পিবিএ,ঢাকা: কেব্লের মধ্যে দিয়ে চলাচলে আর বাধা পেতে হবে না বিদ্যুৎকে। ফলে, বিদ্যুতের অপচয় হবে না বিন্দুমাত্র। যতটা বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে, তার পুরোটাই পৌঁছে দেওয়া যাবে বহু দূর-দূরান্তরের প্রত্যন্ত এলাকার গ্রাহকদের কাছে। অপচয় হবে না বলে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচও অনেকটা কমে যাবে। এমনকি, মরুভূমিতে সূর্যালোক বেশি বলে সেখানে বানানো সস্তার সৌর বিদ্যুৎও এ বার বহু বহু দূরের এলাকায় পৌঁছে দেওয়া যাবে। কোনও অপচয় ছাড়াই। যা জলবিদ্যুৎ ও তাপবিদ্যুতের উৎপাদন কমাতে সহায়ক হবে। তার ফলে, যেমন চাপ কমবে নদীর উপর, তেমনই তা কমাবে উষ্ণায়নের আশঙ্কাও।
সেই সম্ভাবনাই জোরালো হয়ে উঠল এক নজরকাড়া আবিষ্কারে। প্রায় এক শতাব্দীর তন্নতন্ন তল্লাশের পর খোঁজ মিলল একটি অতিপরিবাহী পদার্থের। যা ঘরের তাপমাত্রাতেই হয়ে উঠবে অতিপরিবাহী।
যা দিয়ে বিদ্যুৎ পরিবহণের জন্য কেব্ল বানালে বিদ্যুতের কোনও অপচয় হবে না। কারণ, ওই অতিপরিবাহী পদার্থ দিয়ে বানানো কেব্ল তার ভিতর দিয়ে বিদ্যুৎ চলাচলে কোনও বাধা দেবে না।
ওই আবিষ্কারের গবেষণাপত্রটি বেরতে চলেছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘ফিজিক্যাল রিভিউ লেটার্স’-এ। গবেষকদলের নেতৃত্বে রয়েছেন জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূপদার্থবিজ্ঞানী রাসেল হেমলে।
এক শতাব্দীর গবেষণাতেও মেলেনি এমন ‘দুর্লভ’-এর হদিশ!
ভূপদার্থবিজ্ঞানী হেমলে জানিয়েছেন, ল্যান্থানাম মৌলের সঙ্গে হাইড্রোজেন মৌলের হাতে হাতে জোড় বেঁধেই তাঁরা ওই অতিপরিবাহী পদার্থটি বানিয়েছেন। যার নাম- ‘ল্যান্থানাম হাইড্রাইড’। যা ঘরের স্বাভাবিক তাপমাত্রাতেও অতিপরিবাহী হয়ে ওঠে। গত ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে চেষ্টার পরেও এমন পদার্থ বানানো সম্ভব হয়নি।
অতিপরিবাহীর কাজ: ভিড়ের মধ্যে দিয়ে দৌড়নো যায় না। ধাক্কাধাক্কি হয়। পদে পদে বাধা পেতে হয়। খোলা মাঠে সেই অসুবিধা নেই। মাঠে দু’-এক জন থাকলেও, তারা এতটাই দূরে দূরে থাকেন যে, ছুটতে কোনও বাধাই পেতে হয় না।
কেব্লের মধ্যে দিয়ে বিদ্যুতের চলাচলেও একই ঘটনা ঘটে। বিদ্যুৎকে বাধা পেতে হয় পদে পদে। যাকে বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলে ‘রেজিস্ট্যান্স’। ওই বাধার ফলে বিদ্যুতের প্রচুর অপচয় হয়। সরবরাহের সময় কেব্লের মধ্যে দিয়ে যেতে গিয়ে বিদ্যুৎকে বার বার থমকে যেতে হয়। পদে পদে হোঁচট খেতে হয়। ওই ভাবেই তারের মধ্যে দিয়ে যাওয়া বিদ্যুতের অনেকটা অংশকে হারিয়ে যেতে হয়। ফলে, যতটা বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে, তার অনেকটাই পৌঁছে দেওয়া যাওয়া না বহু দূর-দূরান্তরের প্রত্যন্ত এলাকার গ্রাহকদের কাছে। অপচয় হয় বলে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচও বেড়ে যায়।
গবেষকদের কৃতিত্ব, এই প্রথম তাঁরা এমন একটি পদার্থ বানাতে পেরেছেন, যা ঘরের স্বাভাবিক তাপমাত্রাতেও অতিপরিবাহী হয়ে ওঠে। বিদ্যুৎ চলাচলে বিন্দুমাত্র বাধা দেয় না। এই আবিষ্কারের নজর কাড়ার কারণ, শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার উপরে এই প্রথম কোনও পদার্থকে অতিপরিবাহী হয়ে উঠতে দেখা গেল।
ওই অতিপরিবাহী পদার্থ ল্যান্থানাম হাইড্রাইড বানানো হয়েছে ল্যান্থানাম মৌলের সঙ্গে হাইড্রোজেনের জোড় বাঁধিয়ে। যেখানে একটি ল্যান্থানাম পরমাণুর ১০টি হাতের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করেছে ১০টি হাইড্রোজেন পরমাণুর একটি করে হাত।
