ব্যাংক ঋণ পেতে ভ্যাটের তথ্য লাগবে

পিবিএ,ঢাকা: ব্যাংকের ঋণ প্রস্তাব অনুমোদনের ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে নতুন নির্দেশনা দিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এ নির্দেশ অনুযায়ী, এখন থেকে গ্রাহকরা ঋণের জন্য আবেদন করলে অন্যান্য প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টের সঙ্গে ‘অতিরিক্ত’ হিসেবে ভ্যাট রিটার্নের তথ্য যাচাই-বাছাই করতে হবে। অর্থাৎ ব্যাংক ঋণ অনুমোদনে ভ্যাটের তথ্য বাধ্যতামূলক করা হলো। এটি ছাড়া ঋণ দিলে এর জন্য দায়ী থাকবেন সংশ্নিষ্ট ব্যাংকের কর্মকর্তা। সম্প্রতি এনবিআরের অধীন ভ্যাট নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর থেকে বাংলাদেশ ব্যাংককে একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে। একই সঙ্গে সব বাণিজ্যিক ব্যাংক যাতে এ নির্দেশ পালন করে, সে বিষয়ে অনুরোধ করা হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে।

এনবিআর বলেছে, বেশির ভাগ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান একাধিক অডিট রিপোর্ট তৈরি করে। ওইসব রিপোর্টের গ্রহণযোগ্যতা ও স্বচ্ছতা নিয়ে অভিযোগ উঠেছে। এতে করে সরকারের রাজস্ব ফাঁকির পাশাপাশি ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে পড়ছে ব্যাংকগুলো। নতুন এ উদ্যোগের ফলে অনিয়ম কমবে এবং শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হবে আর্থিক খাতে। পক্ষান্তরে ব্যাংকাররা বলেছেন, এতে করে ঋণ অনুমোদন প্রক্রিয়ায় জটিলতা আরও বাড়বে, কালক্ষেপণ হবে। যা প্রকারান্তরে ব্যাংকের ওপর বাড়তি কাজের চাপ তৈরি করবে। এছাড়া ব্যবসায়ীরা হয়রানির আশঙ্কা প্রকাশ করেন।

জানা যায়, বর্তমানে কোনো গ্রাহক ব্যাংকের কাছে ঋণের জন্য আবেদন করলে ট্রেড লাইসেন্স, ভ্যাট নিবন্ধন সনদ, আর্থিক বিবরণী (অডিট রিপোর্ট), প্রজেক্ট প্রোপাইলসহ কমপক্ষে ৭/৮ ধরনের প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট লাগে। এগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ঋণ অনুমোদন করা হয়। এনবিআরের এই আদেশের ফলে নতুন করে ব্যাংকগুলোকে মাসিক ভ্যাট রিটার্নের তথ্য যাছাই-বাছাই করতে হবে। উল্লেখ্য, এনবিআরের আইন অনুযায়ী যোগ্য প্রত্যেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে প্রত্যেক মাসের ১৫ তারিখের মধ্যে ভ্যাট রিটার্ন জমা দিতে হয়, না দিলে জরিমানা গুনতে হয়। এতে সংশ্নিষ্ট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের আয়-ব্যয়সহ লেনদেনের তথ্য উল্লেখ থাকে।

যোগাযোগ করা হলে ভ্যাট নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সৈয়দ মুশফিকুর রহমান বলেন, ‘এখন থেকে ঋণ প্রস্তাব অনুমোদনের সময় অবশ্যই ভ্যাট রিটার্নে দেওয়া তথ্য ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে যাচাই-বাছাই করে দেখতে হবে। এটা করা হলে তথ্যের গরমিল সহজেই ধরা পড়বে। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে এ বিষয়টি শক্তভাবে তদারকির জন্য বলা হয়েছে।’ তিনি মনে করেন, একাধিক অডিট রিপোর্টের ফলে একদিকে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে, পাশাপাশি ব্যাংকের ঋণ অনুমোদনের ক্ষেত্রে ফাঁকি হয়। কারণ ঋণ পাওয়ার জন্য বেশির ভাগ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তাদের রিপোর্টে কারসাজি করে। এনবিআরের এ উদ্যোগের ফলে রাজস্ব আদায় বাড়বে। অন্যদিকে ব্যাংকগুলোর ঝুঁকি কমবে।

