পিবিএ ফেনী : ফেনীর সোনাগাজির মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি হত্যা মামলার আসামিদের অনেকেই ধরা পড়েছে। গ্রেপ্তার আসামিদের রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ হয়েছে। অনেকেই স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে হত্যার দায় স্বীকার করেছে। হত্যাকারীদের সহযোগীদের সন্ধান করা হচ্ছে। অর্থ লেনদেনের সূত্র খোঁজা হচ্ছে। এগুলো হত্যাপরবর্তী সময়ের প্রশাসনিক কার্যক্রম।
এই কার্যক্রমের সূত্র ধরে আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া হবে। সেই প্রতিবেদনের সূত্র ধরে বিচারিক প্রক্রিয়া এগিয়ে যাবে। আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী হয়ত এই বিচার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে সম্পন্ন হবে। আশা করা যায় দ্রুততার সঙ্গে হবে এই রায়। রায়ে কী হবে- এনিয়ে আগাম কিছু বলা যায় না, উচিতও না। তবে আশা করি অপরাধীরা শাস্তি পাবে। সামাজিক শৃঙ্খলার স্বার্থে হত্যার শিকার নুসরাতের পরিবার ন্যায়বিচার পাবে।
দেশবাসীর ইতোমধ্যেই জানা হয়ে গেছে যে, মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাতকে প্রথমে যৌন হয়রানি করে তারই মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা এসএম সিরাজ উদ দৌলা। এরপর মেয়েটি আইনি প্রতিবিধান চেয়ে থানায় মামলা করতে গেলে প্রথমে সোনাগাজি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (অভিযোগ ওঠার পর প্রত্যাহার) মোয়াজ্জেম হোসেন জিজ্ঞাসাবাদের নামে মেয়েটিকে হেনস্থা করেন এবং জিজ্ঞাসাবাদের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেন। ওই ওসি নুসরাতের গায়ে আগুন দেওয়ার ঘটনাকে ‘আত্মহত্যা’ বলেও প্রতিষ্ঠা করতে সবধরনের অপচেষ্টা করে ব্যর্থ হন। ওসির এই অন্যায়ের সঙ্গী ছিলেন ফেনী জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) জাহাঙ্গীর আলম সরকার, এমনই অভিযোগ।
ধর্ষক শিক্ষক সিরাজ উদ দৌলা কর্তৃক যৌন নিপীড়নের শিকার নুসরাত জীবদ্দশায় আইনি প্রতিবিধান পায়নি। শারীরিকভাবে নিপীড়নের শিকার হয়ে অসাধু পুলিশ কর্মকর্তা কর্তৃক প্রশাসনিক হয়রানির শিকারও হয়েছে। কৈশোরোত্তীর্ণ নুসরাতের পৃথিবী ক্রমে ছোট হয়ে আসছিল। একদিকে ধর্ষক মাদ্রাসাশিক্ষক সিরাজ, অন্যদিকে পুলিশ কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর-মোয়াজ্জেম, আরও ছিল উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রুহুল আমিন, পৌর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাকসুদ আলমসহ অপরাপর খুনিরা। এমন অবস্থায় এতটুকু একটা মেয়ের কোথাও যাওয়ার উপায় ছিল না। তবু সে লড়েছে প্রথমে যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে মুখ খুলে আইনি প্রতিবিধান চাওয়ার মাধ্যমে, এবং এরপর শরীরের আশি শতাংশ পুড়ে যাওয়ার পরেও মরার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত বেঁচে ওঠার প্রাণান্ত চেষ্টার মাধ্যমে।
বাঁচতে পারেনি নুসরাত। তাকে বাঁচতে দেওয়া হয়নি। মাদ্রাসার ধর্ষক অধ্যক্ষ, ধর্ষকের সহযোগী বাহিনী, সহপাঠী, পুলিশ প্রশাসন, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা, জনপ্রতিনিধি- এতগুলো মানুষ, এতগুলো প্রতিষ্ঠান যখন অন্যায় ভাবে এক হয়ে তার বিরুদ্ধে শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও প্রশাসনিক নিপীড়নের স্টিমরোলার চালায় তখন তার বেঁচে ওঠা আর হয়ে ওঠেনি। ফলে চিকিৎসকদের সকল চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়ে তাকে চলে যেতে হয়েছে।
