হিজরি সনের বার মাসের মধ্যে চারটি মাস অতি সম্মানিত। আরবের অন্ধকার যুগেও মাস চতুষ্টয়কে অত্যধিক সম্মানের দৃষ্টিতে দেখা হত। যুদ্ধ-বিগ্রহ থেকে শুরু করে সকল প্রকার অত্যাচার-অনাচার নিষিদ্ধ ছিল এ মাসগুলোতে। বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনা ও হাদিসের ভাষ্যের কারণে এই চারটি মাসের মধ্যে মহররমের মর্যাদা ও গুরুত্ব অপরিসীম। শুধু উম্মতে মুহাম্মদি নয় বরং পূর্ববর্তী অনেক নবী এবং উম্মতের বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনাবলী এ মাসে সংঘটিত হয়েছে।
মহররম মাস আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয় প্রিয়তম নবী (সা.) এর হিজরতের বেদনাবিধূর উপাখ্যান। এ মাসে ব্যথিত হৃদয়ে চোখের পানিতে বিদায় জানিয়ে ছিলেন প্রিয় জন্মভূমিকে।
মহররম অর্থ মর্যাদাপূর্ণ, তাৎপর্যপূর্ণ। এ মাস সম্পর্কে (যা আশহুরে হুরুমের অন্তর্ভুক্ত তথা নিষিদ্ধ মাস) পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট গণনায় মাসের সংখ্যা ১২। যেদিন থেকে তিনি সব আসমান ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। তন্মধ্যে চারটি হলো সম্মানিত মাস। (সুরা তাওবা: ৩৬)
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত, হাদিসে উল্লিখিত হয়েছে, নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেন, এক বছরে ১২ মাস। এর মধ্যে চার মাস বিশেষ তাৎপর্যের অধিকারী। এর মধ্যে তিন মাস ধারাবাহিকভাবে (অর্থাৎ জিলক্বাদ, জিলহজ ও মহররম) এবং চতুর্থ মাস মুজার গোত্রের রজব মাস। (বুখারি-৪৬৬২, মুসলিম-১৬৭৯)।
অপর হাদিসে রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, এ মাসে পৃথিবীর বহু ঐতিহাসিক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। এ দিনে আল্লাহ তায়ালা তার কুদরত প্রকাশ করেছেন। বনি ইসরাইলের জন্য সমুদ্রে রাস্তা বের করে দিয়েছেন এবং তাদেরকে নিরাপদে পার করে দিয়েছেন। আর একই রাস্তা দিয়ে ফেরাউন ও তার অনুসারী কিবতি সম্প্রদায়কে ডুবিয়ে মেরেছেন। (সহিহ বুখারি ১/৪৮১)
অন্যান্য মাসের ওপর মহররম মাস যেমন মর্যাদার শ্রেষ্ঠ, তদ্রুপ এ মাসের আমল অন্য মাসের আমলের চেয়ে অধিক ফজিলতপূর্ণ। হজরত আলী (রা.)-কে এক ব্যক্তি প্রশ্ন করেছিল, রমজানের পর আর কোনো মাস আছে, যাতে আপনি আমাকে রোজা রাখার আদেশ করেন? তিনি বললেন, এই প্রশ্ন রাসূলল্লাহ (সা.)-এর নিকট জনৈক সাহাবি করেছিলেন, তখন আমি তার খেদমতে উপস্থিত ছিলাম। উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘রমজানের পর যদি তুমি রোজা রাখতে চাও, তবে মুহাররম মাসে রাখ। কারণ, এটি আল্লাহর মাস। এ মাসে এমন একটি দিন আছে, যে দিনে আল্লাহ তায়ালা একটি জাতির তওবা কবুল করেছেন এবং ভবিষ্যতেও অন্যান্য জাতির তওবা কবুল করবেন।’ (জামে তিরমিযি ১/১৫৭)
অতএব, এ মাসে রোজা, তওবা-ইস্তেগফারসহ আমলের প্রতি যত্নবান হওয়া একান্ত কর্তব্য।
মহররম মাস সম্মানিত হওয়ার মধ্যে অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে আশুরা বা মহররমের দশ তারিখ। পৃথিবীর শুরু থেকে বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনা এ দিনে সংঘটিত হয়েছে। ফলে ইসলামি শরিয়তে কিছু দিনে যে স্বতন্ত্র আমলের কথা বলা হয়েছে, তন্মধ্যে আশুরা’র দিন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যবহুল।
