পিবিএ,ঢাকা: গত ১ জানুয়ারি “বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সমিতির” পক্ষ থেকে র্যাব-২ এর নিকট অভিযোগ করা হয় একজন চিত্রনায়ককে গাজীপুর সদরের ভাওয়াল মাদকাসক্তি পুনর্বাসন কেন্দ্রে আটক রেখে নির্যাতন করা হচ্ছে। প্রাপ্ত অভিযোগের ভিত্তিতে র্যাব সদর দপ্তর ও র্যাব-২ এর গোয়েন্দা দল অভিযোগের সত্যতা পায়। গত ৪ জানুয়ারি বিকেলে র্যাব সদর দপ্তর গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-২’র আভিযানিক দল মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রতিনিধিসহ ভাওয়াল মাদকাসক্ত পুনর্বাসন কেন্দ্রে অভিযান পরিচালনা করে চিত্রনায়কসহ ২৮ জনকে উদ্ধার করতে সমর্থ হয়। অভিযান পরিচালনাকালে মাদকাসক্তি পূনর্বাসন কেন্দ্রে বিভিন্ন অনিয়ম পরিলক্ষিত হওয়ায় (১) ফিরোজা নাজনিন ওরফে বাঁধন (৩৫), (২) মনোয়ার হোসেন ওরফে সিপন (৩১), (৩) মোঃ রায়হান খান (২০), (৪) দিপংকর শাহ ওরফে দিপু (৪৪), (৫) জাকির হোসেন আনন্দ (২৭)-কে আটক করা হয় এবং তল্লাশীকালে ৪২০ পিস ইয়াবা (মাদকদ্রব্য), নির্যাতনে ব্যবহৃত লাঠি, স্টিলের পাইপ, হাতকড়া, রশি, গামছা, খেলনা পিস্তল ও কথিত সাংবাদিকের পরিচয়পত্র উদ্ধার করা হয়। তাৎক্ষনিকভাবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ভাওয়াল মাদকাসক্তি পুনর্বাসন কেন্দ্র এর কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়।
গ্রেফতারকৃত ফিরোজা নাজনিন ওরফে বাঁধনকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় যে, সে ২০০৯ সালে ভাওয়াল মাদকাসক্তি পুনর্বাসন কেন্দ্রটি অনুমোদনহীনভাবে প্রতিষ্ঠা করে যা পরবর্তীতে ২০১৩-২০১৪ সালে সাময়িক অনুমোদন প্রাপ্ত হয়। তিনি আরও দাবি করেন এই প্রতিষ্ঠানের মালিক তিনি নিজেই, যার কর্মী সংখ্যা ৪ জন এবং রোগীর সংখ্যা বর্তমানে ২৮ জন। তিনি যে ভবনটিতে থাকতেন সেটির ভাড়া বাবদ প্রতিমাসে ৪০,০০০/- টাকা বাড়ির মালিককে পরিশোধ করতেন। ভিকটিমদের সাথে কথা বলে র্যাব জানতে পারে যে, ফিরোজা নাজনিন ওরফে বাঁধন প্রতি রোগীর কাছ থেকে মাসিক চার্জ হিসাবে ১০,০০০-৩০,০০০/- টাকা করে আদায় করতেন। নিরাময় কেন্দ্রে ২ জন চিকিৎসক থাকার কথা বললেও কোন চিকিৎসককে সেখানে পাওয়া যায়নি। সেখানে ২০ জন রোগীর চিকিৎসার অনুমোদন থাকলেও ২৮ জন রোগী পাওয়া যায়।
ভাওয়াল মাদকাসক্ত পুনর্বাসন কেন্দ্রের বিরুদ্ধে বেশকিছু গুরুতর অভিযোগ পাওয়া যায়। উদ্ধারকৃত ভিকটিমদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, যেভাবে নিরাময় কেন্দ্র পরিচালনা করার কথা, চিকিৎসা দেওয়ার কথা, রোগীদের সেবা করার কথা তার ব্যাপক অনিয়ম এখানে পাওয়া যায়। নিরাময় কেন্দ্রের মালিক ফিরোজা নাজনিনের বিরুদ্ধে ভিকটিম এবং ভিকটিমদের আত্মীয় স্বজনদের নিকট থেকে অভিযোগ পাওয়া যায় যে, নিরাময় কেন্দ্রে রোগীদেরকে চিকিৎসার নামে শারীরিক নির্যাতন, মানসিক নির্যাতন ও যৌন হয়রানি করা হতো। এখানে চিকিৎসার নামে রশির সাহয্যে ঝুলিয়ে শারীরিক নির্যাতন করা হতো। ভিকটিম ও কর্মচারীরা জানায় যে, এখানে খাবারের মান অত্যন্ত নিম্মমানের ছিলো । তাছাড়া মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর কর্তৃক যে সকল নির্দেশনা দেওয়া ছিল তার অধিকাংশই এখানে পওয়া যায়নি এবং নিরাময় কেন্দ্রে সবসময় ডাক্তার থাকার কথা থাকলেও তা অনুপস্থিত ছিল। উপরন্তু গ্রেফতারকৃত নিরাময় কেন্দ্রের মালিক এবং কর্মচারীদের তৎক্ষণাৎ র্যাপিড ডোপ টেস্টের মাধ্যমে প্রমান পাওয়া যায় তারা সকলেই মাদকাসক্ত।
