বিতর্কিত সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের (সিটিজেনশিপ অ্যামন্ডমেন্ট অ্যাক্ট অ্যান্ড রুলস- সিএএ) বাস্তবায়ন স্থগিতের নির্দেশ দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্দেশ্যে নোটিশ জারি করেছেন ভারতের সুপ্রিম কোর্ট। নোটিশের জবাব দিতে নয়াদিল্লিতে আসীন কেন্দ্রীয় সরকারকে তিন সপ্তাহ সময়ও বেঁধে দিয়েছেন সর্বোচ্চ আদালত।
ভারতের প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচুড়ের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের একটি বেঞ্চ মঙ্গলবার নোটিশটি জারি করে। বেঞ্চের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি জে.বি পারদিওয়ালা এবং বিচারপতি মনোজ মিশ্র।
পার্লামেন্টে পাস হওয়ার চার বছর পর, গত ১১ মার্চ দেশজুড়ে সিএএ কার্যকর করে কেন্দ্রীয় সরকারে আসীন বিজেপি; কিন্তু তার পরপরই বিজেপির এই পদক্ষেপের তীব্র সমালোচনা শুরু করে বিরোধী দলগুলো। পশ্চিমবঙ্গ ও কেরালার রাজ্য সরকার ইতোমধ্যে জানিয়েছে, রাজ্যে আইন বাস্তবায়ন করা হবে না। আইনটি স্থগিতের জন্য বিজেপিকে আল্টিমেটাম দিয়েছে তামিলনাড়ু, কর্ণাটকসহ দক্ষিণাঞ্চলের অন্যান্য রাজ্যগুলোও।
সুপ্রিম কোর্টের একটি সূত্র জানিয়েছে, ১১ মার্চ আইনটি কার্যকরের আদেশ দেওয়ার পর থেকেই সেটি স্থগিতের জন্য আপিল আসতে থাকে। এ পর্যন্ত অন্তত ২০টি আপিল জমা পড়েছে সুপ্রিম কোর্টে। এসব আপিলে স্বাক্ষর রয়েছে অন্তত ২৩৭ জন আবেদনকারীর।
মঙ্গলবার এসব আপিলের ওপর ওপরই শুনানি ছিল। শুনানিতে আবেদনকারীদের পক্ষের আইনজীবী ইন্দিরা জয়সিংহ মামলার নিষ্পত্তি হওয়ার আগ পর্যন্ত যেন কেন্দ্রীয় সরকার সিএএ বাস্তবায়ন স্থগিত রাখে— এমন আদেশ দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানান। বাদিপক্ষের আইনজীবী দলের অন্যতম সদস্য নিজাম পাশা বলেন, আইনটি পাসের পর থেকে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন ভারতের মুসলিমরা। তাদের মধ্যে এমন আশঙ্কা দেখা দিয়েছে যে বিজেপি সরকার ভারতীয় মুসলিমদের নাগরিকত্ব কেড়ে নিতে চায় এবং সিএএ হলো সেই পরিকল্পনার প্রথম ধাপ।
তবে বাদিপক্ষের এই যুক্তির পাল্টায় ভারতের শীর্ষ আইন কর্মকর্তা (সলিসিটর জেনারেল) তুষার মেহতা দাবি করেন, সিএএ’র মাধ্যমে কারো নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার উপায় নেই।
উভয়পক্ষের তর্ক ও যুক্তি উপস্থাপন শেষে সুপ্রিম কোর্ট ‘সিএএ কার্যকর করা কেন অবৈধ হবে না’ মর্মে কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্দেশে নোটিশ জারি করেন এবং জবাব দেওয়ার জন্য তিন সপ্তাহ সময় দেন। সেই সঙ্গে মামলার পরবর্তী শুনানির দিন হিসেবে আগামী ৯ এপ্রিল ধার্য করেন সর্বোচ্চ আদালত।
২০১৯ সালে পার্লামেন্টে সিএএ পাস করে তৎকালীন বিজেপি সরকার । এ আইন অনুযায়ী, ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং আফগানিস্তান থেকে হিন্দু, খ্রিস্টান, শিখ, বৌদ্ধ ও পার্সি সম্প্রদায়ের যেসব লোকজন সাম্প্রদায়িক নির্যাতন ও নিপীড়ণের মুখে টিকতে না পেরে ভারতে এসে আশ্রয় নিয়েছেন, তাদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে।
ভারতে প্রথমবার নাগরিকত্ব আইন পাস হয় ১৯৫৫ সালে। সেই আইন অনুযায়ী, বিদেশ থেকে ভারতে আসা যেসব ব্যক্তি বিগত ১৪ বছরের মধ্যে ১১ বছর ধরে ভারতে বসবাস করছেন এবং অন্তত ১ বছর টানা থেকেছেন, তারা ভারতের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করলে তা অনুমোদন করা হবে।
সিএএতে ১১ বছরের মেয়াদকালকে কমিয়ে ৫ বছরে আনা হয়েছে।
২০১৯ সালে আইনটি পাসের পর থেকে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বিক্ষোভ শুরু হয়। বিজেপিবিরোধী বিভিন্ন ভারতীয় দল ছিল সেই বিক্ষোভের নেতৃত্বে। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারে ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেসও সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের ব্যাপক বিরোধী।
উত্তর-পূর্ব ভারত থেকেই মূলত আপত্তি উঠেছিল সিএএ নিয়ে। অনেকেই আশঙ্কা করছেন, সিএএ কার্যকর হলে শরণার্থীদের ভিড় ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পাবে উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলিতে। তার ফলে ভাষাগত এবং সংস্কৃতিগত সমস্যা প্রকট হতে পারে। নিজেদের ভাষা এবং সংস্কৃতি রক্ষার স্বার্থেই অনেকে সিএএ বিরোধী আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন।
পাশাপাশি আইনে মুসলিমদের বাদ দেওয়া নিয়েও প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। শুধু তা-ই নয়, দক্ষিণ ভারতে সিএএ বিরোধিতার মূল কারণ, শ্রীলঙ্কা থেকে আগত তামিল উদ্বাস্তুদের বাদ দেওয়া।
সিএএ বিরোধিতাকারীদের অভিযোগ, আইনটি ভারতের সংবিধানের পরিপন্থী। কেননা, এ আইনে ধর্মীয় কারণে নাগরিকদের মধ্যে বৈষম্য করা হচ্ছে। তবে বিজেপির বক্তব্য, এই আইনে কারও নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হবে না; বরং যারা ধর্মীয় বৈষম্যের কারণে এ দেশে চলে এসেছেন, তাদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে।
২০১৯ সালে আইনটি পাস হওয়ার পর রাজধানী নয়াদিল্লিসহ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে দাঙ্গা হয়েছিল। এসব দাঙ্গায় প্রাণ হারিয়েছেন শতাধিক মানুষ।
সূত্র : টাইমস অব ইন্ডিয়া