল- এই ছেলেটা একদিন জাতীয় দলে খেলবে,উইকেটকিপার হবে,ব্যাটসম্যান হবে।

আমি যখনকার কথা বলছি , তখন মুশফিকের বয়স মাত্র ১৩-১৪, বিকেএসপিতে সেটাওর প্রথম বছর। এর বাইরেও হয়তো আরও অনেকেই ছিল,আমার অনেক ছাত্রই ভালো ক্রিকেটার হয়েছে, কিন্ত মুশফিক বাদে আর কাউকে দেখেই আমার মনে হয়নি জাতীয় দলে সে খেলবেই খেলবে।

শুরুতে ও কিন্তু খুব ভালো ব্যাটসম্যান ছিল। ও জাতীয় দলে খেলবে ভেবেই ওকে মিডল অর্ডারে নিয়ে আসা হয়ছিল বিকেএসপিতে। আসলে সেই বয়সেই মুশফিকের প্রতিভা ওকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করেছিল। অবশ্য শুধু প্রতিভার কথা বললে ভুল হবে। ছোটবেলা থেকেই ওর যে শৃঙ্খলা, নিবেদন ও প্যাশন- সেটা ওকে খুব সহজেই আর দশটা ছেলের থেকে আলাদা কওে দিত। ব্যাটিংয়ে টেকনিক্যালি অনেক বেশি ভালো ছিল। আর ১৫-১৬ বছওে ওকে যেভাবে উইকেট কিপিং করতে দেখেছি , সেটা ওর ক্যারিয়ারের পরবর্তী সময়ের চেয়ে অনেক বেশি ভালো। সেই বয়সেই ও প্রায় নির্ভুল ছিল। বয়স ভিত্তিক দলের হয়ে ও যেখানে যখন খেলতে যেত , সঙ্গে ওর বই থাকত, এটা তো সবাই জানে। এটাই কিন্তু বলে দেয়, ও কতটা ডিসিপ্লিনড আর সেটাই ওকে অন্যদের চেয়ে আলাদা কওে দিয়েছে সব সময়। ও অত্যন্ত জেদি, হারতে চায় না এবং শেষ বিন্দু পযর্ন্ত লড়াই করতে চায়।

চার- পাঁচ বছর আগের একটা ঘটনা বলি- ওর সময়টা আসলে ভালো যাচ্ছিল না। হতাশা নিয়ে আমাকে একদিন বলছিল , স্যার ব্যাটটা নিয়ে বাউন্ডারি লাইনের ওপারে আমার যেতে ইচ্ছে করে না। সে সময়ে আমরা অনেক কথা বলেছি,বেশ কিছু কাজ করেছি।মুশফিকের বিশেষত্বটা এখানে খুজে পাবেন- ওই সময়টা পার করে এসে ক্যারিয়ারের সেরা সময়টাপার করছে এখন । নিজেকে ও এই সময়ে আন্তজাতিক মানের ক্রিকেটার হিসেবে তৈরি করেছে।

বিশ্বকাপে নিজের প্রথম ম্যাচ স্কয়ার কাট করে চার মেওে ভারতের মতো দলের বিপক্ষে জিতিয়েছিল মুশফিক- ছবিটা আমার মনে আজীবন গেথেঁ থাকবে। এমন বড় একটা মঞ্চে এত বড় একটা দলের বিপক্ষে এভাবে জেতা সেই সময়ে আমাদের জন্য তো অবিশ্বাস্য । ওই ম্যাচে তামিমের ডাইন দ্যা উইকেট এসে জহির খানকে ছক্কা মারা বা মুশফিকের ওই চার-ওগুলো কিন্তু শুধু রান নয়, ওগুলো একটা বার্তা ছিল পুরো পৃথিবীর জন্য- বাংলাদেশ এখন সেই পুরোনো ক্রিকেট খেলে না। ওটা আমাদের জন্য একটা টার্নিং পয়েন্ট। মুশফিকরা ওই দিন প্রমান করেছিল, আমাদের ক্রিকেটের একটা নতুন ব্র্যান্ড হবে। আর দশটা দেশের মতো আমাদেরও সব দেশ সমীহ করবে-এমন একটা স্বপ্ন আমরা ওখান থেকেই দেখতে শুরু করেছিলাম।

অনেক জায়গার শুনি , এটা মুশফিকের শেষ বিশ্বকাপ হতে পারে। পরের চার চার বছরেও কী হবে,সেটা তো কেউ বলতে পারে না। তবে আমি চাইনা,্এটাই ওর শেষ বিশ্বকাপ হোক। আমার প্রত্যাশা সত্যি হোক আর না হোক, আমি ওর কাছে রানবা সেঞ্চুরির প্রত্যাশা করি না। আমি চাই, ও বাংলাদেশযেখানেই খেলুক, সেখানেও ভয়ডরহীন ব্যাটিং করুক। সব প্রতিপক্ষ দলই যেন চিন্তা করে, ওই পজিশনে এমন একজন ব্যাটসম্যান খেলে, যাকে আউট না করা গেলে আমাদের বিপদ কাটবে না। সেটা করতে গিয়ে ও ৩০ রানও করতে পাওে,আবার ১৩০ রানও করতে পারে। প্রতিপক্ষের কাছে ও এভাবে নিজেকে আলাদা করে নিক।
আমি সংখ্যা দিয়ে ওকে বিচার করতে চাই না। শচীন টেন্ডুলকারের মতো সংখ্যাতাত্ত্বিকভাবে হয়তো অনেক কিছু ও অর্জন করতে পারবে না। কিন্তু বাংলাদেশের জন্য মুশফিক,সাকিব, তামিমরা তো শচীন টেন্ডুলকার, স্টিভ ওয়াহ বা ব্রায়ান লারা। লারা – টেন্ডুলকার নিজেদের দেশের জন্য ওরা আরও বেশি করেছে।আমাদের তো কিছুই ছিল না, ওরা সেই অন্ধকারের মধ্যে আলো জ্বালিয়েছে। মুশফিক যখন অবসর নেবে, আমি চাই, পুরো বিশ্ব বলুক, ওক সবাই মিস করবে। আমি চাই সবাই বলুক, হাতে আরোকবর্তিকা নিয়ে ক্রিকেটের নতুন স্বপ্ন দেখানোদের মধ্যে একজন ছিল মুশফিকও।”

পিবিএ/এমএস

আরও পড়ুন...