পিবিএ ডেস্ক: দেশী এবং প্রবাসী ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বিনিয়োগের নামে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ পাওয়া গেছে ‘এক্সেলসিয়র সিলেট লিমিটেড’ নামের কোম্পানির সাবেক এমডিসহ কয়েক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে । দেশি-বিদেশী একাধিক বিনিয়োগকারী এমন অভিযোগ করেছেন ।
এছাড়াও কোম্পানির বিরুদ্ধে জমি দেখিয়ে একাধিক ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার চেষ্টার অভিযোগও পাওয়া গেছে। অভিযোগের তীর মূলত প্রতিষ্ঠানটির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক জামায়াত নেতা সাঈদ চৌধুরী ও প্রতিষ্ঠানটির সাবেক চেয়ারম্যান এবং জেলা বিএনপি সহ-সভাপতি শাহ জামালের বিরুদ্ধে। তাদের বিরুদ্ধে মানব পাচার, ভুয়া পাসপোর্টের ব্যবসা, প্রবাসী টাকা আত্মসাতসহ একাধিক গুরুতর অভিযোগ পাওয়া গেছে।
সাঈদ চৌধুরীর বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ এনে লন্ডন প্রবাসী বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও এক্সেলসিয়র সিলেট লিমিটেডের পরিচালক মো. মাসুক রহমান বলেন, সাঈদ চৌধুরী যখন এমডি ছিলেন তখন প্রতিষ্ঠানের অনেকের কাছে বিভিন্ন সময় টাকা নেন। টাকা নেয়ার পর সবার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। পাশাপাশি সাঈদ চৌধুরী কখনোই এসব লেনদেনের হিসাব সঠিকভাবে দেননি।
তিনি বলেন, আমাকে ডিরেক্টরশীপ দেয়ার জন্য ৭০ লাখ টাকা নেয়। কিন্তু কখনো আমাকে কোন হিসাব দেয়নি। এভাবে অনেকের কাছ টাকা নিয়ে মোট ৯ কোটি টাকা মেরে দিয়েছেন সাঈদ চৌধুরী। আমরা সেই টাকার হিসাব চাই। কোম্পানির হিসাবের বাইরে সে আমার সঙ্গে আন্তরিকতা বাড়িয়ে নতুন একটা ব্যবসা করার কথা বলে আরও ১৫ লাখ টাকা নিয়ে বর্তমানে আমার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। অনেক প্রবাসীর কষ্টের টাকা সে মেরে দিয়েছে।
এর আগে ২০১৭ সালে লন্ডনে এক সংবাদ সম্মেলনে সাঈদ চৌধুরীর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ আনেন এক্সেলসিয়র লিমিটেডের একাংশের মালিক ও লন্ডন রয়েল রিজেন্সি‘র আব্দুল বারী এবং একাংশের আরেক মালিক কয়সর খান। লিখিত বক্তব্যে আব্দুল বারী বলেছিলেন, সাঈদ চৌধুরী এক্সেলসিয়র সিলেট নামে একটি প্রজেক্টের জন্য ব্রিটেন প্রবাসীদের কাছ থেকে বিনিয়োগ সংগ্রহ করেন।
অনেকের মতো আমি আব্দুল বারী ও কয়সর খান দুজন মিলে তাকে বিশ্বাস করে মোট ১ কোটি ১৬ হাজার ৮৪৫ টাকা বিনিয়োগ করি। কিন্তু তিনি প্রজেক্টের শুরু থেকে তিনি কোন হিসাব দেননি। পরে বিনিয়োগের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা টের পেয়ে বিনিয়োগ ফেরত দিতে বলি। এরপর অর্থ ফেরত দেয়ার জন্য বার বার প্রতিশ্রুতি দিয়েও তা রক্ষা করেনি সাঈদ চৌধুরী। এছাড়াও বেশকিছু অভিযোগ আনেন তারা। এখনো তারা বিনিয়োগের অর্থ ফেরত পাননি।
এদিকে আর্থিক লেনদেনে অনিয়মের অভিযোগ এনে সাঈদ চৌধুরী ও শাহ জামালের বিরুদ্ধে যুক্তরাজ্যের আদালতে মামলা করেছেন আব্দুল বারী। এছাড়াও অভিযুক্ত সাঈদ চৌধুরী ও শাহ জামাল পরিচালকদের ভুয়া স্বাক্ষর দিয়ে কোম্পানি হাউজের কমিটি পরিবর্তন করার জন্য আবেদন করে।
পরে তাদের এই কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে বর্তমান পরিচালকরা হাইকোর্টে মামলা করেছেন। অন্যদিকে প্রবাসী ডাইরেক্টররা সাঈদ ও শাহ জামালের কাছে টাকা ফেরত চাইলে তাদের বিরুদ্ধে একাধিক ভুয়া মামলা করে। ফলে প্রবাসীরা দেশে আসতে ভয় পাচ্ছেন।
এক্সেলসিয়র সিলেট লিমিটেড নামের কোম্পানিটির একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা অভিযোগ করেন, যুক্তরাজ্যের প্রায় অর্ধশতাধিক প্রবাসী এক্সেলসিয়র সিলেট লিমিটেডে বিনিয়োগ করেছেন। এর মধ্যে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক হওয়ার জন্য ৬০ থেকে ৭০ লাখ এবং শেয়ারহোল্ডার হতে পাঁচ থেকে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত অনেকেই দিয়েছেন।
জানা গেছে, সিলেট শহরতলীর খাদিমপাড়া এলাকার জাসটেট হলিডে রিসোর্ট লিমিটেড ও জাকারিয়া সিটির প্রায় ১৭ একর ভূমির মালিক হচ্ছেন ডা. জাকারিয়া হোসেন গংরা। যার মূল্য প্রায় ৩২ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এই ভূমি ও সকল স্থাবর-অস্থাবর বিক্রির জন্য ২০১৩ সালের ১ আগস্ট নগদ এক কোটি টাকা গ্রহণ করেন তারা।
