পিবিএ ডেস্ক: মুসলমানদের জন্য নতুন একটি মসজিদ নির্মাণে আলাদা জমি বরাদ্দ দিতে নির্দেশ দিয়েছেন ভারতের সুপ্রিম কোর্ট। প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ, শরদ অরবিন্দ বোরদে, এস আবদুল নাজির, অশোক ভূষন ও ধনঞ্জয় ওয়াই চন্দ্রচূড়কে নিয়ে গঠিত ৫ সদস্যের সংবিধান বেঞ্চ ঐক্যমতের ভিত্তিতে এই রায় ঘোষণা করেন।
সুপ্রিম কোর্ট তাদের রায়ে বিতর্কিত স্থানেই মন্দির গড়ার কথা বলেছেন। এজন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে মন্দির নির্মাণের জন্য তিন মাসের মধ্যে ট্রাস্ট গঠন করতে বলেছেন।
তবে সুপ্রিম কোর্ট রায়ে জানিয়েছেন, মুসলমানদেরর বঞ্চিত করা হবে না। তাদের অযোধ্যারই গুরুত্বপূর্ণ স্থানে মসজিদ নির্মাণের জন্য আলাদা ৫ একর জায়গা বরাদ্দ করা হবে। বিচারপতিরা সর্বসম্মতিক্রমে সুন্নী ওয়াকফ বোর্ড এবং নির্মোহী আখড়ার দাবি খারিজ করে দিয়েছেন।
প্রধান বিচাপতি বলেছেন, মসজিদটি ফাঁকা জায়গায় তৈরী হয়নি। এর নিচে কোন স্থাপনা ছিলো। তবে তা নির্দিষ্ট করে জানায়নি অর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া।
ভারতের স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ১০টায় রায় পড়া শুরু করেছিলেন রঞ্জন গগৈ। শুক্রবার সন্ধ্যাতেই চার বিচারপতির সঙ্গে মামলা নিয়ে আলোচনা করেছিলেন প্রধান বিচারপতি। তারপরই আজ আদালতের ছুটির দিন থাকা সত্ত্বেও মামলার রায় ঘোষণার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিলো।
রায়কে ঘিরে যাতে কোনও রকম অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি না হয়, সে কারণে উত্তরপ্রদেশ প্রশাসনের শীর্ষ আধিকারিকদের সঙ্গেও আইনশৃঙ্খলার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছিলেন প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ। বর্তমান প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ আগামী ১৭ই নভেম্বর অবসর নেবেন। তার আগেই তিনি এই রায় দেবেন বলে আগেই জানা গিয়েছিল। গত ৬ই আগস্ট থেকে প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈয়ের নেতৃত্বাধীন পাঁচ বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চে এই মামলার টানা ৪০ দিন শুনানি হয়েছে। শুনানির পর রায় সংরক্ষিত রেখেছিলেন প্রধান বিচারপতি।
প্রায় পাঁচশো বছর ধরে চলছিলো এই বিতর্ক। মহাকাব্যে বর্ণিত রামজন্মভূমিতে মসজিদ তৈরি হওয়ার পরে প্রায় সাড়ে ৩০০ বছর টানাপড়েন স্তিমিতই ছিলো। তবে মুঘল শাসন শেষ হয়ে ভারতে ব্রিটিশ রাজ প্রতিষ্ঠার পরই আইনি লড়াই শুরু হয়েছিল ফৈজাবাদের আদালতে। তারপর প্রায় ১৩৪ বছর কেটে গেছে। আজ শনিবার সুপ্রিম কোর্টের রায়ে সেই বিতর্কের অবসান ঘটল বলে মনে করা হচ্ছে।
