মিয়ানমারে ভূমিকম্পে ১৪৪ জনের মৃত্যু, শতাধিক নিখোঁজ

দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার দেশ মিয়ানমারে শুক্রবার (২৮ মার্চ) শক্তিশালী ভূমিকম্প হয়েছে। এতে মিয়ানমারের পাশাপাশি ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে থাইল্যান্ডে। দক্ষিণ-পশ্চিম চীন, ভারত, ভিয়েতনাম ও বাংলাদেশেও কম্পন অনুভূত হয়েছে।

আজ রাত ১০টার দিকে এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত মিয়ানমারের জান্তা সরকারের হিসাব অনুযায়ী, দেশটিতে অন্তত ১৪৪ জন নিহত হয়েছেন। আহত ৭৩২ জনের বেশি। আর থাইল্যান্ডে তিনজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়েছেন বহু মানুষ।

যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএসের তথ্যমতে, আজ স্থানীয় সময় দুপুর ১২টা ৫০ মিনিটে মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় অঞ্চলে ৭ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। এর উৎপত্তিস্থল ছিল ভূপৃষ্ঠের ১০ কিলোমিটার গভীরে। ভূমিকম্পের কেন্দ্র মিয়ানমারের মান্দালয় শহর থেকে প্রায় ১৭ দশমিক ২ কিলোমিটার দূরে। ভূমিকম্পের ১২ মিনিট পর ৬ দশমিক ৪ মাত্রার একটি পরাঘাত (আফটার শক) হয়।

ভূমিকম্পের পর মিয়ানমারের রাজধানী নেপিডো, মান্দালয়, সাইগাইংসহ ছয়টি অঞ্চলে জরুরি অবস্থা জারি করেছে দেশটির সামরিক সরকার। মিয়ানমারের জান্তাপ্রধান মিন অং হ্লাইংয়ের বরাতে বিবিসি জানিয়েছে, নিহত ১৪৪ জনের মধ্যে নেপিডোয় ৯৬ জন, সাইগাইংয়ে ১৮ জন ও মান্দালয়ে ৩০ জন রয়েছেন। নিহত ব্যক্তির সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।

মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, শক্তিশালী কম্পনে নেপিডো, সাইগাইং, মান্দালয়সহ পাঁচটি শহরে ভবন ধসে পড়েছে। এ ছাড়া একটি সেতু ও একটি রেলসেতু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত ছবিতে দেখা গেছে, ইরাবতী নদীর ওপর আভা সেতু ধ্বংস হয়ে গেছে। সেতুটির পিলারগুলো পানির মধ্যে হেলে পড়েছে।

ভূমিকম্পে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মিয়ানমারের মান্দালয় শহর। ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থলের নিকটবর্তী এই প্রাচীন শহর দেশটির বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের বড় একটি কেন্দ্র। শহরটির এক বাসিন্দা রয়টার্সকে বলেন, ‘সবকিছু কাঁপতে শুরু করলে আমরা সবাই বাড়ি থেকে বের হয়ে যাই। আমার চোখের সামনে পাঁচতলা একটি ভবন ধসে পড়ে। আমাদের শহরের সবাই এখন রাস্তার ওপর রয়েছেন। ভয়ে কেউ ভবনের ভেতরে যাচ্ছেন না।’

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত ছবিতে শহরজুড়ে ধ্বংসস্তূপ দেখা গেছে। স্থানীয় সংবাদমাধ্যম মিয়ানমার নাও–এর তথ্য অনুযায়ী, শহরের একটি টাওয়ার পুরোপুরি ধসে গেছে। মান্দালয় প্রাসাদের দেয়ালের একাংশ ভেঙে পড়েছে। শহরের বাসিন্দা হতেত নাইং ও বলেন, ‘এখানকার পরিস্থিতি খুবই শোচনীয়।’

মিয়ানমারের তাউনগো শহরে একটি মসজিদের একাংশ ধসে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন দুজন প্রত্যক্ষদর্শী। তাঁদের একজন বলেন, ‘আমরা যখন নামাজ আদায় করছিলাম, তখন কম্পন শুরু হয়। ঘটনাস্থলেই তিনজন মারা যান।’ এ ছাড়া শান প্রদেশের আউং বান শহরে একটি হোটেল ধ্বংস হয়ে গেছে। ওই ভবনের নিচে ২০ জন চাপা পড়েছেন। নিহত হয়েছেন দুজন।

