মানবিকতায় বিত্তবান


জীবন পাল : তিনি কিন্তু বিত্তবানদের তালিকায় পড়েন না। অথচ যে কাজটি তিনি করছেন সেটা বিত্তবানদের করা উচিত ছিল। উনার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছোট হলেও মনটা কিন্তু অনেক বড়। বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে নিজের অবস্থান থেকেই যতটুকু পারছেন ততটুকু করে যাচ্ছেন। বলছি মোঃ সোলাইমানের কথা। যিনি নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রকৃত অসহায় হয়ে পড়া মানুষদের পাশে দাড়িয়েছেন,দাড়াচ্ছেন ।

অথচ সামর্থ্য থাকা স্বত্তেও অনেকে আছেন যাদের মানবতার বুলিটা শুধুমাত্র ফেসবুকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে। ঐসব মানুষের মুখে মানবিকতার কথা শুনলে ইচ্ছে হয় সোলাইমান ভাইয়ের মত সকলের অগোচরে করে যাওয়া মানুষদের এইসব মানবিক কাজগুলো দেখিয়ে বলতে- আসলে এগুলোই মানুষের প্রকৃত মানবিকতার উদাহরণ। এর মধ্যেই হয়তো মানবসত্তার প্রকৃত স্বার্থকতা লুকায়িত।

এরকম মানুষদের সাথে কার কিরকম সম্পর্ক আমি জানি না। তবে এমন মানসিকতার মানুষ আসলে অন্য ৮/১০ জনের থেকে অনেকটাই আলাদা হয়ে থাকে। ইদানীং ফেসবুকে কাউকে নিয়ে লেখার ধারাটা খুব একটা ভাল পর্যায়ে নেই বললে চলে। কেননা- নিজেকে পাবলিশিটি করার জন্য একশ্রেণীর মানুষ রয়েছে যারা ১০০ গ্রাম শুটকি সহায়তা করেও ছবি তুলে বিশাল সহযোগির কাতারে নিজেকে নিয়ে প্রচারে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বর্তমান সমাজে এই শ্রেনীর সংখ্যাটি কিন্তু ৪ ভাগের সাড়ে ৩ ভাগ।

হয়তো লেখাটি পড়ে অনেকের কাছে মনে হতে পারে এই মানুষটিও নিজেকে তুলে ধরতে এরকম করছেন। কিন্তু দেখলাম তিনি তা করেননি,করছেন না। আমিও বিষয়টি জানতাম না। যখন দেখলাম আমার পাড়ার দুইটি পরিবার বর্তমান পরিস্থিতির ছোবলে পড়ে প্রকৃত অর্থেই অসহায় হয়ে পড়েছেন তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সহযোগিতায় বিষয়টি জানতে পেরে তাদের পাশে দাড়িয়েছেন। এ ঘটনাটি কানে আসার পর খবর নিয়ে জানলাম এই মহামারীকালীন সময়ে কর্মহীন অসহায় হয়ে পড়া অনেককেই তিনি সকলের অগোচরে এখন পর্যন্ত নিজের সামর্থ অনুযায়ী সহযোগিতা করেছেন।
অনেকে আবার ভাবতে পারেন এখানে হয়তো আমার ব্যক্তিগত কোন স্বার্থ রয়েছে। এসব ভাবাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কেননা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এরকমটা অহরহ দেখা যাচ্ছে। নিজের স্বার্থ হাসিলে দুর্নীতিগ্রস্থ মানুষটাকেও ধোয়া তুলসীপাতা বানিয়ে উপস্থাপন করা হচ্ছে। যা তুলে ধরার কথা বা যা নিয়ে লেখার কথা সেটা এড়িয়ে যাওয়াটা আমাদের একটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। তাই বললাম- নেগেটিভ চিন্তাটা মনে আসতেই পারে। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে এই মানুষটির সাথে আমার সম্পর্কটা দীর্ঘদিনের। তাও আবার সুসম্পর্ক,ভাল সম্পর্ক যাকে বলা হয়। তবে এটাও বলে রাখি- সবাই যে সব দিক থেকে কিংবা সবার কাছে ভাল হতে হবে এমন নয়। একেক মানুষের কাছে একেক দিক ভাল লাগে। তেমনি এই মানুষটির কিছু কিছু দিক আমার অনেক ভাল লাগে। হয়তো আমারও অনেক দিক আছে যেটা কারোও পছন্দ না। আবার দেখা যাবে অনেকের অপছন্দের দিকটাই অন্য কারো ভাল লাগে। সবকিছুই আসলে চিন্তাধারার বিষয়। যেমন আমি লিখলাম এক চিন্তায়,আর অনেকে তা পড়লো অন্য চিন্তায়।এটা হওয়াটাও কিন্তু স্বাভাবিক।
তবে এই মানুষটির এসব কাজ দেখে আমার অনেক ভাল লেগেছে। যদি আমার নিজের এলাকার কথা বলি তাহলে বলবো আমার এলাকাতেও অনেক সামর্থ্যবান আছেন যারা চাইলেই এই এলাকার প্রকৃত অসহায় হয়ে পড়া পরিবারের পাশে গিয়ে দাড়াতে পারতেন। কিন্তু তাঁরা তা করছেন না। উচ্চাভিলাষী জীবন আর শৌখিনতার কারণে তাঁরা তাদের মানবিক মানসিকতাকে হয়তো বিসর্জন দিয়েছেন।

