মিন্নি যার কারণে সাক্ষী থেকে আসামী

পিবিএ: বরগুনার প্রকাশ্যে রিফাত শরীফকে কুপিয়ে হত্যা মামলার প্রধান সাক্ষী ও নিহতের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নিকে পুলিশ সাক্ষী হিসাবে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে গেল। ১৬ জুলাই মঙ্গলবার দিনভর জিজ্ঞাসাবাদ শেষে রাত ৯ টার দিকে মামলার সাক্ষীকে আসামী করে গ্রেফতার করা হল। মিন্নিকে গ্রেফতারের বিষয়ে বরগুনার পুলিশ সুপার মো. মারুফ হোসেন বলেছেন, রিফাত শরীফ হত্যা মামলার ১ নম্বর সাক্ষী ও প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন মিন্নি। তার বক্তব্য রেকর্ড ও তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য মঙ্গলবার বরগুনা পুলিশলাইনে আনা হয়। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের পর এ ঘটনায় তার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে আমাদের কাছে মনে হয়েছে। এ কারণে তাকে এ মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। সাক্ষীকে আসামী হিসাবে গ্রেফতার প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, দীর্ঘ জিজ্ঞাসাবাদ ও অন্যান্য সোর্স থেকে পাওয়া তথ্য-উপাত্তে এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে মিন্নির সম্পৃক্ততার প্রমাণ পেয়েছে পুলিশ। তাই রাত ৯টার সময় তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে৷

উল্লেখ্য ২৬ জুন বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে প্রকাশ্যে রিফাত শরীফকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। খুনের পরদিন ২৭ জুন রিফাতের বাবা আবদুল হালিম শরীফ বরগুনা থানায় ১২ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন। এ ছাড়াও সন্দেহভাজন হিসাবে অজ্ঞাতনামা আরও চার-পাঁচজনকে আসামি করা হয়। এই অজ্ঞাত নামাদের মাঝেও কি মিন্নি ছিল? এমনটি হলে সেদিন আব্দুল হালিম শরীফ মিন্নীকে এ মামলার প্রধান সাক্ষী রাখলো কেন? এই মামলার প্রধান আসামি সাব্বির আহম্মেদ ওরফে নয়ন বন্ড ২ জুলাই পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন। মামলার এজাহারভুক্ত ও সন্দেহভাজন মিলিয়ে ইতোমধ্যে ১৪ জনকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ১০ জন আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। মামলা দুই নম্বর আসামি রিফাত ফরাজীসহ বাকি তিন আসামি এখনও রিমান্ডে আছেন ।

আসামীর জবানবন্দিতে সাক্ষীর আসামী হয়ে ওঠা সত্যিই চমকপ্রদ বটে। এই হত্যাকাণ্ডের মূল রহস্য উদঘাটনই যদি মূল বিষয় হয়ে থাকে তবে নয়ন বন্ডের বক্তব্য কেন রেকর্ড করা হলোনা। কেন তাকে ক্রসফায়ারে মেরে ফেলা হল? দূর্ধর্ষ্য সন্ত্রাসী ছাড়া কেউ কি পুলিশের সাথে বন্দুক যুদ্ধ করতে পারে? কার প্রশ্রয়ে সে এমন দুর্দান্ত খুনী হয়ে উঠলো সেটা বের করার আগেই কেন নয়ন বন্ডকে মেরে ফেলা হল এটা কি আইনশৃংখলা বাহিনীর ব্যর্থতা নয়। আর একটি মজার বিষয় হল মামলার সাক্ষী আসামী হয়ে গেল সংবাদ সম্মেলনে ও মানব বন্ধনে। পুলিশ বলছে রিফাত হত্যায় মিন্নি সরাসরি জড়িত। কিন্তু সেটা কিভাবে মিন্নি কি রিফাতকে কুপিয়েছে? অথবা যারা কুপিয়েছে তাদেরকে দা এগিয়ে দিয়েছে?

এদিকে ১৩ জুলাই শনিবার রাত আটটার দিকে রিফাতের বাবা বরগুনা প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে মিন্নির গ্রেপ্তার দাবি করেন। তিনি অভিযোগ করেন, এ হত্যার সঙ্গে মিন্নি জড়িত। এতদিন পরে রিফাতের বাবার এই অভিযোগ কেন? এর পরদিন ১৪ জুলাই এমপি পুত্র সুনাম দেবনাথের উপস্থিতিতে বরগুনা প্রেসক্লাবের সামনে এক মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।

মানববন্ধনে বক্তারা অভিযোগ করেন, রিফাত হত্যায় তাঁর স্ত্রী মিন্নি জড়িত। বরগুনার সর্বস্তরের জনগণ-এর ব্যানারে আয়োজিত এই মানববন্ধনে বক্তৃতা করেন রিফাতের বাবা আবদুল হালিম শরীফ ও বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক ও স্থানীয় সাংসদের ছেলে সুনাম দেবনাথ। ‘বরগুনার সর্বস্তরের জনগণ এর ব্যানারে মানববন্ধনের পর এই দিনই মিন্নি তাঁর বাড়িতে এক সংবাদ সম্মেলন করেন। লিখিত বক্তব্যে তিনি অভিযোগ করেন, যাঁরা বরগুনায় ‘বন্ড ০০৭’ নামে সন্ত্রাসী গ্রুপ সৃষ্টি করেছিলেন, তাঁরা খুবই ক্ষমতাবান এবং অর্থবিত্তশালী।