নুসরাত হত্যায় মামলা করেছেন তার ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান। ওই মামলায় এজাহারভুক্ত আসামি হচ্ছেন ৮ জন, এছাড়াও আসামিদের কয়েকজন অজ্ঞাতনামীয়। আগুনে দগ্ধ হওয়ার পর এই মামলা গতি পায়।
এবং সর্বশেষ পুলিশ এজাহারভুক্ত আসামিদেরসহ অন্তত ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। এই লেখা যখন লিখছি তখন অন্তত চারজন আসামি হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছে। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে আছেন- মাদ্রাসার অধ্যক্ষ এসএম সিরাজ-উদ-দৌলা, সোনাগাজি পৌর কাউন্সিলর ও পৌর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাকসুদ আলম, শিক্ষক আবছার উদ্দিন, নুসরাতের সহপাঠী আরিফুল ইসলাম, নূর হোসেন, ব্যাংকার কেফায়াত উল্যাহ জনি, মোহাম্মদ আলাউদ্দিন, শাহিদুল ইসলাম, অধ্যক্ষের ভাগ্নি উম্মে সুলতানা পপি, জাবেদ হোসেন, যোবায়ের হোসেন, নূর উদ্দিন, শাহাদাত হোসেন, মো. শামীম, কামরুন নাহার মনি, আব্দুল কাদের, আব্দুর রহিম শরিফ ও ইফতেখার উদ্দিন রানা। আছেন ফেনীর সোনাগাজি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রুহুল আমিনও।
এই হত্যাচেষ্টা ও হত্যার ঘটনার দিনক্রমের দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায়, ফেনীর সোনাগাজি ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা এসএম সিরাজ-উদ-দৌলা গত ২৭ মার্চ নুসরাতকে নিজ কক্ষে ডেকে নিয়ে গিয়ে শ্লীলতাহানি করেন। এই ঘটনায় নুসরাতের মা বাদী হয়ে মাওলানা সিরাজের বিরুদ্ধে থানায় মামলা করেন। এরপর গত ৬ এপ্রিল সকালে নুসরাত আলিম পরীক্ষা দিতে গেলে কৌশলে তাকে ছাদে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে বোরকা পরিহিত কয়েকজন মাওলানা সিরাজের বিরুদ্ধে মামলা ও অভিযোগ তুলে নিতে চাপ দেয়। তাদের সেই অন্যায় চাপে নতি স্বীকার না করলে তারা তার গায়ে আগুন দিয়ে পালিয়ে যায়। মুমূর্ষু অবস্থায় প্রথমে ফেনী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়, এরপর তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে ভর্তি করা হয়। এবং সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ১০ এপ্রিল মারা যায় নুসরাত।
নুসরাতের এই মৃত্যুতে সারাদেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠেছে। বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ এই হত্যাকাণ্ডের দ্রুত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছেন। এই প্রতিবাদগুলো আমাদের জন্যে নতুন কিছু নয়। ধর্ষণ ও নারী-শিশু নিপীড়নের যেকোনো ঘটনা দেশে আলোচিত হলে এভাবেই মানুষ জেগে ওঠে, প্রতিবাদী হয়। কিন্তু এই প্রতিবাদ, আলোচনা একটা সময়ে থেমে গেলেও নারী নিপীড়নগুলো থামে না। বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদনে সে প্রমাণ মেলে।
এ বছরের প্রথম চার মাসে (এপ্রিল চলমান) ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে শতাধিক। চলতি মাসের প্রথম ১৫ দিনে সারা দেশে ৪৭ শিশু ধর্ষণ, ধর্ষণচেষ্টা ও যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে। গত ১৭ এপ্রিল এক বিবৃতিতে এই তথ্য প্রকাশ করেছে ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ)’। সংগঠনটি জানায়, ২ থেকে ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত ছয়টি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদ বিশ্লেষণ করে এই তথ্য পাওয়া গেছে। তারা জানায়, এই ১৫ দিনে সারা দেশে ৪৭ শিশু ধর্ষণ, ধর্ষণচেষ্টা ও যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে । এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার মেয়ে শিশুর সংখ্যা ৩৯ জন। বিভিন্ন কারণে হত্যা করা হয়েছে ৫ শিশুকে, যার মধ্যে ৪ জন ছেলে ও ১ জন মেয়েশিশু।