রাজধানী নেপিডোতেও ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। দেশটির সামরিক বাহিনী পরিচালিত সম্প্রচারমাধ্যম এমআরটিভির খবরে বলা হয়েছে, রাজধানীর অনেক ভবন ভেঙে পড়েছে, কিছু ভবন আবার হেলে পড়েছে। ভূমিকম্পের সময় দুর্ঘটনার কবলে পড়ে অনেক গাড়ি বিকল হয়ে পড়ে আছে। ধ্বংসস্তূপের কারণে রাস্তাগুলো আটকে গেছে।

মিয়ানমারে ‘শোচনীয়’ এক সময়ে এই ভূমিকম্প হলো বলে মন্তব্য করেছেন মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মিয়ানমার বিষয়ক গবেষক জো ফ্রিম্যান। তিনি বলেন, দেশটিতে চলমান সংঘাতের কারণে এরই মধ্যে বিপুলসংখ্যক মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। সেখানে আগে থেকেই ত্রাণসহায়তার প্রয়োজন ছিল। এর মধ্যে ভূমিকম্পের কারণে সেই সংকট আরও গভীর হলো।

ব্যাংকক একটি জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, ভূমিকম্পের সময় লোকজন ভয়ে রাস্তায় ছোটাছুটি শুরু করেন। অনেকেই ছিলেন পর্যটক।
মিয়ানমারে ২০২১ সালে নির্বাচিত অং সান সু চি সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে সামরিক জান্তা। এর পর থেকে দেশটি সশস্ত্র বিদ্রোহীদের সঙ্গে সামরিক বাহিনীর সংঘাত চলছে। বর্তমানে দেশটির বড় অংশ দখলে রয়েছে এই বিদ্রোহীদের। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, মিয়ানমারের ৩০ লাখের বেশি মানুষ এখন বাস্তুচ্যুত। আর দেশটির এক–তৃতীয়াংশের বেশি মানুষের ত্রাণসহায়তা প্রয়োজন।

ভূমিকম্পে মিয়ানমারের পর সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে থাইল্যান্ডে। রাজধানী ব্যাংককে ৩০ তলা একটি নির্মাণাধীন ভবন ধসে পড়েছে। ওই ভবনের ধ্বংসস্তূপের নিচে ১১৭ জন আটকা পড়েছে বলে জানিয়েছে দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। তাঁদের খুঁজে বের করতে কাজ করছেন উদ্ধারকর্মীরা। সরকারি কার্যালয় হিসেবে ব্যবহারের জন্য ভবনটি নির্মাণ করা হচ্ছিল।

এ ঘটনায় ব্যাংককের গভর্নর চাদচার্ট সিত্তিপান্ত বলেন, ওই ভবনধসে তিনজন নিহত হয়েছেন। ভূমিকম্পের পর আরও পরাঘাত আসতে পারে। এ বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। তবে আপাতত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে জানিয়ে সবাইকে শান্ত থাকতে বলেন তিনি।

ব্যাংকক একটি জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, ভূমিকম্পের সময় লোকজন ভয়ে রাস্তায় ছোটাছুটি শুরু করেন। অনেকেই ছিলেন পর্যটক। কম্পনের তীব্রতা এতটাই ছিল যে হোটেলের ছাদে সুইমিংপুল থেকে পানি উপচে নিচে পড়ছিল। অনেকেই সাঁতার কাটার পোশাক পরে হোটেল থেকে নিচে নেমে আসেন। গতকাল থাইল্যান্ডের শেয়ারবাজারের সব কার্যক্রমও বন্ধ হয়ে যায়।

থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককের বাসিন্দা বুই থু বলেন, ‘আমি আমার অ্যাপার্টমেন্টের ভেতরে ছিলাম। হঠাৎ দেখতে পেলাম দেয়াল ফেটে যাচ্ছে। সুইমিংপুল থেকে পানি উপচে পড়ছে। চারদিক থেকে শুধু মানুষের চিৎকার ভেসে আসছিল। আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। খুবই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম।’

আরও পড়ুন...