বিবিসি’র চোখে ভোটার উপস্থিতি কমের ৫ কারণ

পিবিএ ডেস্ক : এবার ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ভোটারের উপস্থিতি নির্বাচন কমিশনের (ইসি) হিসাব অনুযায়ী ৩০ শতাংশের কম। যদিও বিএনপির অভিযোগ, ‘অনিয়মের এ নির্বাচনে’ ভোটার সংখ্যা নির্বাচন কমিশনের দেয়া তথ্যের চেয়েও কম ছিল। অবশ্য নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী সংস্থাগুলো বলছে, ঢাকা সিটি নির্বাচনে এতো কম ভোটারের উপস্থিতি আর কখনো দেখা যায়নি।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা অবশ্য নির্বাচনে কম ভোটারের উপস্থিতির জন্য রাজনৈতিক দল এবং প্রার্থীদের দায়ী করছেন। অথচ বাংলাদেশের ইতিহাসে সাধারণ মানুষের কাছে নির্বাচন হচ্ছে উৎসবের মতো।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, ভোট দেবার ব্যাপারে পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর উল্টো চিত্র দেখা যায় বাংলাদেশে। বেশিরভাগ মানুষ এ দেশে ভোট দিতে যান।

নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুসারে স্বাধীনতার পর প্রথম দুই দশকে জাতীয় নির্বাচনগুলোতে ভোটার উপস্থিতির হার ৫০ থেকে ৬০ শতাংশের মধ্যে ছিল। নব্বই পরবর্তী সময়ে সেই হার ৭৪ থেকে বেড়ে সাড়ে ৮৭ শতাংশ পর্যন্তও উঠেছিল।

কিন্তু ২০১৪ সালের নির্বাচন, যা বিরোধী দল বিএনপি ও ২০ দলীয় জোট বর্জন করেছিল এবং সব দলের অংশগ্রহণে ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় নির্বাচন- এই দুইটি নির্বাচন নিয়ে নানা ধরনের প্রশ্ন ওঠে।


বিরোধী দলগুলো গত কয়েক বছরের স্থানীয় নির্বাচনের প্রক্রিয়া ও ফল নিয়েও অনিয়মের অভিযোগ তুলেছে। আর এসব কারণে অনেক ভোটার এবার ভোট দিতে নিরুৎসাহিত হয়েছেন বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে কথাবার্তা বলে ও ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করে বিবিসি খুঁজে বের করেছে, এবারের নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি এত কম হওয়ার ৫টি কারণ। তা নিচে দেয়া হলো :

১. অনীহা :

নির্বাচন কমিশনের হিসাব অনুযায়ী ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে (ডিএনসিসি) ভোট পড়েছে ২৫ দশমিক ৩ শতাংশ। দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে (ডিএসসিসি) ৩০ শতাংশের মতো।

কমিশনের কর্মকর্তারা বলছেন, তরুণ ভোটারদের বড় একটি অংশ এবার ভোট দিতে যাননি। শিক্ষার্থী, চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী এমন নানা পেশার কয়েকজন যারা ভোট দেননি, তাদের কাছে প্রশ্ন ছিল, ‘কী কারণে ভোট দেননি তারা?’

তাদের একটি বড় অংশ বলেছেন, ভোট দেয়ার ব্যাপারে তাদের আগ্রহ অনেক কম ছিল।

নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী সংস্থার জোট ফেয়ার ইলেকশন মনিটরিং অ্যালায়েন্সের (ফেমা) প্রধান মুনিরা খান বলেছেন, নির্বাচন পর্যবেক্ষণের ২৫ বছরের অভিজ্ঞতায় অংশগ্রহণমূলক কোনো নির্বাচনে এত কম ভোটারের উপস্থিতি তিনি কখনো দেখেননি।

‘আমি গত ২৫ বছর ধরে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করছি, ঢাকা সিটি নির্বাচনে এত কম ভোটার আমি আগে কোনোদিন দেখিনি। এর কয়েকটি কারণ রয়েছে : এক, তরুণদের মধ্যে ভোট দেবার ব্যাপারে বিরাট অনীহা। তারা মনে করে তাদের ভোটে ‘কি আসে যায়’।

২. অনাস্থা :

বিবিসিকে একজন শিক্ষার্থী বলছিলেন, ‘ভোট দিতে যেতে অত আগ্রহ পাইনি। কারণ, আমরা জানি, আমি ভোট দিলেও যে নির্বাচিত হবে, না দিলেও সে-ই নির্বাচিত হবে।’