এনবিআর বলেছে, এখন থেকে সব সরকারি সংস্থার জন্য একই অডিট রিপোর্ট দিতে হবে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বিষয়টি নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে মুশফিকুর রহমান বলেন, ভ্যাট রিটার্নে লেনদেন দেখায় ১ কোটি টাকা। অন্যদিকে ব্যাংকের কাছে যেটা জমা দেওয়া হয়েছে তাতে উল্লেখ করা হয় ১০ কোটি টাকা। প্রকৃত তথ্য গোপন করার ফলে ব্যাংক বিপদে পড়ে। কেননা ব্যাংক মনে করে লাভজনক প্রতিষ্ঠান। ফলে ঋণ অনুমোদন করে দেয়। একটি প্রতিষ্ঠান একাধিক রিপোর্ট তৈরি করে, তা কীভাবে প্রমাণ করবেন, এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা ব্যাংকের কাছ থেকে রিপোর্ট আনব। সেটি আমাদের কাছে জমা দেওয়া রিপোর্টের সঙ্গে মিলিয়ে দেখব। এভাবে সংশ্নিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে ধরা যাবে। এতে ব্যাংকও বাঁচবে, সরকারও লাভবান হবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বেসরকারি মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনিস এ খান বলেন, ‘এনবিআরের নির্দেশনা বাস্তবসম্মত নয়। এতে করে ব্যাংকের ঋণ অনুমোদনের ক্ষেত্রে আরও জটিলতা তৈরি হবে। কাজের চাপ বাড়বে। এর মাধ্যমে ব্যাংকের কাঁধে দোষ চাপিয়ে ভ্যাট আদায় বাড়াতে চায় এনবিআর।’ একাধিক অডিট রিপোর্ট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটা তো গ্রাহকের ব্যাপার। গ্রাহকদের সৎ হতে হবে। তবে এটা ভালো প্রবণতা নয় বলে মনে করেন তিনি।

চিঠিতে যা বলা হয় : এনবিআর বলেছে, ভ্যাট কর্মকর্তারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বাণিজ্যিক কার্যক্রমের নিরীক্ষা পরিচালনা করার সময় প্রমাণ পেয়েছেন যে, অডিট রিপোর্টে লেনদেনের যে তথ্য প্রদর্শন করা হয়, তার সঙ্গে ভ্যাট বিভাগের দেওয়া তথ্যের সঙ্গে প্রায়ই গরমিল ধরা পড়ছে। এ ধরনের কার্যক্রমের ফলে আলোচ্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের প্রকৃত টার্নওভার অপ্রদর্শিত থেকে যাচ্ছে। এর ফলে সরকার প্রকৃত রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। চিঠিতে আরও বলা হয়, এ ধরনের কর্মকাণ্ড মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক্ক আইন-২০১২ এর পাশাপাশি ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং আইন-২০১৫ এর স্পষ্ট লঙ্ঘন। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এনবিআর বলেছে, শতভাগ রপ্তানিমুখী শিল্প ব্যতীত বাকি সব প্রতিষ্ঠানের ঋণ প্রস্তাব বিবেচনাকালে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো তাদের যাচাই-বাছাই কার্যক্রমের অতিরিক্ত হিসেবে ভ্যাট বিভাগে জমা দেওয়া রিটার্নের তথ্য অবশ্যই পরীক্ষা করতে হবে। রাজস্ব বোর্ড আরও বলেছে, যদি ব্যাংকে দাখিলকৃত অডিট রিপোর্টের তথ্য ও ভ্যাট বিভাগের রিটার্নের তথ্যের মধ্যে অসঙ্গতি বা কোনো গরমিল পাওয়া যায়, তা হলে অবশ্যই তা জানাতে হবে এনবিআরকে। তা না করে ঋণ অনুমোদন করলে এর জন্য সংশ্নিষ্ট ব্যাংকের কর্মকর্তারা দায়ী থাকবেন।
পিবিএ/এএম

আরও পড়ুন...