পিবিএ, বিশ্ব ডেস্ক– চার বছর আগে, নাওকো ও তাকাউকি আইডা দম্পতিকে থাকার জন্য একটি বাড়ি দেয় সরকার। একদম বিনা মূল্যে। টোকিওর কাছে ছোট্ট একটি শহর ওকুতামায় নির্জন ছায়াঘেরা এলাকায় প্রশস্ত দোতলা একটি বাড়ি থাকার জন্য পান তাঁরা। বাড়িটি পাওয়ার আগে তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে নাওকো নিজের বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকতেন।
৪৫ বছরের নাওকো জানান, নতুন বাড়িটির অনেক মেরামত করতে হয়। তবে ব্যস্ততম টোকিওর চেয়ে শান্ত ছায়াঘেরা একটি এলাকায় বাড়ির স্বপ্ন দেখতেন তিনি, যে বাড়ির সামনে থাকবে বড় বাগান।
এমনি এমনি একটা বাড়ি দিচ্ছে—বিষয়টিতে যেকেউ রহস্য বা ধোঁকার গন্ধ পেলেও জাপানিদের জন্য বিষয়টি নতুন কিছু নয়। জাপানের বর্তমান আর্থসামাজিক অবস্থায় এমনটা হয়েই থাকে। পরের জায়গা পরের জমি হলেও নিজের করে নেওয়া সম্ভব।
জাপান পলিসি ফোরামের ২০১৩ সালের তথ্য অনুযায়ী, জাপানে ৬ কোটি ১০ লাখ বাড়ির বিপরীতে পরিবার আছে ৫ কোটি ২০ লাখ। ২০১৩ সালের পর অবস্থা আরও বেশি খারাপ হয়েছে। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব পপুলেশন অ্যান্ড সোশ্যাল সিকিউরিটির তথ্য অনুযায়ী, ২০৬৫ সাল নাগাদ জাপানের জনসংখ্যা ১২ কোটি ৭০ লাখ থেকে কমে ৮ কোটি ৮০ লাখ হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। শিক্ষা, চাকরির জন্য বেশির ভাগ তরুণই গ্রাম ছেড়ে শহরের পথে পাড়ি জমাচ্ছেন। বেশির ভাগ মানুষই হয় একদম নামমাত্র মূল্যে অথবা একেবারে বিনা মূল্যে ছেড়ে দিচ্ছেন নিজেদের থাকায় জায়গাটা। ফলে গ্রামাঞ্চলগুলো খালি হয়ে পড়ছে। মাঝেমধ্যে গ্রামের বাসাগুলো দেখলে মনে হয় যেন ভূতের আড্ডাখানা। এই খালি সম্পত্তিগুলোকে জাপানিরা নাম দিয়েছেন ‘আকিয়া’।
এসব আকিয়া সম্পত্তির গতি করতে বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে অঞ্চল ভিত্তিতে। এমনকি বিদেশি নাগরিকদের জন্যও এখানে থাকার সুযোগ দিচ্ছে জাপান। তাই বলা যায়, সিডনি, মেলবোর্ন, ক্যানবেরার মতো উন্নত শহরে থাকতে চাইলে জাপানে থাকার কথা ভাবতে পারেন বিদেশিরা।
এমনিতে বেশ কয়েক বছর ধরে জন্মহার কমার পাশাপাশি বয়স্ক জনগোষ্ঠীর সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে দেশটিতে। জাপানে প্রতিবছর জন্ম-মৃত্যুর ব্যবধান চার লাখ। জীবন-প্রত্যাশা ৮৪ বছর পর্যন্ত, যা পৃথিবীর যেকোনো দেশের চেয়ে বেশি। ৬৫ বা তার চেয়ে বেশি বয়সের জনসংখ্যা ২৮ দশমিক ১ শতাংশ। জাতিসংঘের হিসাবে জাপানের এই সংখ্যা বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ, যা ইতালিতে ২৩ দশমিক ৩ শতাংশ, পর্তুগালে ২১ দশমিক ৯ শতাংশ এবং জার্মানিতে ২১ দশমিক ৭ শতাংশ, যুক্তরাষ্ট্রে ১৫ ও ভারতের ৬ শতাংশ। জাপানের শতবর্ষী বা তার বেশি মানুষের সংখ্যা বর্তমানে ৬৯ হাজার ৭৮৫ জন। দুই দশক আগের চেয়ে যা সাত গুণ বেশি।
