মাহে রমজানের প্রস্তুতি [৪]: রোজা কী, কেন, কীভাবে?

মুহাম্মদ আবুল হুসাইন

বছর ‍ঘুরে আবার আমাদের মাঝে ফিরে এসেছে সিয়াম সাধনার মাস।আ মাত্র তিন দিন পরই শুরু হবে রহমত, বরকম, ফাগফিরাত বা জাহান্নাম থেকে মুক্তির সাধনার মাস।আমরা বছরের প্রায় সারাটা বছই পার্থিব উন্নতি তথা দুনিয়ার ধান্দার পিছনে ছুটে থাকি আর এই ধান্দা করতে করতেই আমাদের এক সময় কবরে চলে যাওয়ার সময় হয়ে যায়। আর এই পার্থিব উন্নতি মূলত একে অন্যের তুলনায় জাগতিক সুযোগ সুবিধা লাভের প্রতিযোগিতা।এই অসুস্থ প্রতিযোগিতা করতে যেয়ে আমরা এত বেশি ভোগবাদী মানসিকতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ি যে, আমাদের বিবেকবোধ লোপ পায়।আমাদের আত্মিক সত্তা দুর্বল হয়ে পড়ে, আর দিন দিন প্রবল হয়ে ওঠে পাশবিক সত্তা। মানুষের আত্মিক সত্তা বা বিবেকবোধই হলো তার মনুষ্যত্ব।এই মনুষত্বের উপর পশুত্ব বা পাশবিক সত্তা যখন প্রবল হয়ে ওঠে তখন মানুষ আর মানুষ থাকেনা।তখন সে প্রবৃত্তির দাস বা পশুতে পরিণত হয়। আজ আমাদের সমাজে নারীত্বের অবমাননা যেভাবে দিন দিন প্রবল হয়ে উঠছে, নারী ও শিশুদের উপর যে অসম্মান ও অত্যাচার করা হচ্ছে এবং সার্বিক অপরাধ প্রবণতা যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে মূল কারণ এখানেই নিহিত- ভয়াবহ নৈতিক অবক্ষয় ও ভোগবাদী মানসিকতা।

রোজা কী?
আল কোরআনের পরিভাষায় রোজাকে বলা হয়‘ সাওম’। আরবি ‘সাওম’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে ‘বিরত থাকা’। এ প্রসঙ্গে সূরা মরিয়মে উল্লেখিত হযরত ঈসা (আ.)’র মা হযরত মরিয়মের একটি উক্তি এখানে উল্লেখ করা যায়: ‘আমি পরম করুণাময়ের জন্য রোজার মানত করেছি। এ কারণে আজ আমি কারও সাথে কথা বলব না।’ -সূরা মরিয়ম: আয়াত ২৬। এখানে মা মরিয়মের বক্তব্য থেকে বুঝা যাচ্ছে যে, যেহেতু তিনি রোজা রেখেছেন, সেহেতু তিনি কারো সাথেই কথা বলা থেকে বিরত থাকবেন। ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় ‘সাওম’ বলতে বুঝায়, ‘আল্লাহ’র সন্তুষ্টির আশায় সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সকল প্রকার খাদ্য-পানীয় এবং যৌনতা থেকে বিরত থাকা।

রোজা কেন রাখব?

.রোজার উদ্দেশ্য
পবিত্র কোরআন মজিদে রোজা বা সাওম সাধনার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে : ‘হে ঈমানদারগণ, তোমাদের উপর রোজা ফরাজ করা হল যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর, যাতে তোমরা তাক্বওয়ার গুণাবলী অর্জন করতে পারো।’ -(সূরা আল বাকারা, আয়াত ১৮৩)।
তাক্বওয়া আল কোরআনের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আধ্যাত্মিক এবং নৈতিক পরিভাষা। এটি ইসলামী আধ্যাত্মবাদ এবং নৈতিকতার মূলকথা। এটি ঈমানদার বা বিশ্বাসীদের জীবনের একটি একটি গুণাবলী যার বলে তারা তাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে চিন্তা এবং কর্মে আল্লাহ’র অস্তিত্বকে অনুভব করে, তাঁকে স্মরণ করে, তাঁকে হাজির-নাজির জেনে এবং ভয় করে নিজেদের জীবন পরিচালনা করেন। যার মধ্যে তাক্বওয়ার গুণাবলী রয়েছে, তিনি সর্বাবস্থায় আল্লাহ’র জন্য নেক আমল করতে এবং গুনাহ বা নাফরমানি থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে ভালোবাসেন। তাক্বওয়া হল এমন এক নৈতিক বোধ, যার ফলে ঈমানদারগণ নেক আমল করতে এবং আল্লাহ’কে ভয় করে চলতে ব্রতী হয়। তাক্বওয়া মানুষের মধ্যে ধৈর্য্য এবং দৃঢ়তা তৈরি করে। এটি মানুষের মধ্যে সহনশীলতা তৈরি করে এবং ধৈর্য্য ও সহনশীলতা মানুষকে উচ্চ নৈতিকতার স্তওে উন্নীত হতে সাহায্য করে।

মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, রোজা ঢাল স্বরূপ, যা মানুষকে গুনাহ ও অশ্লীল কাজ থেকে বিরত রাখে। শিস্যরা যখন জেসাসকে অনৈতিকতাবোধ থেকে বেঁচে থাকার উপায় জানতে চাইলেন, তখন তিনি তাদেরকে বললেন, প্রার্থনা এবং উপবাস ছাড়া তা সম্ভব নয়। -(ম্যাথিউ ১৭:২১)।

ইমাম গাজ্জালী (র.)’র মতে, রোজা মানুষের মধ্যে সামাদীয়াহ’র মত নৈতিক গুণ তৈরি করে, যা তাকে আকাক্সক্ষা থেকে মুক্তি দেয়। ইমাম ইবনে আল কাইয়ুম (র.) রোজাকে দেখেছেন আকাক্সক্ষার নিয়ন্ত্রক হিসেবে, যা ইন্দ্রিয়পরায়ণতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। ইমাম শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী (র.) মনে করেন, রোজা মানুষের ভিতরকার কুপ্রবৃত্তি বা পশুশক্তিকে দুর্বল করে এবং সুপ্রবৃত্তি বা বিবেকবোধকে শক্তিশালী করে। মাওলানা মওদূদী (র.) পবিত্র রমজান মাসকে দেখেছেন ব্যক্তিগতভাবে একজন মুসলমানের জন্য এবং সমগ্রভাবে পুরো মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য ধৈর্য্য এবং আত্মশুদ্ধির মাস হিসেবে।

চলবে-

 

আরও পড়ুন...