পরে এক্সেলসিয়র কোম্পানিতে ডিরেক্টরশিপ বাবদ এক কোটি ৬২ লাখ টাকা বিদ্যমান রেখে এবং তা পর্যায়ক্রমে তারিখ অনুসারে পরিশোধের কথা বলা হয়। ডা. জাকারিয়া হোসেন গংরা ১ম চুক্তিপত্রে নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে পাওয়ার অব এটর্নি (ক্ষমতা অর্পণ) প্রদান করেন এক্সেলসিয়র সিলেট লিমিটেডের ভাইস চেয়ারম্যান শামসুল ইসলাম, এমডি সাঈদ চৌধুরী ও মার্কেটিং ডাইরেক্টর আহমদ আলীকে।
পরে ২০১৪ সালের ১৮ মে ওই ৩ জনকে ডা. জাকারিয়া গংদের পক্ষে ভূমি ক্রয়-বিক্রয় হস্তান্তরের যাবতীয় ক্ষমতা উল্লেখ করে আমমোক্তারনামা রেজিস্ট্রি দলিল (নং-৫৭২৭/১৪) সম্পাদন করা হয়। যা এখনো বহাল রয়েছে। এই অবস্থায় বেআইনি ও বিধি বহির্ভূতভাবে আমমোক্তারনামার প্রথম আমমোক্তার কোম্পানির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুল ইসলামকে বাদ দিয়ে সংশ্লিষ্ট সাব রেজিস্টারের যোগসাজশে ভুয়া সাব কবালা তৈরি করা হয়।
পরে কোম্পানির পক্ষে চেয়ারম্যান সিলেট নগরীর পাঠানটুলার ২৯ স্বজন আবাসিক এলাকার বাসিন্দা শাহ জামাল ও সিরাজ মো. হককে মালিকানা দেয়া হয়। জাবেদা নকল দিয়ে ভূমি বন্ধক রেখে সাঈদ চৌধুরী ও আলী আহমদসহ সাউথইস্ট ব্যাংক থেকে ২৫ কোটি টাকা ঋণ নেন। যা এখন ৩২ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। এই ঋণ পরিশোধ না করে ভুয়া সাব কবালা দিয়ে একই ভূমি দেখিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে ফের ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড থেকে ১৫০ কোটি টাকা ঋণ গ্রহণের আবেদন করা হয়। পরবর্তিতে তারা বিভিন্ন ব্যাংকে ঋণ নেয়ার চেষ্টা করে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কোম্পানিটির সংশ্লিষ্টরা জানান, অনেক প্রবাসী এক্সেলসিয়র কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেছেন। যারা অনেকেই এখনও কোম্পানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হতে পারেনি। এ নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা না থাকলে প্রবাসীরা দেশে বিনিয়োগের আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে বলেও অনেকে মনে করেন।
অনুসন্ধানে অভিযুক্ত সাঈদ চৌধুরী ও শাহ জামালের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ পাওয়া গেছে। জানা গেছে, সাঈদ চৌধুরী ১৯৯০ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত সংগ্রাম পত্রিকার প্রতিনিধি ছিলেন। তিনি মূলত জামায়াতের একজন কর্মী। তিনি সিলেটে শিবিরের সাথী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
জানা গেছে, তিনি সৌদি আরব, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ফিলিপাইনসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে জামায়াতের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত আছেন। তিনি ইংল্যান্ড প্রবাসীকে বিয়ে করে প্রবাসেই বসবাস শুরু করেন। সেখানে প্রবাসীদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তুলে তাদের নানাভাবে প্রতারণার ফাঁদে ফেলেন।
এরপর তিনি দেশে চলে আসেন। এই সাঈদ চৌধুরীর এক ভাই আফগান যুদ্ধে মারা যান বলে সিলেটে লোকমুখে শোনা যায়। এছাড়াও তার আপন ভাই অ্যাডভোকেট রফিক জামায়াতের পদধারী নেতা। ভাতিজাও শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। সাঈদ চৌধুরী মূলত ধর্মের লেবাস গায়ে দিয়ে বছরের পর বছর ধরে সাধারণ মানুষকে প্রতারিত করে আসছেন। অভিযোগের ব্যাপারে কোম্পানিটির সাবেক এমডি সাঈদ চৌধুরীকে একাধিকবার ফোন করেও পাওয়া যায়নি। পরে যোগাযোগের কয়েকদিনের মাথায় তিনি লন্ডনে চলে যান।
অভিযুক্ত এক্সেলসিয়র সিলেট লিমিটেডের সাবেক চেয়ারম্যান শাহ জামাল জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০০০ সালের পর তিনি সৌদি আরব ও লন্ডনে মানব পাচারে সরাসরি যুক্ত ছিলেন। ভুয়া পাসপোর্টের ব্যবসা করায় ইংল্যান্ডের আদালতে তিনি সাজাও পান।
তার কু-কর্ম নিয়ে লন্ডনে একাধিক গণমাধ্যমে বিভিন্ন সময় একাধিক প্রতিবেদন করা হয়েছে। পাশাপাশি লন্ডনে এই শাহ জামালের বিরুদ্ধে একাধিক মানুষের টাকা মেরে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগের ব্যাপারে শাহ জামালকে তার মোবাইলে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি। পরে পরিচয় দিয়ে তাকে ম্যাসেজ করলেও তিনি কোন উত্তর দেননি।
পিবিএ/আরআই