পিবিএ,ডেস্ক: জানমালের ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনার লক্ষে ঘূর্ণিঝড়ের আগাম তথ্য জানার নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে। জাপান ও বাংলাদেশের যৌথ তত্ত্বাবধানে দেশে প্রথমবারের মতো এ প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) এক দল গবেষক। সাইক্লোন ক্লাসিপায়ার মডেল (সিসিএম) নামের ওই পদ্ধতির মাধ্যমে ঘূর্ণিঝড়ের সময় উপকূলীয় ১৯ জেলার ১৫৩ উপজেলায় বাতাসের গতিবেগ জানা যাবে। এ ছাড়া বের করা যাবে জোয়ার ও ভাটার সময় জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে উপকূলীয় জেলায় বেড়িবাঁধগুলোর কোনটি ভাঙার পরিস্থিতি তৈরি হবে আর কোনটি ভাঙবে না, সেটিও জানা যাবে আগেভাগে। এ ছাড়া উপকূলীয় এলাকায় কাঁচা, আধাপাকা, পাকা এই তিন শ্রেণির কোন শ্রেণির বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হবে, সেটি আগাম জানা যাবে সিসিএম পদ্ধতি ব্যবহার করে। ঘূর্ণিঝড় উপকূলে আঘাত হানার সময় জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা কত হবে, সিসিএম ব্যবহার করে সেটিও দেখা যাবে।
বুয়েটের বন্যা ও পানি ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউট (আইডাব্লিউএফএম) ও পুরকৌশল বিভাগের এক দল গবেষক পাঁচ বছরের গবেষণায় সিসিএম সফটওয়্যার তৈরি করেছেন। দেশের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ১৭০টি ঘূর্ণিঝড়ের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে এই পদ্ধতি উদ্ভাবন করা হয়েছে। ২০১৪ সালের এপ্রিল থেকে শুরু করে ২০১৯ সালের মার্চে গবেষণার কাজ শেষ করে গবেষকদল। এই গবেষণার সঙ্গে যুক্ত ছিল জাপানের অন্তত ১০টি এবং বাংলাদেশের অন্তত ১০টি বিশ্ববিদ্যালয়।
নতুন পদ্ধতি নিয়ে আবহাওয়া অফিসের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করেছে বুয়েটের গবেষকদল। এখন তারা পরীক্ষামূলকভাবে সিসিএম পদ্ধতি ব্যবহার করছে। এই পদ্ধতিতে আরো কিছু সংযোজন করা দরকার কি না তার খুঁটিনাটি বিচার-বিশ্লেষণ চলছে। বিদ্যমান আবহাওয়া আইন অনুযায়ী, আবহাওয়া ও ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস দেওয়ার ক্ষমতা আবহাওয়া অধিদপ্তরের, অন্য কারো নেই। বুয়েটের গবেষকরা বলছেন, আবহাওয়া অফিস চাইলে এই পদ্ধতি ব্যবহার করতে পারে।
ওই গবেষকদের আশা, এই প্রযুক্তি ব্যবহার করলে ঘূর্ণিঝড়ে হতাহতের সংখ্যা কমে আসবে। একই সঙ্গে ফসলের ক্ষতিও কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।
আবহাওয়া অফিসের কর্মকর্তারা বলছেন, বুয়েটের গবেষণাটি তাঁরা দেখেছেন। তবে এ ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করার ইতিবাচক দিক যেমন আছে, তেমনি এর নেতিবাচক দিকও আছে। এটি ব্যবহার করা যাবে কি না সব দিক বিবেচনা করে তারপর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
বুয়েটের আইডাব্লিউএফএমের অধ্যাপক মনসুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, ঘূর্ণিঝড় তৈরি হওয়ার পর বাংলাদেশের উপকূলে আঘাত আনার আগেই সিসিএম পদ্ধতি ব্যবহার করে বলে দেওয়া সম্ভব হবে, ঘূর্ণিঝড়ের কারণে কোন উপজেলায় বাঁধ ভাঙার শঙ্কা আছে। তাৎক্ষণিক পানি উন্নয়ন বোর্ড ওই এলাকার বাঁধ সংস্কার করতে পারবে। গত ৪ মে বাংলাদেশের উপকূলে ঘূর্ণিঝড় ফণীর আঘাত হানার উদাহরণ টেনে মনসুর রহমান বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় ফণী আঘাত হেনেছে খুলনা অঞ্চলে। অথচ ওই সময়ে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে সতর্কতা সংকেত চলছে ৪ ও ৬ নম্বর। সেই সংকেত ওই এলাকার মানুষের জন্য দরকার ছিল না। ঘূর্ণিঝড়ের কারণে কোন কোন এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, আমরা সেটি বলে দিতে পারব।’
