
আগামীকাল (৩১ ডিসেম্বর) বেলা তিনটায় ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ দেবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। তাদের এই ঘোষণাপত্রে নতুন করে কী উত্থাপিত হতে যাচ্ছে তা নিয়ে টেনশনে আছে রাজনৈতিক দলগুলো।
রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা বলছেন, বৈষম্য বিরোধীদের ঘোষণাপত্রে কী থাকছে তা নিয়ে পরিষ্কার কোনো ধারণা নেই আমাদের। কারণ, এই ঘোষণা করা নিয়ে তারা রাজনৈতিক দল কিংবা সমাজের গুরুত্বপূর্ণ অংশীজনদের সঙ্গে কোনো আলাপ-আলোচনা করেনি। এ অবস্থায় ঘোষণাপত্রে নতুনত্ব কী থাকছে কিংবা নতুন কোন ধরনের দাবি হাজির করতে যাচ্ছে, তা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো টেনশনে থাকাটাই স্বাভাবিক।
তবে, রাজনৈতিক নেতারা এও বলছেন, দেশের বর্তমান অস্থির ও নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিতে এই মুহূর্তে সব পক্ষের মধ্যে একটা বৃহৎ ঐক্য দরকার ছিল। কিন্তু সেখানে সবাইকে বাদ দিয়ে বৈষম্য বিরোধী নামে একটা অংশের এই ধরনের উদ্যোগ দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি আরও বাড়বে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, তারা আগে তাদের ‘ঘোষণাপত্র’ ঘোষণা করুক। তারপর এটা নিয়ে কথা বলা যাবে। এ মুহূর্তে কোনো মন্তব্য করতে চায় না।
দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘তাদের ঘোষণাপত্রে কী থাকছে, সেটি আমরা এখনো জানি না।’
বৈষম্য বিরোধীদের ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ ঘোষণার পর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তাদের আরও দূরত্ব বাড়বে বলে মনে করেন দলগুলোর নেতারা। তারা বলছেন, এই ঘোষণাপত্র তৈরি নিয়ে তারা রাজনৈতিক দল কিংবা ছাত্র সংগঠনগুলোর সঙ্গে কোনো আলাপ-আলোচনা করেনি।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, অভ্যুত্থানকারী ছাত্র-জনতার পক্ষ থেকে তারা যে ঘোষণাপত্র দিতে যাচ্ছে, তা অধিকাংশ রাজনৈতিক দল এবং সমাজের গুরুত্বপূর্ণ অংশীজনদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে দেওয়া হচ্ছে বলে আমার মনে হয় না। এই ধরনের কিছু দিতে গেলে রাজনৈতিক দল, সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে ঐকমত্যের ভিত্তিতে দেওয়া দরকার ছিল। কিন্তু এখন বৈষম্য বিরোধী নামে যারা কাজ করছেন, তারা তাদের একটা বক্তব্য হাজির করতে যাচ্ছেন। এটা নিয়ে আমরা কিছুই জানি না।
সাইফুল হক বলেন, দেশ যখন একটা অস্থিতিশীল-অনিশ্চিত পরিস্থিতির মধ্যে চলছে তখন দরকার ছিল রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একটা বৃহত্তর ঐক্য ও সমঝোতা। কিন্তু সেই মুহূর্তে বৈষম্য বিরোধীদের এই ধরনের তৎপরতা আমাদের মধ্যে আশঙ্কা, বিভক্তি, বিভাজন, দূরত্ব, সন্দেহ ও অবিশ্বাস বাড়িয়ে তুলতে পারে।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, এটা বৈষম্য বিরোধী নামের একটি অংশের ঘোষণাপত্র। তাদের সঙ্গে নাগরিক কমিটি রয়েছে। এই ঘোষণাপত্রের সঙ্গে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের কোনো সম্পর্ক নেই।
বিএনপিসহ অন্য রাজনৈতিক দলগুলো নেতারা বলছেন, বৈষম্য বিরোধী ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্রে কী থাকছে তা সম্পূর্ণ জানা না গেলেও ইতোমধ্যে সংবিধান নিয়ে তাদের একটি বক্তব্য সবার সামনে চলে এসেছে। সেখানে তারা ৭২-এর সংবিধানকে মুজিববাদী সংগঠন আখ্যায়িত করে ‘কবর’ দেওয়ার কথা বলেছে। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত এই সংবিধান নিয়ে এই ধরনের বিদ্বেষপূর্ণ বক্তব্য সাধারণত স্বাধীনতা বিরোধীরা দিয়ে থাকেন। সেখানে ছাত্রদের পক্ষ থেকে এই ধরনের বক্তব্য আসায় একটা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে— তাদের সঙ্গে স্বাধীনতা বিরোধী কেউ জড়িত আছে কিনা?