জনসংখ্যা কমে যাওয়ায় আশঙ্কা করা হচ্ছে, ২০৪০ সাল নাগাদ প্রায় ৯০০ শহর ও গ্রামের অস্তিত্ব থাকবে না জাপানে; ওকুতামা তেমনই একটি শহর। ওকুতামার মতো শহরে সম্পদ ছেড়ে দিয়ে শহরমুখী হচ্ছে মানুষ বেঁচে থাকার তাগিদেই।
ওকুতামাকে আবারও জনবহুল করার কাজে নিয়োজিত সরকারি বিভাগ ওকুতামা ইয়ুথ রেভিটালিজেশনের (ওওয়াইআর) কর্মকর্তা কাজুতাকা নিজিমা বলেন, ‘২০১৪ সালে আমরা আবিষ্কার করলাম, ২০৪০ সাল নাগাদ টোকিওর যে তিনটি এলাকা হারিয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করছি, তার মধ্যে ওকুতামা আছে।’
অথচ ৫০ বছর আগেও এমনটি ভাবা যায়নি। ১৯৬০ সালে প্রায় ১৩ হাজার মানুষ বাস করত ওকুতামায়। এখানের কাঠের ব্যবসা বেশ লাভজনক ছিল। কিন্তু ১৯৯০ সালের দিকে আমদানির কাঠামো পরিবর্তন ও কাঠের চাহিদা কমে যাওয়ায় তরুণেরা জীবনের তাগিদে এলাকা ছাড়তে থাকেন। বর্তমানে ওকুতামার জনসংখ্যা মাত্র ৫ হাজার ২০০ জন। খালি পড়ে আছে অসংখ্য ঘর।
সমস্যা মোকাবিলায় ২০১৪ সালে তরুণ পুনরুজ্জীবিতকরণ বিভাগের পক্ষ থেকে ‘আকিয়া ব্যাংক’ বা ‘খালি ঘর প্রকল্প’ চালু করা হয়। এই প্রকল্পের মাধ্যমে বিক্রেতাদের সঙ্গে বাড়ির বৃদ্ধ মালিক বা খালি সম্পত্তির একটি যোগসূত্র তৈরি করে দেওয়া হয়। ‘আকিয়া ব্যাংক’ ধারণা, এখন জাপানের অনেক অঞ্চলেই দেখা যায়। প্রতিটি শহর নিজস্ব শর্ত নির্ধারণ করে নিজেদের মতো করে এই স্কিম চালু রেখেছে।
এমনকি পুরোনো খালি বাড়ি যাঁরা কিনছেন, তাঁদের মেরামতের জন্য ভর্তুকিও দিচ্ছে ওকুতামা কর্তৃপক্ষ। মজার বিষয় হচ্ছে, আকিয়া মালিকদের বাড়ি মেরামতে প্রতি ১০০ বর্গফুটে ৮ হাজার ৮২০ ডলার প্রদান করে ওকুমাতা। তবে কিছু শর্ত দেওয়া হয়, যেমন: ১. যাঁরা বিনা মূল্যে বাড়ি বা মেরামত করার অর্থ পাবেন, তাঁদের বয়স অবশ্যই ৪০ বছরের নিচে হতে হবে। ২. অথবা এমন দম্পতি হতে হবে, যাঁদের অন্তত ১৮ বছরের নিচে একটি সন্তান রয়েছে। ৩. তা না হলে স্বামী-স্ত্রী দুজনের মধ্যে একজনের বয়স ৫০ বছরের নিচে হতে হবে। অবশ্য এত কিছু করেও সমস্যা মোকাবিলা করা বেশ কঠিনই রয়েছে। কারণ, যেখানে মানুষের চেয়ে বাড়ি বেশি, সেখানে নতুন বাড়ি কেনাই খুব সহজ।