গবেষকদলের সদস্য ও আইডাব্লিউএফএমের অধ্যাপক আনিসুল হক গণমাধ্যমকে বলেন, সিসিএম সফটওয়্যারে একটি ঘূর্ণিঝড়ের সম্ভাব্য ভূমি অতিক্রম করার স্থান ও বাতাসের গতিবেগ ইনপুট হিসেবে দিলে এই ঘূর্ণিঝড়ের কারণে বাংলাদেশের ১৯টি উপকূলীয় জেলার অন্তর্গত উপজেলাগুলোতে সম্ভাব্য বাতাসের গতিবেগ, বন্যার পানির উচ্চতা, বেড়িবাঁধের ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা ও বিভিন্ন রকম বাড়িঘরের ক্ষতির সম্ভাব্য তথ্য চলে আসবে।
আবহাওয়া অফিসের কর্মকর্তা আবদুল মান্নান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বুয়েটের গবেষণাটি আমরা হাতে পেয়েছি। রিসার্চ হিসেবে এটি অত্যন্ত উঁচুমানের। তবে যেকোনো গবেষণা বাস্তবায়ন কঠিন। কারণ অনেক সময় দেখা গেছে, ঘূর্ণিঝড় ক্ষণে ক্ষণে অবস্থান বদলায়। গতিপথও বদলায়। ফলে এই ধরনের মডেল ব্যবহারে এক ধরনের ঝুঁকিও আছে।’ আবদুল মান্নান বলেন, ‘আমরা এখন যে পদ্ধতিতে ঘূর্ণিঝড়ের তথ্য দিই, তা বিভাগ ও উপকূলীয় জেলাওয়ারি। উপজেলা ধরে আমরা পূর্বাভাস দিই না। ঘূর্ণিঝড়ের গতিবেগ ও অবস্থান পরিবর্তন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পূর্বাভাস না মিললে জনমনে আতঙ্ক দেখা দেওয়ার শঙ্কা থাকে। তাই বুয়েটের গবেষণাটি ভবিষ্যতে পূর্বাভাস হিসেবে ব্যবহার করা হবে কি না, তা বলার সময় এখনো হয়নি।’
আবহাওয়া অফিসের দেওয়া তথ্য মতে, বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড় তৈরি হলে বিপত্সংকেত দেওয়া হয় বিভাগ ও উপকূলীয় জেলাগুলোর জন্য। এখন পর্যন্ত উপজেলার জন্য আলাদা কোনো সংকেত ও পূর্বাভাস দেওয়া হয় না আবহাওয়া অফিস থেকে। বুয়েটের গবেষকদল প্রথমবারের মতো উপজেলা পর্যন্ত পূর্বাভাস দেওয়ার পদ্ধতি তৈরি করেছে। সিসিএম পদ্ধতি ব্যবহার করে জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা, বাতাসের গতিবেগ, বেড়িবাঁধ ভাঙার তথ্য এবং বাড়িঘর ভাঙা মোট চার ধরনের তথ্য মিলবে। সিসিএম পদ্ধতির মাধ্যমে তটরেখা থেকে ঘূর্ণিঝড়ের অবস্থান নির্ণয় করে দেখা যাবে, বরগুনার আমতলীতে যখন ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানবে তখন বাতাসের গতিবেগ কত থাকবে, জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা কত হবে, বাঁধ ভাঙবে কি না এবং তিন শ্রেণির বাড়িঘরের মধ্যে কোনগুলো ভাঙবে আর কোনগুলো ভাঙবে না। এভাবে ১৫৩টি উপজেলায় আগাম তথ্য জানা যাবে; যদিও বাংলাদেশের উপকূলে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার সময় বাতাসের গতিবেগ কত থাকবে এবং গতিপথ-এই দুটি বিষয় সিসিএম পদ্ধতিতে দেখা যাবে না।
ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াবহতা কতটুকু, তা বোঝানোর জন্য ১ থেকে ১১ নম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের (সতর্ক, হুঁশিয়ারি, বিপদ ইত্যাদি) সংকেতের ব্যবহার চলে আসছে বছরের পর বছর ধরে। স্থানীয় জনসাধারণ ও দুর্যোগ বিশেষজ্ঞরা বলে আসছেন, ব্রিটিশ আমলে তৈরি করা এই সংকেত শুধু জাহাজের নাবিক ও সমুদ্রবন্দরের জন্য, সাধারণ মানুষের জন্য নয়। ঘূর্ণিঝড়ের অবস্থান, গতিবেগ, গতিপথ এবং উপকূলে আছড়ে পড়ার হালনাগাদ তথ্যের গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন আছে সাধারণের মনে। সেটি প্রকট হয়েছে ঘূর্ণিঝড় ফণীর সময়। বিভিন্ন মহল থেকে ওঠা দাবির মুখে একবার সংকেত সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হলেও পরে তা আর আলোর মুখ দেখেনি। বুয়েটের গবেষকদল বলছে, বিদ্যমান সংকেত ব্যবহার করেও তাদের গবেষণাটি কাজে লাগানোর সুযোগ রয়েছে।
বুয়েটের গবেষকদলের মতে, ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার আগেই সম্ভাব্য আক্রান্ত স্থানের তথ্য জানা থাকলে একদিকে যেমন নিরাপদ আশ্রয়ে মানুষকে সরানো সম্ভব হবে, অন্যদিকে মানুষের মধ্যেও সচেতনতা বাড়বে। একইভাবে এই তথ্য উপকূলীয় বাঁধ পুনর্নির্মাণ, উপকূলীয় এলাকার জন্য উপযুক্ত আবাসস্থল তৈরিতেও দিকনির্দেশক হিসেবে কাজ করবে।
পিবিএ/বাখ