বিএনপি নেতারা বলছেন, সংবিধান একটি জাতির আত্মজীবনী। এই সংবিধানে বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা বলা আছে। আর পৃথিবীর কোনো সংবিধানই একেবারে নিখুঁত কিংবা ‘পারফেক্ট’ নয়। তাই এটি পরিবর্তন ও পরিমার্জন হতে পারে। কিন্তু বৈষম্য বিরোধীরা সংবিধানকে একেবারে বাতিল করার যে দাবি তুলছে, তা গ্রহণযোগ্য নয়। আর সংবিধানতে কবর দেওয়া হবে, এটা একটা রাষ্ট্রবিরোধী শব্দ।
দলটির নেতারা বলছেন, তারা সংবিধান সংস্কার চায়। তার জন্য দলের পক্ষ থেকে সংবিধান সংস্কার কমিশনে একটি প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বৈষম্য বিরোধীরা সংবিধান বাতিলের যে দাবি করছেন, সেটি করতে দেশে একটি সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টি হবে। একটি নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, সংবিধান একটি জাতির আত্মজীবনী। এটি সংশোধন হতে পারে সময়-সময়ে। কিন্তু বাতিল হতে পারে না। এই সংবিধানে বাংলাদেশের স্বাধীনতা কথা রয়েছে, আরও অনেক কথা রয়েছে, যেইগুলো জনগণের কল্যাণে নিহিত। সেটাকে আপনি কীভাবে বাদ দিবেন।
সংবিধানের বিধানগুলোকে না মেনে শেখ হাসিনা ফ্যাসিবাদ কায়েম করেছিল বলে উল্লেখ করে রুহুল কবির রিজভী বলেন, সংবিধানে ফ্যাসিবাদের যে বৈশিষ্ট্যগুলো আছে, সেইগুলো সংশোধন হতে পারে। সংবিধানকে পাশ কাটিয়ে শেখ হাসিনা যে অকর্ম করেছে সেইগুলো, সেগুলো নিয়ে কথা হতে পারে। কিন্তু সংবিধান বাতিল করে নতুন করে লেখা হবে, আমার মনে হয় এতে একটা জাতির যে ধারাবাহিকতা, সেটি ক্ষুণ্ন হবে।”
বিপ্লবী ওয়ার্কাস পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ইতিমধ্যে তাদের যেটুকু বক্তব্য বেরিয়ে আসছে, যা আমরা দেখেছি। তারা যেভাবে ৭২ সংবিধানকে মুজিববাাদী সংগঠন আখ্যায়িত করে কবর দেওয়ার কথা বলছে, প্রথমত এটা ভুল উপস্থাপনা। এর মধ্যে এক ধরনের বিদ্বেষ কাজ করছে। ৭২ সংবিধান নিয়ে এই ভাষায় কথা বলতো স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীরা। ছাত্ররা এই ভাষায় কথা বলবে না, এটাই আমরা দেখতে চায়।
তিনি আরও বলেন, ৭২ এই সংবিধান ছিল পাকিস্তানের জান্তার বিরুদ্ধে আমাদের ২৩ বছরের বাঙালি জাতিসত্তার লড়াই। বিশেষ করে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের যে লড়াই, লাখও শহীদের রক্তস্নাত ছিল এই সংবিধান। এই সংবিধানে অনেক ঘাটতি, দুর্বলতা আছে। তা নিয়ে অনেকগুলো বিকল্প প্রস্তাবনা আছে, তা আমরা গণতন্ত্র মঞ্চের পক্ষ থেকে ৩১ দফায় বলেছি। সেখানে সংশোধনের অনেকগুলো প্রস্তাবনা রয়েছে। এটি বাতিল করতে গেলে বর্তমান যে অস্থিরতা ও নৈরাজ্য তা বাড়িয়ে তুলবে।
বিগত সাড়ে ৪ মাসে বৈষম্য বিরোধীরা জনগণ থেকে নিজেদেরকে অনেকখানি বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে বলে দাবি করে সাইফুল হক বলেন, তাদের বক্তব্য, বিবৃতি ও অতিকথনে তারা নিজেদেরকে রাজনৈতিক দল, সমাজের বহৎ অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে।
সংবিধান সম্পর্কে বৈষম্য বিরোধীরা যে কথাগুলো বলছে তা গ্রহণযোগ্য নয় বলে উল্লেখ করে শামসুজ্জামান দুদু বলেন, এটাকে কবর দেওয়া হবে, যে শব্দ বলছে এটি বাস্তবচিত না। সংবিধান পরিবর্তন, পরিমার্জন করা জন্য একটি নির্দিষ্ট ফোরাম আছে, সেটা হলো সংসদ। আর কোনো সংবিধানই পারফেক্ট থাকে না। এটা পরিবর্তন, পরিমার্জন হয়। সেটা ‘কবর’ নেওয়া- এটা রাষ্ট্রদোহিতামূলক শব্দ।
বিএনপির নেতারা বলছেন, ৫ আগস্টের পর থেকে একটি রাজনৈতিক দল বিএনপিকে আক্রমণ করে কথা বলে আসছে। ওই দলটি আবার নতুন করে বিএনপিকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করে আসছে। তাদের লক্ষ্য বিএনপিকে বিতর্কিত করে রাজনৈতিক ফায়দা নেওয়া। তাদের সঙ্গে বৈষম্য বিরোধীদের হঠাৎ করে ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ দেওয়ার কোনো যোগসূত্র আছে কিনা, সেটিও পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। তা ছাড়া এই ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে আগামী নির্বাচনকে বিলম্বিত করে বৈষম্য বিরোধীদের নতুন দল গঠনে সহায়তা করাও একটা লক্ষ্য হতে পারে বলে মনে করে বিএনপি।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, জনগণ এখন প্রয়োজন নির্বাচন ও নির্বাচিত সরকার। কারণ, এই মুহূর্তে নির্বাচন হচ্ছে বড় সংস্কার। নির্বাচনের লক্ষ্যে যেই সংস্কার প্রয়োজন সেটি এখন সময়ের দাবি।