নেপথ্যের এই ক্ষমতাবানেরা বিচারের আওতা থেকে দূরে থাকা ও এই হত্যা মামলাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার জন্য তাঁর শ্বশুরকে বিভিন্নভাবে চাপ প্রয়োগ করে সংবাদ সম্মেলন করিয়েছেন। আরও একটি বিষয় হল আব্দুল হালিম শরীফের সংবাদ সম্মেলনেও সুনাম দেবনাথ উপস্থিত ছিলেন। সোশ্যাল মিডিয়াতেও মিন্নিকে দায়ী করে স্ট্যাটাস দিয়েছেন তিনি। তার এ ব্যাপারে এত সক্রিয়তা কেন?

কিছুদিন চুপ করে থাকলেও এমপিপুত্র সুনাম দেবনাথ থেমে থাকেননি। মিন্নির পিছুও ছাড়েননি। মিন্নির দুর্নাম রটাতে এখন রীতিমতো মাঠে নেমেছেন সুনাম। অভিযোগ রয়েছে, এমপিপুত্রের চাপে রিফাতের বাবা সংবাদ সম্মেলন করে খুনের নেপথ্যে মিন্নির সম্পৃক্ততার কথা বলেছেন।

এখানেই শেষ নয়, এমপিপুত্র খুনিদের বাঁচাতে মিন্নিকে গ্রেপ্তারের দাবিতে গতকাল রবিবার বরগুনা প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন করেছেন। সেখানে এমপিপুত্র তাঁর বক্তব্যে মিন্নিকে আইনের আওতায় আনার দাবিও জানান। অথচ তিনি তাঁর বক্তব্যে একটিবারও পলাতক আসামিদের গ্রেপ্তার বা গ্রেপ্তারকৃতদের শাস্তি নিয়ে কোনো বক্তব্য দেননি। দেশ তোলপাড় করা এমন ঘটনায় এমপিপুত্রের এমন অবস্থান ব্যাপক সমলোচনার জন্ম দিলেও তিনি জড়িতদের বাঁচাতেই মাঠে নেমেছেন এমন মন্তব্য এখন বরগুনাবাসীর। সত্যিই কি তাই? মিন্নিকে নিয়ে কেন এত তোড়জোড়? ফাঁসির চেয়ে কঠিন শাস্তি চেয়ে তাকে নিয়ে গান বানানোও শুরু হয়ে গেছে৷ গানের কয়েকটি কলি হল-একটি মেয়ের জন্য আজই লজ্জিত হায় নারী/নেই মমতা তার হৃদয়ে জীবন ধ্বংসকারী/ফাঁসির চেয়ে কঠিন সাজা মিন্নীর যেনো হয়/সালাম করি ঐ প্রশাসন সরকার মহোদয়/ফাঁসির চেয়ে কঠিন সাজা মিন্নীর যেন হয়..এখন প্রশ্ন কে এই গানের গীতিকার? কে এই শিল্পী? কার পরামর্শে ও উৎসাহে এই গানটি লেখা হল ও গাওয়া হল? সে রহস্য উদঘাটন হবে কি।

কেন মিন্নীকে ফাঁসাতে এত তোড়জোড়? তাকে আইনী সহায়তা দিতে আদালতে কোন আইনজীবীও তার পক্ষে দাঁড়ালোনা। মিন্নিই যত নষ্টের গোড়া,এটা প্রমান করতেই যেনো উঠে পড়ে লেগেছে একটি মহল। সরকারও কি তবে এই মহলটির পক্ষে? নইলে এজাহারভুক্ত ৫ জন আসামী রেখে প্রধান সাক্ষীকে কেন গ্রেফতার করা হল? গ্রেফতারের পর আইনজীবী সহায়তাও নিতে দেয়া হলনা তাকে৷

মিন্নির পরিবারের দাবি পুলিশ মিন্নিকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর থেকেই মিন্নির বাবা এবং আত্মীয় স্বজন হন্য হয়ে একজন আইনজীবী খুঁজেছেন। কিন্তু মিন্নির পক্ষে লড়ার জন্য কোনো আইনজীবীকেই রাজি করাতে পারলেন না তারা। রিফাত হত্যা মামলায় রাতারাতি সাক্ষী থেকে আসামী হয়ে গেলো মিন্নি। কোনো আইজীবীও তার পক্ষে আদালতে দাঁড়াতে সাহস পেলোনা। অথচ দেশদ্রোহী রাজাকাররা আইনজীবী পায়৷ ধর্ষক খুনীরা আইনজীবী পায়৷ মিন্নি কোন আইনে তাদের চেয়েও খারাপ হয়ে গেল? আমরা কাদের মোল্লা, আলী আহসান মুহম্মদ মুজাহিদ ও কামারুজ্জামানের পক্ষে আইনজীবী দাঁড়াতে দেখেছি। দেখেছি ধর্ষক সিরাজ উদৌল্লাহর পক্ষে আদালতে ১৬ জন আইনজীবীকে দলবেঁধে দাঁড়িয়ে যেতে। আরও দেখেছি নুসরাতের আইনজীবীকে লাঞ্চিত করতে।