হাদিসের ভাষ্যে নবীজি ইরশাদ করেন, হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, মহানবী (সা.) যখন হিজরত করে মদিনা পৌঁছেন, তখন তিনি দেখলেন যে মদিনার ইহুদি সম্প্রদায় আশুরার দিনে রোজা পালন করছে। তিনি তাদের জিজ্ঞেস করেন, আশুরার দিনে তোমরা রোজা রেখেছ কেন? তারা উত্তর দিল, এই দিনটি অনেক বড়। এই পবিত্র দিনে মহান আল্লাহ মুসা (আ.) ও বনি ইসরাইলকে ফিরআউনের কবল থেকে রক্ষা করেছিলেন আর ফিরআউন ও তার বাহিনী কিবতি সম্প্রদায়কে ডুবিয়ে মেরেছিলেন। এর কৃতজ্ঞতাস্বরূপ হজরত মুসা (আ.) রোজা রাখতেন, তাই আমরাও আশুরার রোজা পালন করে থাকি। তাদের উত্তর শুনে নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেন, হজরত মুসা (আ.)-এর কৃতজ্ঞতার অনুসরণে আমরা তাদের চেয়ে অধিক হকদার। অতঃপর তিনি নিজে আশুরার রোজা রাখেন এবং উম্মতকে তা পালন করতে নির্দেশ প্রদান করেন। (বুখারি-৩৩৯৭, মুসলিম-১১৩৯)
ইহুদিরাও আশুরার দিন রোজা পালন করত বিধায় মুসলমানদের জন্য আশুরার পূর্বের বা পরের দিন মিলিয়ে রোজা রাখতে আদেশ করেছেন, হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত ‘মহানবী (সা.) যখন আশুরার দিনে রোজা রাখেন এবং অন্যদেরও রোজা রাখার নির্দেশ প্রদান করেন, তখন সাহাবিরা অবাক হয়ে বলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! ইহুদি-নাসারারা তো এই দিনটিকে বড়দিন মনে করে। (আমরা যদি এই দিনে রোজা রাখি, তাহলে তো তাদের সঙ্গে সামঞ্জস্য হবে। তাদের প্রশ্নের উত্তরে রাসূল (সা.) বললেন, ‘তারা যেহেতু এ দিন একটি রোজা পালন করে) আগামী বছর ইনশাআল্লাহ আমরা এই ১০ তারিখের সঙ্গে ৯ তারিখ মিলিয়ে দুই দিন রোজা পালন করব। (মুসলিম-১১৩৪)
অপর হাদিসে বর্ণিত আছে, ‘তোমরা আশুরার রোজা রাখ এবং ইহুদীদের সাদৃশ্য পরিত্যাগ করে; আশুরার আগে বা পরে আরো একদিন রোজা রাখো। (মুসনাদে আহমদ ১/২৪১) অন্য হাদিসে নবী করিম (সা.) বলেন, ‘আমি আশাবাদী যে, আশুরার রোজার কারণে আল্লাহ তায়ালা অতীতের এক বছরের (সগীরা) গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন।’ (সহিহ মুসলিম ১/৩৬৭; জামে তিরমিযি ১/১৫৮)
মুসলিম শরিফের হাদিস থেকে প্রতীয়মান হয়, রমজান মাসের রোজা ফরজ হওয়ার আগে আশুরার রোজা উম্মতে মুহাম্মদির ওপর ফরজ ছিল। পরবর্তী সময়ে অবশ্যই ওই বিধান রহিত হয়ে যায় এবং তা নফলে পরিণত হয়। হাদিস শরিফে হজরত জাবের (রা.) সূত্রে বর্ণিত আছে- ‘রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাদের আশুরার রোজা রাখার নির্দেশ দিতেন এবং এর প্রতি উৎসাহিত করতেন। এ বিষয়ে নিয়মিত তিনি আমাদের খবরা-খবর নিতেন। যখন রমজানের রোজা ফরজ করা হলো, তখন আশুরার রোজার ব্যাপারে তিনি আমাদের নির্দেশও দিতেন না এবং নিষেধও করতেন না। আর এ বিষয়ে তিনি আমাদের খবরা-খবরও নিতেন না। (মুসলিম শরিফ-১১২৮) এই হাদিসের আলোকে আশুরার রোজার শ্রেষ্ঠত্ব প্রতীয়মান হয়। এমনকি ওই সময়ে তা ফরজ ছিল। বর্তমানে এই রোজা যদিও নফল, কিন্তু অন্যান্য নফল রোজার তুলনায় অধিক গুরুত্বপূর্ণ।
রাসূলুল্লাহ (সা.) এই রোজা নিজে রেখেছেন এবং উম্মতকে রাখার প্রতি উৎসাহিত করেছেন। আশুরার রোজার ফজিলত সম্বন্ধে নবীজি ইরশাদ করেন, ‘হজরত আব কাতাদা (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসূল (সা.)-কে আশুরার রোজার ফজিলত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, এই রোজা বিগত বছরের গুনাহ মুছে দেয়। (মুসলিম-১১৬২)
‘রাসূল (সা.) বলেন, ‘রমজান মাসের রোজার পর সর্বোত্তম রোজা আল্লাহর মাস মহররমের আশুরার রোজা।’ (সুনানে কুবরা-৪২১০) হাদিস শরিফে আশুরার দিনে রোজা পালন ছাড়া অন্য কোনো আমলের কথা বর্ণিত হয়নি।