তিনি আরও বলেন, কেউ রাজনীতি কিংবা রাজনৈতিক দল করতে চাইলে তাদেরকে আমরা স্বাগত জানাই। বৈষম্য বিরোধীরা রাজনৈতিক দল করতে চাইলে তাদেরকে আমরা স্বাগত জানাই। আমাদের দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান বাকশাল থেকে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিল। তবে, তারা সরকারের থেকে সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করে, কোনো এজেন্সিকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক দল গঠন করে তাহলে তা হবে বড় ধরনের বৈষম্য।
প্রিন্স বলেন, কোনো পক্ষকে রাজনৈতিক দল গঠনের সুবিধা দেওয়ার অভিপ্রায় সংস্কার কার্যক্রম ধীরগতি করবে এবং সেটি জাতির সঙ্গে বেঈমানি হবে। কাউকে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে দেওয়ার জন্য কোনো সংস্কার হাতে নিলে সেটি জাতি গ্রহণ করবে না।
বৈষম্য বিরোধীদের শহীদ মিনারের অনুষ্ঠানে যাবে না ছাত্র সংগঠনগুলো
জুলাই-আগস্টের বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয় বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা। কিন্তু ৫ আগস্টের পর থেকে নানা ইস্যুতে বৈষম্য বিরোধী সমন্বয়কদের সঙ্গে ছাত্র সংগঠনগুলোর দূরত্ব তৈরি হয়েছে। গত ৬ ডিসেম্বর দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত এলে জীবন দিয়ে তা মোকাবিলা করার প্রত্যয় নিয়ে ২৮টি ছাত্র সংগঠন নেতাদের মধ্যে মতবিনিময় সভা হয়।
তবে আগামী ৩১ ডিসেম্বরের অনুষ্ঠানে ছাত্রদল, ছাত্র ফেডারেশন, ছাত্র ইউনিয়ন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টসহ ২৮টি সংগঠনের নেতারা অংশ নেবেন না বলে জানা গেছে।
ছাত্র ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক সৈকত আরিফ বলেন, আমরা মনে করি জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণা তৈরির সময়ে সব পক্ষের যুক্ততা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ছিল, যা জনগণের ঐক্যবদ্ধ ঘোষণা হিসেবে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হতো। কিন্তু তা না করে জুলাই অভ্যুত্থানকে কুক্ষিগত করে তার ঘোষণা এককভাবে নিজেদের মতো তৈরি করে তা ঘোষণার মধ্যে দিয়ে জনগণকে স্থায়ী বিভাজনের দিকে ঠেলা দেওয়া হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, আমরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের কাছে উদাত্ত আহ্বান জানাই জুলাই অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে জনগণকে স্থায়ী বিভাজনের দিকে ঠেলে দেবেন না।
ছাত্র দলের সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন বলেন, সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ অনুযায়ী সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা বজায় রেখে জাতীয় ঐকমত্যের সরকার গঠনের পাঁচ মাসের মাথায় এসে হঠাৎ করে কথিত বিপ্লবের ঘোষণাপত্র ঘোষণা করা দুরভিসন্ধিমূলক। একটি বিশেষ গোষ্ঠী ছাত্রজনতার ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের মালিকানা ছিনতাই করার লক্ষ্যে এক ধরনের হঠকারী পদক্ষেপ নিচ্ছে। নিজেদের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ থেকে এখন আবার নতুন করে বিপ্লবের ইশতেহার সামনে আনতে যাচ্ছে।
বৈষম্য বিরোধীরাই এখন ক্ষমতায়, ক্ষমতায় থেকে কার বিরুদ্ধে বিপ্লব করবে বলেও প্রশ্ন রাখেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, আমরা মনে করি এমন পদক্ষেপ ড. ইউনূস সরকারের বিরুদ্ধে আত্মঘাতী পদক্ষেপ। অহেতুক ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে বর্তমান সরকারের গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে আন্তর্জাতিক মহলে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করবে। এই ঘোষণাপত্র পাঠের পেছনে একাত্তরের পরাজিত শক্তির ইন্ধন রয়েছে। তারা একাত্তরের ইতিহাস ভুলিয়ে দিয়ে রাজনীতি করতে চায়।