ইসলামী আন্দোলনের আমিরের সঙ্গে বিএনপির মহাসচিবের বৈঠকে তাঁরা ‘ফ্যাসিবাদ বিরোধী শক্তিগুলো পরস্পর আঘাত করে কথা না বলা’সহ ১০টি বিষয়ে একমত হয়েছেন। বৈঠক শেষে মির্জা ফখরুল ইসলাম যৌথ সিদ্ধান্তগুলো পড়ে শোনান।
বৈঠকে সিদ্ধান্তগুলো হলো; আধিপত্যবাদ, সম্প্রসারণবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ মুক্ত স্বাধীন-সার্বভৌম টেকসই গণতান্ত্রিক কল্যাণ রাষ্ট্র গঠনে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা, দুর্নীতিবাজ, সন্ত্রাসী, খুনি ও অর্থ পাচারকারীদের দ্রুত বিচারের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা, ভোটাধিকারসহ মানবাধিকার রক্ষায় জাতীয় ঐকমত্য গড়ে তোলা, ন্যূনতম প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষ করে দ্রুত সময়ের মধ্যে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করা; দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ এবং অধিকার বঞ্চিত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে নিয়ে আসা।
এ ছাড়া বিএনপি মহাসচিব ও ইসলামী আন্দোলনের আমির ঐকমত্যে পৌঁছে ঘোষণা দেন যে, ‘আওয়ামী ফ্যাসিবাদ বিরোধী সব শক্তিকে নিয়ে দেশ পুনর্গঠনে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করব, ফ্যাসিবাদ বিরোধী শক্তিগুলো একে অপরের বিরুদ্ধে আঘাত করে কথা বলব না; আগামীতে যাতে আওয়ামী লীগের মতো আর কোনো ফ্যাসিবাদী শক্তি ক্ষমতায় আসতে না পারে, সে ব্যাপারে রাজনৈতিকভাবে ঐক্যবদ্ধ থাকব; ইসলামী শরিয়াহ্ বিরোধী কোনো সিদ্ধান্ত নেব না এবং ইসলাম বিরোধী কোনো কথা কেউ বলব না।’
বর্তমান প্রশাসনে বিদ্যমান আওয়ামী ফ্যাসিবাদের দোসরদের দ্রুত অপসারণ করার বিষয়েও দল দুটির শীর্ষ নেতারা একমত হয়েছেন।
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আজকে অত্যন্ত একতটা গুরুত্বপূর্ণ সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে ইসলামী আন্দোলনের আমির সৈয়দ রেজাউল করিমের সঙ্গে। এই আলোচনায় আমরা মোটামুটি যে বিষয়গুলোতে ঐকমত্যে পৌঁছেছি সেগুলো হলো এই।’
পরে সৈয়দ রেজাউল করিম বলেন, ‘দেশ, মানবতা এবং রাজনীতির ব্যাপারে আমাদের সঙ্গে যে আলোচনা হয়েছে, বিএনপির মহাসচিব যেগুলো উপস্থাপন করেছেন, সেটা আমাদের একই কথা। আমরা আলোচনান্তে এ বিষয়েগুলোতে ঐকমত্যে পৌঁছেছি এবং আমরা আপনাদের (গণমাধ্যম) সহযোগিতা কামনা করছি। আমরা যেন সুন্দর একটা দেশ ভবিষ্যতে গঠন করতে পারি, সে ব্যাপারে আপনাদের সহযোগিতা এবং আন্তরিকতাও আমরা চাচ্ছি।’
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে চরমোনাইয়ের পীর বলেন, ‘আমরা “দ্রুত সময়” শব্দটি ব্যবহার করেছি। এবং বেশি সময়টা না নিয়ে যৌক্তিক— সেই যৌক্তিক সময়টা আমরা বলেছি এক থেকে দেড় বছরের মধ্য। এ রকম একটা কথা আমরা বলেছি।’
সোমবার (২৭ জানুয়ারি) দুপুর সোয়া ১২টার দিকে বিএনপির মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর পুরানা পল্টনে ইসলামী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে যান। তিনি ইসলামী আন্দোলনের আমির ও চরমোনাইয়ের পীর সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করিমের সঙ্গে বৈঠক করেন। এ সময় বিএনপির মহাসচিবের সঙ্গে দলের ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লাহ উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা সেখানে চরমোনাইয়ের পীরের সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজে অংশ নেন।
ইসলামী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সহপ্রচার ও দাওয়াহবিষয়ক সম্পাদক শহিদুল ইসলাম কবির জানান, চরমোনাইয়ের পীর সৈয়দ রেজাউল করিমের সঙ্গে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন ইসলামী আন্দোলনের জ্যেষ্ঠ প্রেসিডিয়াম সদস্য সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানী, মহাসচিব মাওলানা ইউনুছ আহমাদ, প্রেসিডিয়াম সদস্য আশরাফ আলী আকন, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান ও যুগ্ম মহাসচিব ইমতিয়াজ আলম।
গতকাল রোববার ইসলামী আন্দোলনের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বিএনপির মহাসচিবের সঙ্গে বৈঠকের তথ্য জানানো হয়।
এর আগে ২১ জানুয়ারি জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান বরিশালে গিয়ে চরমোনাইয়ের পীরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। দুপুরে পীরের বাড়িতে তাঁরা মধ্যাহ্নভোজে অংশ নেন। ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে ভিন্নমত থাকলেও দুই দলের শীর্ষ নেতাদের ওই সাক্ষাৎ বা বৈঠকের ঘটনা দেশের ধর্মভিত্তিক ইসলামপন্থীদের রাজনীতিতে কৌতূহলের সৃষ্টি করে। এর এক সপ্তাহের মাথায় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম চরমোনাাইয়ের পীরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে তাঁর কার্যালয়ে গেলেন।
এর আগে ২২ জানুয়ারি খেলাফত মজলিসের আমির, মহাসচিবসহ ৯ সদস্যের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বিএনপির মহাসচিব ও দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান। খেলাফত মজলিস একসময় বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটের শরিক ছিল। ২০২১ সালের অক্টোবরে একটি ‘বিশেষ প্রেক্ষাপটে’ জোট ছেড়ে যায় তারা। ২২ জানুয়ারির বৈঠকটি ছিল প্রায় তিন বছর পর।
এই বৈঠকের পর বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়, ফ্যাসিবাদবিরোধী সব রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে ধর্মভিত্তিক ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়েছে তারা।
জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে জামায়াতসহ অন্য ইসলামি দলগুলোকে নিয়ে ঐক্যের চেষ্টা চলছে। গত ২৪ জানুয়ারি ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে দলীয় এক কর্মসূচিতে চরমোনাই পীর ও ইসলামী আন্দোলনের আমির বলেছিলেন, ‘আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইসলামের পক্ষে একক বাক্স দেওয়ার প্রচেষ্টা চলছে এবং এটি চলমান রয়েছে।’
ইসলামি দলগুলোর এমন তৎপরতার মধ্যেই বিএনপি শীর্ষ নেতৃত্ব দলগুলোর কারও কারও সঙ্গে বৈঠক শুরু করেছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এটাকে ইসলামি দলগুলোকে কাছে টানার চেষ্টার অংশ হিসেবে দেখছেন।