কাজটা খুব সহজে করা যায়নি। ঘরের স্বাভাবিক তাপমাত্রায় ল্যান্থানাম পরমাণুর সঙ্গে হাইড্রোজেন পরমাণুগুলিকে জোড় বাঁধানোর জন্য বাইরে থেকে প্রচুর চাপ প্রয়োগ করতে হয়েছে। যে চাপের পরিমাণ ২০০ গিগা-পাসকাল বা বায়ুমণ্ডলের স্বাভাবিক চাপের ২০ লক্ষ গুণ! ওই প্রচণ্ড চাপে ল্যান্থানাম হাইড্রাইডের অণুকে এত জোরে ঠেসে ধরা হয়েছে যে, সেই যৌগে ল্যান্থানাম ও হাইড্রোজেনের হাতগুলি আকারে ছোট হয়ে গিয়েছে। তার ফলেই যৌগটি হয়ে উঠেছে অতিপরিবাহী। তাতে দেখা গিয়েছে ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসে (যাকে আমরা ঘরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা বলি) ওই পদার্থটি হয়ে ওঠে আক্ষরিক অর্থেই, অতিপরিবাহী।
হেমলে ও তাঁর সহযোগী গবেষকরা অবশ্য জানিয়েছেন, গবেষণাটি এখনও রয়েছে প্রাথমিক পর্যায়ে।
ভারতের মুম্বইয়ের টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ (টিআইএফআর)-এর কনডেন্সড ম্যাটার ফিজিক্স বিভাগের অধ্যাপক, ভাটনগর পুরস্কার জয়ী বিজ্ঞানী প্রতাপ রায়চৌধুরী বলছেন, ‘‘অতিপরিবাহী পদার্থের গবেষণায় এই আবিষ্কারকে একটি মাইল স্টোন বলা যায়। ঘরের স্বাভাবিক তাপমাত্রায় অতিপরিবাহী পদার্থের খোঁজ পাওয়ার জন্য ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে চেষ্টা চালানো হয়েছে। কিন্তু তেমন একটা সাফল্য আসেনি। এ বারের আবিষ্কারকে সেই অর্থে, ব্রেক থ্রু বলব একটাই কারণে, তা হল, এই প্রথম ঘরের স্বাভাবিক তাপমাত্রায় কোনও পদার্থের মধ্যে অতিপরিবাহিতার সন্ধান মিলল। এর ফলে, এক দিন বিদ্যুৎ উৎপাদন, সরবরাহ ও তার ব্যবহারের ক্ষেত্রে একটি নতুন দিগন্ত খুলে যাবে। এই আবিষ্কার আগামী দিনে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার একটি ক্ষেত্রও।’’
এই গবেষণা নিয়ে আশার কথা শুনিয়েছেন বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স (আইআইএসসি)-এর পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক, ভাটনগর পুরস্কার জয়ী বিজ্ঞানী অম্বরীশ ঘোষও। তাঁর কথায়, ‘‘এই আবিষ্কার বহু দিনের প্রচেষ্টার ফসল। তবে এই গবেষণাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। এমন পদার্থ আবিষ্কার করা জরুরি, যাতে বাইরে থেকে অত বেশি চাপ দিয়ে তাকে অতিপরিবাহী করে তুলতে না হয়। তা হলে তা বহুল ব্যবহারের ক্ষেত্রে বাধার দেওয়াল তুলে দাঁড়াতে পারে। তবে এক বার যখন পথটা দেখা গিয়েছে, সেই অসুবিধা দূর হতে বেশি সময় লাগবে না বলেই আমার মনে হয়।’’
২০১৫ সালে জার্মানির মেইনঝে, ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট ফর কেমিস্ট্রির পদার্থবিজ্ঞানী মিখাইল ইরেমেটস ও তাঁর সহযোগী গবেষকরা এই অতিপরিবাহিতার সন্ধান পেয়েছিলেন কঠি অবস্থায় থাকা হাইড্রোজেন সালফাইড থেকে। তবে তা ঘরের তাপমাত্রায় পাওয়া সম্ভব হয়নি। কঠিন হাইড্রোজেন সালফাইডে অতিপরিবাহিতা দেখা গিয়েছিল অনেক বেশি ঠান্ডায়। শূন্যের নীচে, ৮৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়। তারও আগে এই অতিপরিবাহিতা দেখা গিয়েছিল ল্যান্থানাম, বেরিয়াম, ও কপারের অক্সাইডে। তবে তার তাপমাত্রা ছিল শূন্য ডিগ্রির অনেক নীচে। পরে একই ধর্ম দেখা গিয়েছিল ইট্রিয়াম, বেরিয়াম ও কপারের অক্সাইড ও পারদের একটি জটিল অক্সাইড যৌগেও। তবে সেগুলির ক্ষেত্রে অতিপরিবাহিতা লক্ষ্য করা গিয়েছিল শূন্য ডিগ্রি তাপমাত্রার অনেক নীচে।
বাইরে থেকে প্রচুর পরিমাণে চাপ না দিয়ে ওই ল্যান্থানাম হাইড্রাইড বা ওই ধরনের অন্য কোনও পদার্থের মধ্যে কোনও মৌলের পরমাণুকে ঢুকিয়ে দিয়েও ভিতর থেকে সেই চাপ দেওয়া যেতে পারে। তা সেই অতিপরিবাহী পদার্থের ব্যবহারকে আরও জনপ্রিয় করে তুলতে পারে।
পিবিএ/ইএইচকে