কীভাবে জানেন জানতে চাইলে তার উত্তর ছিল- ‘আমরা চারপাশে তেমনই শুনে আসছি সবসময়।’

 

আরেকজন বলছিলেন, ‘আমার নির্বাচনের প্রার্থী পছন্দ হয়নি, আর না-ভোটেরও ব্যবস্থা নেই, তাই আমি ভোট দেইনি।’

এবার ইভিএমে ভোটগ্রহণ হওয়ার কারণে, অনেকের মধ্যে এটা নিয়েও অনাস্থা ছিল বলে মনে করেন মনিরা খান। তাছাড়া নির্বাচন ব্যবস্থার ওপর মানুষের অনাস্থা তৈরি হওয়ার কথাও বলছেন তিনি। ‘নির্বাচন কমিশনের প্রতি মানুষের আস্থা অনেক কমে গেছে। এই আস্থা যদি বেশি থাকতো তাহলে আরও অনেক বেশি মানুষ ভোট দিতে যেত।’

তবে নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপর ভোটাররা আস্থা হারিয়েছেন বলে ভোট দিতে যাননি, এমন অভিযোগ মানতে চাননি নির্বাচন কমিশনার অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা শাহাদাত হোসেন চৌধুরী।

বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, ‘এটি একটি কারণ হতে পারে, তবে প্রধান কারণ নয়।’

৩. অনিয়মের আশঙ্কা

একজন বেসরকারি চাকরিজীবী বলেছেন, ‘আমি কেন্দ্রে গিয়েছিলাম, কিন্তু গিয়ে দেখি আমার সাথের জনের ভোট আগেই দেয়া হয়ে গেছে। তখন ওর সাথে আমিও চলে আসি।’

পর্যবেক্ষক মুনিরা খান বলছিলেন, ঢাকার বাইরের স্থানীয় নির্বাচনেও ভোটারদের উপস্থিতি কমে এসেছে। এ জন্য ভোটকেন্দ্র দখল, ব্যালট ছিনতাই, ভোটকেন্দ্র থেকে বিরোধী এজেন্টদের বের করে দেয়া এবং সংঘর্ষের আশঙ্কা ইত্যাদি অনিয়মকে তিনি দায়ী মনে করেন।

অবশ্য এবারের ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচন ব্যাপকভিত্তিক অনিয়মের অভিযোগ খুব একটা ওঠেনি।

৪. পরিবহন সংকট :

বিবিসির সঙ্গে আলাপে ঢাকার একজন ভোটার বলেন, ‘আমার বাসা মোহাম্মদপুর, কিন্তু আমি যাত্রাবাড়ীর ভোটার। রাস্তায় তো গাড়ি চলে নাই, আমি যে যাব, তারপর ফিরে আসব কীভাবে – তাই যাই নাই।’

নির্বাচন কমিশনার শাহাদাত হোসেন চৌধুরী এ কারণের সঙ্গে একমত। তিনি বলেন, ‘ভোটারদের আগ্রহ কমে যাওয়ার অনেক কারণ আছে, আমরা যেসব পদক্ষেপ নিয়েছি তার প্রভাব তো আছেই। যেমন, আমরা গাড়ি বন্ধ করে দিয়েছিলাম, সেটা একটা কারণ। অনেকে হয়তো চিন্তা করেছে সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফলাফলে তাদের কী আসে-যায়। এসব নানাবিধ কারণই কাজ করেছে এর পেছনে।’

৫. ছুটির ফাঁদ :

এবার ভোট ছিল শনিবার। শুক্র ও শনিবারের আগে বৃহস্পতিবার দিনটি ছিল হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের স্বরস্বতি পূজা। এই দিনটিতে বাংলাদেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছুটি থাকে।

এরপর শুক্রবার এবং ভোটের দিন শনিবার, সব মিলে তিন দিনের বিরতি তৈরি হওয়ায় ঢাকার অনেক মানুষই ছুটি কাটাতে শহরের বাইরে চলে গিয়েছিলেন বলে মনে করেন নির্বাচন কমিশনার শাহাদাত হোসেন চৌধুরী।

তিনি বলেন, ‘নির্বাচনে মূলত নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তরা বেশি গেছেন। অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো এমন অনেকে ভোট দিতে যান নাই। অনেকে ছুটি পেয়ে ঢাকার বাইরে বেড়াতে চলে গেছেন।’

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও বলেছে, নির্বাচনের তারিখ পেছানো এবং শনিবার ছুটির দিন হওয়ায় ভোটার উপস্থিতি আশানুরূপ ছিল না।

খরব : বিবিসি বাংলা

আরও পড়ুন...