তবে কি এই লাঞ্চিত হওয়ার ভয়েই আইনজীবীরা মিন্নীর পক্ষে দাঁড়ালোনা? কারা এই লাঞ্চনাকারী প্রবল ক্ষমতাধর? বেরোবে কি তার উৎসমুখ? এ প্রসঙ্গে মানবাধিকার আইনজীবী সালমা আলী বলেন, বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী কারো পক্ষে, বিশেষ করে কোন আসামীর পক্ষে, আইনজীবী নিয়োগ দেয়া না থাকলে তার পক্ষে আইনজীবী নিয়োগ দেয়া সরকারের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। কিন্তু সরকার কেন আইনজীবী নিয়োগ করলোনা। মিন্নির প্রসঙ্গে অনেক ধরনের কথা বলছে লোকজন। কেউ বলছেন,নিহত রিফাত শরীফের স্ত্রী মিন্নির সঙ্গে নয়ন বন্ডের প্রেমের সম্পর্ক ছিল। আবার কেউ বলছেন, রিফাত শরীফের আগে মিন্নির সঙ্গে নয়নবন্ডের বিয়ে হয়েছিল। ফেসবুকে মিন্নির সঙ্গে নয়ন বন্ডের কয়েকটি ছবি ছড়িয়ে পড়ায় এ বিতর্কও ছড়িয়ে পড়ে। এ বিষয়ে আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি বলে, নয়ন আমাকে খুব উত্ত্যক্ত করতো। আমাকে হুমকি দিতো এবং অস্ত্র দেখিয়ে ভয় দেখাতো। আমার ভাই কলেজ রোড এলাকার একটি স্কুলে পড়ে।

নয়ন আমার স্কুল পড়ুয়া ভাই এবং বোনকে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। আমার বাবাকেও বিভিন্ন সময়ে হুমকি দিতো। একদিন অস্ত্রের মুখে আমাকে জিম্মি করে একটি বাসায় নিয়ে যায় নয়ন। পরে সেখানে বসে একটি কাগজে আমার স্বাক্ষর নেয় সে। তবে সেই স্বাক্ষর দিয়ে নয়ন কিছু করেছে কি-না আমি জানি না। মিন্নি বলেন, আমার বিয়ে হয়েছে একমাত্র রিফাত শরীফের সঙ্গে। এছাড়া আমার আর কখনো কারও সঙ্গে বিয়ে হয়নি। যেহেতু বিয়েই হয়নি, ডিভোর্স হওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না। রিফাতই আমার স্বামী এবং এটাই সত্য। আমি এ ঘটনার সুষ্ঠু বিচার চাই। আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটাই দাবি করি, যারা আমার স্বামীকে হত্যা করেছে আমি তাদের ফাঁসি চাই।

কিন্তু এই দাবির পরপরই মিন্নীকে সাক্ষী হিসাবে গ্রেফতার করে পরে আসামী করে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিল পুলিশ। এসপি বাবুল আখতারের বিরুদ্ধে স্ত্রী মাহমুদা আক্তার মিতু হত্যায় সম্পৃক্ততার তথ্য বেরিয়েছিল। তিনি এখন মুক্ত আছেন। আজকে যারা মিন্নীর ফাঁসি দাবি করছেন তখন তারা সরব হননি কেন? কেন বাবুল আখতার পুরুষ বলে? পুরুষতান্ত্রিক মনমানসিকতা তুমুল সোচ্চার, তাই নয় কি। যদি তাই না হতো বাবুল আখতারকে নিয়েও কি তখন এত সোরগোল হতোনা? বরগুনার এই আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ডে তার স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকা মিন্নিকে গ্রেপ্তার করা নিয়ে আলোচনা উঠেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিতে। মামলার সাক্ষী মিন্নিকে হত্যাকাণ্ডে জড়িত হিসেবে গ্রেফতারের পেছনে প্রভাবশালী কারও প্ররোচনা রয়েছে কি না, সেই প্রশ্ন তুলেছেন একজন সংসদ সদস্য। এই প্রশ্নের যথার্থ উত্তর পাবে কি মানুষ। যদি এমনটি হয়ে থাকে আমরা সাক্ষী মিন্নীকে কেন আসামী করা হল তার জবাব চাই ও প্রভাবশালী ষড়যন্ত্রকারীদের শাস্তি চাই।

পিবিএ/বিএইচ

আরও পড়ুন...