পিবিএ,মহাদেবপুর (নওগাঁ): অবশেষে নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের প্রায় দুই কোটি টাকার প্রকল্পে অনিয়মের বিষয় তদন্ত হচ্ছে। বৃহস্পতিবার (১০ সেপ্টেম্বর) সকাল ১০ টায় তদন্ত কমিটি উপজেলা শিক্ষা অফিসে এর তদন্ত করবে। কিন্তু এই তদন্তের বিষয় কোন সাংবাদিককে জানানো হয়নি।
জানতে চাইলে নওগাঁ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার ইউসুফ রেজা জানান, বিষয়টি তদন্ত করার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের একজন উপ-পরিচালক বৃহস্পতিবার মহাদেবপুর আসবেন। পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশের জের ধরে তিনি বিষয়টি তদন্ত করবেন।
তিনি জানান, বৃহস্পতিবার তদন্তের জন্য উভয় পক্ষকে মহাদেবপুর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসে উপস্থিত থাকার জন্য অধিদপ্তর থেকে চিঠি দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, একটি পক্ষ মহাদেবপুর উপজেলা শিক্ষা অফিস সংশ্লিষ্টরা, আর অপর পক্ষ সাংবাদিক। দৈনিক জনকন্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে বলেও তিনি জানান। দৈনিক জনকন্ঠের নওগাঁর নিজস্ব সংবাদদাতা বিশ্বজিৎ সরকার মনি জানান, এখন পর্যন্ত তিনি এ সংক্রান্ত কোন চিঠি বা ফোন পাননি।
উল্লেখ্য, গত ২০ জুলাই পিবিএ এজেন্সিসহ বিভিন্ন জাতীয়, আঞ্চলিক সংবাদপত্র ও অনলাইন পোর্টালে এ সংক্রান্ত সংবাদ প্রকাশিত হয়।
প্রকাশিত সংবাদে বলা হয় : নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সংস্কার ও শহীদ মিনার তৈরির কোনো কাজ না করেই ‘শতভাগ প্রকল্প সম্পন্ন’ দেখিয়ে ভুয়া ভাউচার দাখিল করেছে শিক্ষা অফিস। পরে বরাদ্দের সব টাকা উত্তোলন করে রাখা হয়েছে শিক্ষা অফিসারের অ্যাকাউন্টে। উপজেলার ‘চতুর্থ প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি’ (পিইডিপি-৪) প্রকল্পে এভাবে ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এখন অফিসের কর্মকর্তারা উৎকোচের বিনিময়ে প্রতিষ্ঠান প্রধানসহ সংশ্লিষ্টদের প্রকল্পে অনিয়ম করার সুযোগ করে দিয়েছেন বলে একাধিক বিশ্বস্ত সূত্র জানা গেছে।
উপজেলা শিক্ষা অফিসারের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরে বিদ্যালয় মেরামত-সংস্কার ও শহীদ মিনার নির্মাণের জন্য ‘পিইডিপি-৪’ প্রকল্প নেওয়া হয়। এর আওতায় উপজেলার ৪৭টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ২ লাখ টাকা করে ৯৪ লাখ টাকা ও দুটি বিদ্যালয়ে দেড় লাখ টাকা করে ৩ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। এছাড়া ৭৮টি বিদ্যালয়ে রুটিন মেরামত কাজের জন্য প্রতিটিতে ৪০ হাজার টাকা করে ৩১ লাখ ২০ হাজার টাকা, ১০টি বিদ্যালয়ে ওয়াশ ব্লক নির্মাণ কাজের জন্য প্রত্যেকটিতে ২০ হাজার টাকা করে ২ লাখ টাকা এবং নিয়মিত মেরামত বাবদ স্লিপে ১৩৫টি বিদ্যালয়ের কোনোটিতে ৫০ হাজার টাকা ও কোনোটিতে ৭০ হাজার টাকা করে ২ কোটি টাকার বেশি বরাদ্দ করা হয়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, অর্থবছরের শুরুতেই এই অর্থ বরাদ্দ করা হলেও বিদ্যালয় নির্বাচন করতে সংশ্লিষ্টরা দীর্ঘ ১০ মাস সময় ব্যয় করে। অর্থবছর শেষ হওয়ার মাত্র দেড় মাস আগে বিদ্যালয়গুলোর তালিকা প্রকাশ করা হয়।