কিন্তু অবাক লাগে যখন দেখি তাঁরাই আবার ভাল ভাল জায়গায় গিয়ে নিজেদের ভাল মানুষের কাতারে মিশিয়ে সকলকে মানবিক হওয়ার আবেদন জানিয়ে থাকেন।

আমি এমনও দেখেছি- ছেলের গরীব বন্ধুটির সঙ্গ ত্যাগ করে নিজেদের সমতুল্য কিংবা বিত্তবান পরিবারের সন্তানকে বন্ধু বানানোর শিক্ষা দিয়েছেন স্বয়ং শৌখিন জীবন কাটাতে পছন্দ করা এক মা। সেই মা আবার তার সন্তানকে অভ্যস্থ করেছেন বাউণ্ডুলে জীবনের।

আমি এমন সামর্থ্যবানদের দেখেছি- যারা মানুষের অসহায়ত্বের বিষয় নিয়ে তাদের আড্ডার মজার খোরাক বানাতে। দু’বেলা দুমুঠো খাবার না পাওয়া মানুষটির সামনেই প্রতিদিন বেঁচে যাওয়া খাবার ফেলে দিতে দিতে নিজেদের সাবলম্বী ও সামর্থ নিয়ে বড়াই করতে।

আমাদের আশেপাশে এখনো বিত্তবানদের এরকম চেহারা প্রতিনিয়ত দেখা যায়। অথচ তাঁরাই আবার সমাজের সম্মানিত আসনে বসে শিক্ষা দিচ্ছেন ভাল মানুষ হবার।মানুষের মত মানুষ হবার। কি হাস্যকর বিষয় তাই না?

আমি আপনি এসব নিয়ে অট্টহাসি দিলেও কারো কোন যায় আসেনা। সমাজটা এরকমই চলবে। প্রকৃত মানুষরা অবহেলায় অবহেলিত হবে। আর প্রচার পাগলরা ‘প্রচারে প্রসার’ নীতিতে অনুসরণ করে এগিয়ে যাবে অদূর পথপানে। নয় ছয় করে হলেও পাড়ি দিবে সম্মানের সুউচ্চ পর্বত। আর অসহায় দরিদ্র শ্রেণী অসাধারণ মেধার অধিকারী হওয়া স্বত্বেও অবজ্ঞা, অবহেলায় ছিটকে পড়তে থাকবে জীবনের প্রতিটি ধাপে। আর একটা সময় ছিটকে পড়ে হয়ে যাবে বিলীন।

তারপরও এতসব অমানুষের ভীড়ে থেকে যাবে এরকম কিছু মানবিক মানুষ। যারা জন্মের পর থেকেই শিক্ষা পেয়ে থাকে নিজেদের মানসিকতাকে এরকম মানবিক করে গড়ে তোলার। যাদের মনে সব সময় কামিনী রায়ের সুখ কবিতার এ লাইনগুলো লালিত হয়ে থাকে-
‘পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি
এ জীবন মন সকলি দাও,
তার মত সুখ কোথাও কি আছে ?
আপনার কথা ভুলিয়া যাও।’

লেখক : প্রাবন্ধিক

আরও পড়ুন...