ওকুতামায় এখন তিন হাজার বাড়ি হয়েছে, যার মধ্যে ৪০০ বাড়িই খালি। এই ৪০০ বাড়ির মধ্যে অর্ধেক মেরামত করে ঠিকঠাক করা সম্ভব। বাকিগুলো খুবই ঝুঁকিপূর্ণ, একেবারে ব্যবহারের অযোগ্য। বিংশ শতাব্দীতে দুবার জনসংখ্যা বৃদ্ধির মুখোমুখি হয় জাপানে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এবং ১৯৮০ সালের দিকে। ১৯৮০-এর দশক পর্যন্ত জাপানের সার্বিক অর্থনৈতিক বিকাশকে বলা হয় জাপানের যুদ্ধোত্তর অর্থনৈতিক বিস্ময়। এ সময় জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় থাকার বাড়ির ঘাটতি তৈরি হয়। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলোতে সস্তা বাড়ি তৈরি করা হয়। ওই সব বাড়ির মানও খুব খারাপ ছিল। ফলে ৮৫ শতাংশ মানুষই বিকল্প নতুন বাড়ি খুঁজে নেন।
২০১৫ সালে সরকার আইন করে যে যাঁরা বাসা খালি করে অন্য কোথাও চলে যাবেন, তাঁদের অর্থদণ্ড দিতে হবে। অর্থাৎ হয় বাড়ি ধ্বংস করতে হবে নতুবা নতুন করে ঠিক করে নিতে হবে। ওই সময় থেকে খালি জমির চেয়ে খালি বাড়ির কর বেশি নির্ধারণ করে সরকার।
‘আকিয়া প্রকল্প’ কেবল জাপানি নাগরিকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, চলতি বছরের শুরুতে ফিলিপাইনের একটি পরিবার ওকুতামাতে থাকতে শুরু করেছে। স্বামী-স্ত্রী ও ছয় সন্তান নিয়ে পরিবারটি আগে টোকিও শহরে ছিল।
ওই পরিবার জানায়, টোকিওতে তারা খুব ভালো ছিল না। কিন্তু টোকিওর কাছে থাকা জরুরি ছিল। তাই প্রকৃতিঘেরা এই বাড়ি তাদের খুব পছন্দ হয়েছে।
বরাবরই বিদেশি নেওয়ার ব্যাপারে জাপান কিছুটা রক্ষণশীল। এতে মেধাবী ও দক্ষ শ্রমিকেরাও দেশটিতে কাজের সুযোগ পান কম। তবে সম্প্রতি কর্মক্ষম মানুষের ঘাটতি পূরণ করতে বিদেশি শ্রমিক নেওয়ার কথা জানিয়েছে জাপান। এমন পরিস্থিতিতে বিদেশি নাগরিকদের জন্য জাপানি আবাসের আকর্ষণীয় সুযোগ হতে পারে ‘আকিয়া’।
অবশ্য নতুনদের জন্য কেবল বিনা মূল্যের বাসাই যথেষ্ট নয়; ওকুতামার মতো অল্প জনগোষ্ঠীর এলাকার জন্য একটি টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিকল্পনা দরকার। এ ছাড়া স্থানীয় এবং নতুনদের মধ্যে একটি কমিউনিটি বিল্ডিং কার্যক্রমের প্রয়োজন; যদি তারা উন্নতি করতে চায়।
ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্যবিদ্যার অধ্যাপক জেফরি হও বলেন, যদি মানুষ উৎপাদনশীল অর্থনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করার একটা উপায় খুঁজে পায়, তাহলে তারা গ্রামীণ এলাকায় আসবে ও থাকতে শুরু করবে। কামিয়ামা নামে জাপানের একটি শহর আছে। এটিও ওকুতামার মতো সমস্যায় পড়েছিল। তবে ২০১১ সালে এর জনসংখ্যা বাড়তে থাকে। প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো এই এলাকায় উপগ্রহ অফিস স্থাপন করে। এর ফলে শহুরে জীবনে বিরক্ত মানুষ আগ্রহ খুঁজে পায়।
পিবিএ/এমটি/এইচএইচ