১৫২৮ সালে মুঘল সম্রাট বাবরের সেনাপ্রধান মীর বাকী বাবরি মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। ১৮৮৫ সালে মহন্ত রঘুবীর দাস বাবরি মসজিদের বাইরে একটি শামিয়ানা খাটিয়ে রামলালার মূর্তি স্থাপনের দাবি জানান। ফৈজাবাদ কোর্ট সেই আবেদন খারিজ করে দেয়। এরপর ১৯৪৯ সালে মসজিদের মূল গম্বুজের নীচে রামলালার মূর্তি স্থাপন করা হয়। ১৯৫০ সালে জনৈক গোপাল সিমলা বিশারদ রাম লালার মূর্তি পূজার জন্য জানিয়ে ফৈজাবাদ জেলা কোর্টে আবেদন জানান। ১৯৫৯ সালে এলাকার অধিকার দাবি করে নির্মোহী আখড়া মামলা করে। ১৯৬১ সালে উত্তরপ্রদেশের সুন্নী ওয়াকফ বোর্ডও এলাকার অধিকার জানিয়ে পাল্টা আবেদন করে। তবে ১৯৮৬ সালের ১লা অক্টোবর স্থানীয় আদালত সরকারকে এক নির্দেশে হিন্দুদের পূজা করার অনুমতি দিয়ে রামলালা যেখানে রয়েছে তার গেট খুলে দিতে বলে। ১৯৮৯ সালে ভগবান শ্রী রামলীলা বিরাজমানের পক্ষে তার সখা এলাহাবাদ হাইকোর্টের সাবেক বিচারপতি দেওকী নন্দন আগরওয়াল আদালতে মামলা করেন। ১৯৯০সালের ২৫শে সেপ্টেম্বর অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মানের লক্ষ্যে বিজেপি নেতা লালকৃষ্ণ আদবানী গুজরাটের সোমনাথ থেকে দেশব্যাপী রথযাত্রা শুরু করেন। ১৯৯২ সালের ৬ই ডিসেম্বর বিজেপি নেতাদের নেতৃত্বে করসেবকদের একটি দল উন্মত্ততার সঙ্গে বাবরি মসজিদকে ধুলিসাৎ করে দেয়। ২০০২ সালের এপি লে এলাহাবাদ হাইকোর্টে বিতর্কিত স্থানের মালিকানা সংক্রান্ত মামলার শুনানি শুরু হয়েছিলো। ২০১০ সালের ৩০শে সেপ্টেম্বর এলাহাবাদ হাইকোর্ট ২:১ সংখ্যাধিক্যের রায়ে বিতর্কিত জমিকে সুন্নী ওয়াকফ বোর্ড, নির্মোহী আখড়া এবং রামলালার মধ্যে তিনভাবে ভাগ করার নির্দেশ দেয়। এরপরই সব পক্ষ সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করে। ২০১১ সালের (৯ মে সুপ্রিম কোর্ট অযোধ্যার ভূমি বিবাদ নিয়ে এলাহাবাদ হাইকের্টের রায়ে স্থগিতাদেশ দেয়। তবে ২০১৭ সালের ২১শে মার্চ সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি জে এস খেহার সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে নিয়ে কোর্টের বাইরে সমাধান খোঁজার কথা বলেন। ২০১৯ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্ট মধ্যস্থতার কথা জানায়। তিন সদস্যের মধ্যস্থতাকারী কমিটি তৈরি করে দেয়। তবে কমিটি মধ্যস্থতায় ব্যর্থ হওয়ার কথা জানানোর পর ২০১৯ সালের ৬ই আগস্ট সুপ্রিম কোর্ট অযোধ্যা ভূমি বিবাদ মামলার প্রতিদিন শুনানির কথা ঘোষণা করে। ১৬ই অক্টোবর শুনানি শেষে আদালত রায় সংরক্ষিত রেখেছিল।
এদিকে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে অযোধ্যাকে দুর্গে পরিণত করা হয়েছে। প্রায় ৪০ হাজার পুলিশকে আইনশৃঙ্খলা দেখার কাজে নিযুক্ত করা হয়েছে। জারি করা হয়েছে ১৪৪ ধারা। সব রাজ্যই বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করেছে বলে জানা গেছে। অযোধ্যা মামলার রায় নিয়ে সংযত মন্তব্য করতে সব রাজনৈতিক দলগুলিকে বার্তা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। মন্ত্রীদেরও তিনি কোনরকম বিতর্কিত মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকার কথা বলেছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এবং এসএমএসের মাধ্যমে রায় বেরোনোর পর যাতে কোনও রকম গুজব ছড়িয়ে পড়তে না পারে সেজন্যও ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। নিরাপত্তার ক্ষেত্রে নজরদারি করতে ড্রোণ ও বোম স্কোয়াডকে কাজে লাগানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। তৈরি রাখা হয়েছে দু’টি হেলিকপ্টারও।
পিবিএ/জেডআই