বিদ্যালয় সংশ্লিষ্টদের জানানো হয়, নিজের টাকায় প্রকল্পের কাজ শেষ করে ভাউচার দাখিল করতে হবে। গত ৩০ জুন এসব প্রকল্পের কাজ শেষ করার বিধান ছিল। কিন্তু এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত কোনো প্রকল্পের কাজই সমাপ্ত হয়নি।
এদিকে কোনো কোনো বিদ্যালয়ে কাজ শুরুই হয়নি। ২৩টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শহীদ মিনার নির্মাণের কথা থাকলেও একটিতেও শুরু হয়নি। কিন্তু তালিকাভুক্ত বিদ্যালয়গুলো থেকে কাজ ১০০ ভাগ সমাপ্ত হয়েছে বলে ভাউচার সংগ্রহ করা হয়েছে। এই ভুয়া ভাউচার দাখিল করে প্রকল্পের সব টাকা উত্তোলন করা হয়। এখন বরাদ্দের টাকা উত্তোলন করতে বিদ্যালয়গুলোর প্রধান শিক্ষক ও ম্যানেজিং কমিটির সভাপতিরা উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারের কাছে প্রতিদিন ধরনা দিচ্ছেন।
প্রকল্প তথ্যানুসারে, ফাজিলপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মহাদেবপুর মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ২ লাখ টাকা করে ৪ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সরেজমিনে দেখা যায় বিদ্যালয়ে দুটিতে এখন পর্যন্ত কোনো কাজ শুরু করা হয়নি। ফাজিলপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শহীদ মিনার নির্মাণ করার কথা থাকলেও কোনো শহীদ মিনারের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। জানতে চাইলে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা আইলোন নাহার বলেন, করোনার কারণে বিদ্যালয়ে যেতে পারছি না। আমাদের বিদ্যালয়ে একটি শহীদ মিনার নির্মাণ ও বিল্ডিং রং করার কাজ রয়েছে। কিন্তু এখনো কোন কাজ শুরু করতে পারিনি। শিক্ষা অফিসে ভাউচার জমা দিয়েছি।
জানতে চাইলে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মাজহারুল ইসলাম জানান, ৩০ জুনের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করতে না পারলে প্রকল্পের বরাদ্দ করা টাকা ল্যাপস হয়ে যাবে এবং তা ফেরত পাঠাতে হবে। তাই তিনি অগ্রিম ভাউচার সংগ্রহ করে প্রকল্পের সমুদয় টাকা উত্তোলন করে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারের অ্যাকাউন্টে জমা রেখেছেন। প্রকল্পগুলোর কাজ শেষ হলে সেখান থেকে বিল পরিশোধ করা হবে। কিন্তু এই পরিশোধ দেখানো হবে ব্যাকডেটে ৩০ জুনের মধ্যে।
তবে সরকারি নিয়মনীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে শিক্ষা অফিসার কীভাবে ভুয়া ভাউচার দাখিল করে শতভাগ কাজ সমাপ্তির বিল উত্তোলন করলেন, অর্থবছর শেষ হওয়ার তিন সপ্তাহ পরও বরাদ্দ করা টাকা স্কুলগুলোর মধ্যে বিতরণ না করে কিভাবে তিনি অ্যাকাউন্টে জমা রাখলেন তার কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি।
নওগাঁ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার ইউসুফ রেজা সাংবাদিকদের জানান, ৩০ জুনের পরে কোনোক্রমেই প্রকল্পের কাজ করা যাবে না। প্রকল্পের টাকা উত্তোলন করে শিক্ষা অফিসারের অ্যাকাউন্টে রাখা বিধিসম্মত নয়। তিনি জানান, ৩০ জুনের পর প্রকল্পের অব্যয়িত টাকা ল্যাপস হিসেবে গণ্য হবে এবং তা ফেরত যাবে।
স্থানীয় সুধীমহল বিষয়টি জরুরি ভিত্তিতে সুষ্ঠু তদন্ত করে অবৈধভাবে দাখিল করা ভুয়া ভাউচার গুলো সনাক্ত করে বাতিল করে প্রকল্পের অব্যয়িত টাকা ফেরত পাঠানোর দাবি জানিয়েছেন।
পিবিএ/ইউসুফ আলী সুমন/এসডি