উদ্ধারকৃত চিত্রনায়কের এই মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রে আসার বিষয়ে জানা যায়, করোনাকালীন সময়ে চলচ্চিত্রের কার্যক্রম স্থবির থাকায় অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের কারনে তিনি কিছুটা মানসিকভাবে বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়েন। এ সময় তিনি নিয়মিত ঘুমের ঔষধ সেবন শুরু করলে তার আচরণে কিছুটা অস্বাভাবিকতা পরিলক্ষিত হওয়ায় ২০২১ সালের মার্চ মাসে তার মা চিকিৎসার জন্য তাকে ভাওয়াল মাদকাসক্ত পুনর্বাসন কেন্দ্রে নিয়ে আসেন। মালিক বাধঁনের কথামত তার মা তাকে সেখানে ভর্তি করান এবং তার চিকিৎসা বাবদ ০৩ লক্ষ টাকা পরিশোধ করেন। পরবর্তীতে প্রতি মাসে ৪০ হাজার টাকা চিকিৎসা খরচ বাবদ প্রদান করেন। মূলত চিকিৎসার নামে তাকে আটকে রেখে প্রতিমাসে মোটা অংকের টাকা আদায় করাই ছিলো উক্ত প্রতিষ্ঠানের মূখ্য উদ্দেশ্য।
রোগীর অভিভাবকদের নিকট রোগীর অবস্থা শোচনীয় মর্মে উপস্থাপন করে অধিক পরিমান অর্থ আদায় করাই ছিল মালিক বাঁধনের মূখ্য উদ্দেশ্য। একই সাথে ভাওয়াল মাদকাসক্ত পুনর্বাসন কেন্দ্রে মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রের নামের আড়ালে মাদক ব্যবসা পরিচালনা করা হতো। এলাকায় মাদক গ্রহিতারা উক্ত প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের নিকট হতে মাদক সংগ্রহ করত।
গ্রেফতারকৃত ফিরোজা নাজনিন ওরফে বাঁধন ২০০৯ সালে ভাওয়াল মাদকাসক্ত পুনর্বাসন কেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠা করে। তার গ্রামের বাড়ি লালমনিরহাট। তার প্রথম স্বামীর সাথে ডিভোর্স হওয়ার পর মনোয়ার হোসেন ওরফে সিপনের সাথে দ্বিতীয় বিবাহ সম্পন্ন হয় বলে সে জানায়। সিপন তার সাথে মাদক নিরাময় কেন্দ্রে বসবাস করত। কিন্তু তাদের বিবাহের কোন বৈধ নথিপত্র সে দেখাতে পারেনি। সে একটি ভুঁইফোড় প্রত্রিকার সাংবাদিক হিসেবে মিথ্যা পরিচয় দিয়ে এলাকায় প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করত।
গ্রেফতারকৃত মনোয়ার হোসেন ওরফে সিপন এর গ্রামের বাড়ি গাজীপুর। গ্রেফতারকৃত ফিরোজা নাজনিন ওরফে বাঁধনের প্রধান সহযোগী হিসেবে কাজ করত। সিপন ২০১৬ সালে অস্ত্র মামলায় গ্রেফতার হয়। তার বিরুদ্ধে সর্বমোট ২টি মামলা রয়েছে। সে মূলত মাদক নিরাময় কেন্দ্রের চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের শারিরিকভাবে নির্যাতন করত এবং নিরাময় কেন্দ্রের ঘটনাসমূহ কাউকে না বলার জন্য ভিকটিমদের ধারালো অস্ত্র দিয়ে খুন ও জখম এর ভয়ভীতি প্রদর্শন করত। সিপন উদ্ধারকৃত ভিকটিমদের যৌনহয়রানির মত গুরুতর অপরাধে নাজনিনকে সহায়তা করত।
গ্রেফতারকৃত দিপংকর শাহ ওরফে প্রোগ্রামার দিপু দীর্ঘ ১০ বছর যাবত উক্ত নিরাময় কেন্দ্রের মালিক নাজনিনের প্রধান সহকারী হিসেবে কাজ করত। সে পূর্বে উক্ত নিরাময় কেন্দ্রে মাদকাসক্তির কারণে ১০ মাস চিকিৎসা গ্রহণ করেন। অন্যান্য ভলেন্টিয়ারদের সাথে নিয়ে সে বিভিন্ন জায়গা থেকে পরিকল্পিতভাবে ভিকটিমদের অভিভাবকদের উন্নত চিকিৎসার প্রলোভন দেখিয়ে রোগীদের ভাওয়াল মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে নিয়ে আসতো। সেখানে তাদের অন্যায়ভাবে আটক রেখে করে রাখত, শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করত। অভিভাবকদের নিকট হতে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করত এবং জোরপূর্বক নিজের ইচ্ছামত তাদের চিকিৎসা প্রদান করত।
গ্রেফতারকৃত মোঃ রায়হান খান ও জাকির হোসেন আনন্দ ছিল মাদক নিরাময় কেন্দ্রের যথাক্রমে সহকারী ও ভলেন্টিয়ার। তার দিপংকর শাহ ওরফে দিপু এর অনুমতিতে বিভিন্ন জায়গা থেকে ভিকটিমদের জোরপূর্বক মাদক নিরাময় কেন্দ্রটিতে ধরে আনার কাজে সরাসরি অংশগ্রহণ করত। নিরাময় কেন্দ্রটির মালিক নাজনিন ও দিপংকর এর নির্দেশে রোগীদের শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করত। গ্রেফতারকৃত আসামীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।