পিবিএ,ঢাকা: করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালু করেছিল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। তবে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) একতরফাভাবে এ শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধের সিদ্ধান্ত দেওয়ায় সেশনজটের শঙ্কা দেখা দিয়েছে দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে।
জানা গেছে, করোনাভাইরাসের কারণে দেশের সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের এ পরিস্থিতিতে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম চালু করে সরকার। একইভাবে দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থীদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম জোরদার করে। গত ২৪ মার্চ ইউজিসি এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে শিক্ষার্থীদের যে অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে, তা সাময়িকভাবে পূরণের জন্য শিক্ষকদের অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার বিষয়ে নির্দেশনা দেয়। তবে ৬ এপ্রিল দেওয়া আরেক নির্দেশনায় অনলাইনে পরীক্ষা গ্রহণ ও মূল্যায়ন কার্যক্রম বন্ধ রাখার আহ্বান জানায় ইউজিসি। সর্বশেষ ১০ এপ্রিল আবার অনলাইনে ক্লাস নিতে আহ্বান জানানো হলেও পরীক্ষা ও মূল্যায়ন বন্ধ রাখার অনুরোধ জানানো হয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্তৃপক্ষের অভিযোগ, তাদের সঙ্গে কোনো পরামর্শ না করে এবং সক্ষমতা যাচাই না করেই অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশনা দিয়েছে ইউজিসি।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম রীতিমতো স্বীকৃত। বাংলাদেশেও বেশির ভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্বাভাবিক সময়ে শ্রেণিকক্ষে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি অনলাইনে শ্রেণি কার্যক্রম, অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া ও গ্রহণ, মূল্যায়ন ও গ্রেডিং ইত্যাদি করে থাকে। শিখন শেখানো কার্যক্রম স্বচ্ছ ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতেই এ ব্যবস্থা চালিয়ে আসছিল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। ফলে করোনাভাইরাসের প্রকোপের এ সময়টাতে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন কোনো বিষয় নয়। বরং যেসব বিশ্ববিদ্যালয় পিছিয়ে ছিল তারাও অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমে যুক্ত হয়। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাস টেস্ট ও মূল্যায়নও শুরু করে। কিন্তু ইউজিসির এ সিদ্ধান্তে হুট করে শিক্ষা কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হবে, বাড়বে সেশনজট। এতে কার্যত প্রায় ছয় মাস শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
জানতে চাইলে স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক মুহাম্মাদ আলী নকী বলেন, ‘ইউজিসি ক্লাস নিতে বলেছিল, আবার বন্ধ করতে বলেছে। যদিও ক্লাস টেস্ট না নিলে অনলাইন ক্লাসে শিক্ষার্থীরা অংশ নেবে না। কিন্তু ইউজিসি বলছে, ক্লাস নিলেও ক্লাস টেস্ট নেওয়া যাবে না, মূল্যায়ন করা যাবে না। পরীক্ষা নিতে পারব না, তাহলে অনলাইন ক্লাসে অংশ নেবে কোনো শিক্ষার্থী? নেবে না। এতে শিক্ষার্থীরা একটি সেমিস্টার পিছিয়ে পড়বে। কারণ করোনা পরিস্থিতি আজই স্বাভাবিক হচ্ছে না। আর এজন্য বসে থাকলে সেশনজটেও পড়বে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো।’
ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির (ইউআইইউ) উপাচার্য অধ্যাপক ড. চৌধুরী মফিজুর রহমান বলেন, ‘ইউজিসি যখন ক্লাস নিতে বলেছিল, তখনই বলা উচিত ছিল ইভ্যালুয়েশনে (মূল্যায়নে) যাওয়া যাবে না। কিছু বলব কিছু বলব না, আবার মাঝখানে এসে বলব, করা যাবে না। এটি দুঃখজনক। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ইভ্যালুয়েশনে হয়তো চলে গেছে। ইউজিসি আমাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা না করেই এসব সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। করোনা পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হলে সেশনজটের পরিস্থিতি তো তৈরি হবেই।’
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. এস এম মেহবুব উল হক বলেন, ‘ক্লাস করতে পারমিশন দিলে কেন ইভ্যালুয়েশন করতে পারা যাবে না? কেন ক্লাস নেওয়ার পারমিশন দিয়ে ইভ্যালুয়েশনের পারমিশন দিচ্ছে না? কম সময়ের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকলে হয়তো সেশনজট কাটিয়ে ওঠা যাবে। কিন্তু বেশিদিন বন্ধ থাকলে আর অনলাইন পরীক্ষা ও মূল্যায়ন করা না গেলে সেশনজট তো হবেই।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক বলেন, ‘১৫ দিন বা তার কমবেশি কিছু সময় বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকলে তা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সে সক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু মাসের পর মাস শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ থাকলে তা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে না। অবশ্যই সেশনজট তৈরি হবে।’
ইউজিসির সিদ্ধান্তের বিষয়ে বাংলাদেশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির (এপিইউবি) সভাপতি শেখ কবির হোসেন বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা না করে ইউজিসি একতরফা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। করোনার কারণে বিশ্ববিদ্যালয় দীর্ঘদিন বন্ধ থাকলে তো সেশনজট হবেই। ক্ষতি হবে শিক্ষার্থীদের।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইউজিসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. কাজী শহীদুল্লাহ গতকাল শনিবার বলেন, আমরা অনলাইনে ক্লাস নিতে বলেছিলাম যেন শিক্ষার্থীরা পড়াশোনায় নিবিষ্ট থাকে। অথচ অভিযোগ আসছে, কিছু কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কোনো পরীক্ষা ছাড়াই শিক্ষার্থীদের পাস করিয়ে দিতে চাইছে। কেউ কেউ অনলাইনে নামমাত্র পরীক্ষা নিয়ে যা তা করতে চায়। সারা পৃথিবীতে এখন পরীক্ষা স্থগিত, শিক্ষার্থীরা জীবন শঙ্কায়। একটা আতঙ্ক, প্যানিক সৃষ্টি হয়েছে। এর মাঝে তারা পরীক্ষা দেবে কী করে? অনলাইন পরীক্ষায় কেউ আছে ঢাকায়, কোনো শিক্ষার্থী আছে কক্সবাজারে, কেউ বাগেরহাটে। সবার তো ইন্টারনেট বা স্মার্ট ফোন নেই। আবার এ পরীক্ষায় নকল হবে না, বাসায় বসে কেউ বই খুলে লিখবে না, তা কে নিশ্চিত করবে?
তিনি বলেন, এ সিদ্ধান্ত দেওয়ার পর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পুনর্বিবেচনার জন্য একটা আপিল করেছিল। আমি কমিশনের সদস্যদের সঙ্গে তা আলাপ করেছি। করোনা পরিস্থিতি আগের চেয়ে আরও ভয়াবহ রূপ লাভ করেছে। কমিশনের কেউ এ পরিস্থিতিতে অনলাইনে পরীক্ষা নিতে সম্মতি দেননি। আর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও তো অপেক্ষা করছে। সেশনজট তাদের কি হবে না? তিনি বলেন, ১৯৭২ সালে মুক্তিযুদ্ধের পরিস্থিতিতে পরীক্ষা হয়নি। আমার নিজের জীবন থেকে দুই বছর চলে গেছে তখন।
ইউজিসি চেয়ারম্যান আরও বলেন, তারা (বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো) বর্তমান পরিস্থিতির মধ্যেও অনলাইনে সামার সেমিস্টারের ভর্তি চালিয়ে যেতে চায়। আমি এ বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছি। এপ্রিল পর্যন্ত আমরা পরিস্থিতি দেখব কী হয়। মে মাসের প্রথম সপ্তাহে পরিস্থিতি বুঝে ভর্তির বিষয়ে তখন সিদ্ধান্ত দেবো। মন্ত্রীও এ বিষয়ে একমত পোষণ করেছেন।
পিবিএ/এএম