মহররম মাসের নয় ও দশ তারিখে রোজা রাখাই হচ্ছে এই মাসের করণীয় সুন্নতি আমল। কিন্তু বর্তমানে মুহাররম আসলেই যে চিত্র দেখা যায় তার সঙ্গে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই। উপরোক্ত রোজা রাখার স্পষ্ট সহিহ হাদিসগুলোকে পাশ কাটিয়ে বানোয়াট কিছু হাদিস ও কাল্পনিক ইতিহাস রচনা করে আজ এই মুহাররম মাসে মনগড়া আমলের যে প্রথা চালু হয়েছে এর ন্যূনতম কোনো ভিত্তি নেই।
আশুরা’র দিন হুসাইন (রাযি.) এর শাহাদাতকে কেন্দ্র করে ভ্রান্ত শিয়া সম্প্রদায় ও নামধারী কিছু মুসলিম বিভিন্ন বিদআত ও শিরকি কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। তারা মনে করে আশুরা দিনের ফজিলত কেবল হুসাইন (রাযি.) এর শাহাদাতকে কেন্দ্র করে। তাদের এ ধারণা নিতান্তই ভুল ও অজ্ঞতাপ্রসূত। ইসলামে আশুরা রোজা প্রবর্তন হয় ২য় হিজরিতে, পক্ষান্তরে কারবালার প্রান্তরে হুসাইন (রাযি.) এর শাহাদাতবরণ করেন ৬১ হিজরিতে। অধিকন্তু, আশুরা দিনের ঐতিহ্য ও রোজার প্রচলন চলে আসছে প্রাচীনকাল থেকেই। অতএব, আশুরার সকল মাহাত্ম্য কেবল হুসাইন (রাযি.) এর শাহাদাতের কারণে, এ কথাটি কোরআন-হাদিসের ভাষ্যের সম্পূর্ণ বিপরীত।
তবে হিজরি ৬১ সালে নবী দৌহিত্র হুসাইন (রাযি.) এর আশুরার দিন কারবালার ময়দানে শাহাদাতের দুঃখজনক ঘটনা মুসলিম জাতির জন্য অতিশয় হৃদয়বিদারক ও বেদনাদায়ক। প্রতিবছর আশুরা আমাদের সেই মর্মান্তিক বেদনাবিধুর ঘটনা স্মরণ করিয়ে দেয়। কিন্তু বাস্তব কথা হলো, ইতিহাসে অমলিন এ ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণের পরিবর্তে এ দিনটিকে কেন্দ্র করে কিছু মানুষ বিশেষত শিয়া সম্প্রদায় ভ্রান্ত কর্মকাণ্ড ও কুসংস্কারে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। এ দিন তাজিয়া মিছিল, নিশানা, মার্সিয়া, ডাক-ঢোল পিটানো, বুক চাপড়িয়ে হায় হুসেন, হায় হুসেন বলে চিৎকার করা, কারবালার শহিদানগণ পিপাসার্ত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন বিধায় তাদের পিপাসা নিবারণের জন্য মানুষকে পানি পান করানো, বিশেষ রঙের শোকের পোশাক পরিধান করা, বাচ্চাদেরকে ভিক্ষুক বানানো, টেনে কাপড় ছিঁড়ে ফেলাসহ যাবতীয় কর্মকাণ্ড জাহিলিয়্যাতের কুপ্রথা ছাড়া কিছুই না। হুসাইন রাজিয়াল্লাহু আনহুর জন্য অথবা অন্য কারো জন্য শোক পালন ও মৃত্যু দিবস পালন করা বিদআত।
আশুরার দিনকে শিয়া সম্প্রদায় শোক পালনের দিন রূপে গ্রহণ করে আহাজারি, কান্নাকাটি এমনকি ছুরি ও তদ্রুপ ধারালো অস্ত্র দ্বারা শরীরে আঘাত করে রক্ত প্রবাহিত করে। অপর দিকে ওই দিনকে নাসেবি সম্প্রদায় যারা আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু ও তার বংশধরের প্রতি বিদ্বেষ রাখে তারা ঈদ বা খুশির দিন রূপে গ্রহণ করে বিভিন্ন অনুষ্ঠান যেমন; আলোক সজ্জা, খাওয়া দাওয়া, পটকা বাজি ইত্যাদি করে থাকে।
এই সকল মনগড়া শিরকি কর্মকাণ্ড সম্বন্ধে কোরআন ও হাদিসে কঠোর হুশিয়ারি উচ্চারিত হয়েছে। হুসাইন (রা.) এর শাহাদাতকে কেন্দ্র করে প্রচলিত জাহেলি কুসংস্কারকে পরিত্যাগ করে সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে দীনকে বিজয়ী করার লক্ষ্যে আদর্শের রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করাই হবে আশুরার দিনে কারবালার মূল শিক্ষা।
হুসাইনি আদর্শে শাণিত হোক আমাদের চেতনার ক্যানভাস। ঈমানি চারায় গজিয়ে উঠুক সুদৃঢ় শিখর। বিশ্বাসের পুরো উপত্যকা সিক্ত হোক হুসাইনি ত্যাগের মহিমায়। এটাই আশুরা ও কারবালার মূল শিক্ষা। এই শিক্ষাই হবে হুসাইন (রাযি.) এর আত্মত্যাগের সঠিক মূল্যায়ন।