অন্যদিকে, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে সারা দেশে প্রায় ১২৩ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ জানিয়েছে, চলতি বছর শুধু জানুয়ারি মাসে দেশে ৫২টি ধর্ষণ, ২২টি গণধর্ষণ এবং ৫টি ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা ঘটেছে। গত ৪ ফেব্রুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটি আরও জানায় ২০১৮ সালে ৯৪২টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে সারা দেশে।
নুসরাতের ঘটনার সময়ে দেশে আরও কিছু শ্লীলতাহানির ঘটনা আলোচনায় এসেছে। এই ঘটনাগুলো আমাদের মানবিক পরাজয়ের স্মারক বিশেষ। এ থেকে উত্তরণ কীভাবে? অপরাধীদের দ্রুতবিচার এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মাধ্যমে এই অবস্থা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। কারণ বিচারিক দীর্ঘসূত্রিতার যে সমস্যা আমাদের সেটা দিনদিন আরও বিস্তৃত হচ্ছে। বিচারিক আদালতে আলোচিত কিছু মামলার দ্রুত বিচার সম্পন্ন হলেও শাস্তি কার্যকরের বাকি ধাপগুলো সময়সাপেক্ষ বলে কোনো বিচার, কোনো শাস্তিই দৃষ্টান্তমূলক হচ্ছে না। এরই মধ্যে আইনের মারপ্যাঁচে অপরাধীরা উচ্চ আদালত থেকে জামিন পেয়েও বেরিয়ে আসছে। ফলে অনেক অপরাধীকে দেওয়া বিচারিক আদালতের শাস্তি স্রেফ কাগজেকলমে থেকে যাচ্ছে।
এছাড়াও আছে আমাদের অন্য এক সামাজিক সমস্যা যা মূলত ধর্মের নামে চালিত হয়। একদল ধর্মান্ধ ধর্ষকের বিচার চাওয়ার আগে ধর্ষিতা পোশাক নিয়ে গবেষণায় আগ্রহী হয়ে পড়ে। মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাতের ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনার পরেও সেই শ্রেণি সমভাবে সক্রিয়, যদিও নুসরাত তাদের চাওয়ামত বোরকা/হিজাব পরিহিত ছিল। এবং এই মামলার নারী আসামিদের সকলেই বোরকা/হিজাব পরা। এখানে তবু নুসরাত চক্ষুশূল তাদের কারণ সে যে নারী; আর নারী মাত্রই ‘ভোগ্য’ তাদের কাছে। অগণন মানুষের এই মানসিক দীনতা সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে মহামারি আকার ধারণ করেছে।
নুসরাত হত্যার নারী আসামিরা হিজাব-বোরকা পরা। তাদের মুখ দেখা যায় না। বিচার হয়ে গেলে এদের সকলেই যে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত হবে এমনও হয়ত না। ফলে দেখা যাবে একটা সময়ে তারা শাস্তি ভোগ শেষে অথবা শাস্তিকালেই উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে বেরিয়ে আসবে। বেরিয়ে আসার পর তারা অন্য সকলের মত সাধারণভাবেই চলাফেরা করবে। এখন বাহারি রঙ কিংবা কালো কাপড়ে মুখ ঢেকে রাখায় দেশবাসী তাদের মুখ দেখল না, তাদেরকে চিনতে পারল না। অথচ অপরাধীর মুখটা দৃশ্যমান হওয়ার দরকার
নুসরাতের হত্যাকারীদের আদালতে নেওয়ার ছবি বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে। এই অভিযুক্তদের মধ্যকার নারী আসামিদের মুখ আড়াল করে রাখার কতখানি প্রয়োজন এনিয়ে ভাবা জরুরি। অভিযুক্ত অপরাধীর মুখ ঢাকার প্রয়োজন নাই, তাদের চেহারা প্রকাশ্য করে দেওয়া উচিত। এখানে ধর্মীয় বিধিবিধানের, ধর্মীয় পোশাকপরিচ্ছদের দোহাই দেওয়া অনুচিত। ‘প্রয়োজনে ছবি তোলা জায়েজ’- বিশ্বাসী একদল লোক আছে দেশে; তাদের সেই বিশ্বাসকে ধার করে বলি অপরাধীর চেহারা শনাক্তকরণে নুসরাত হত্যাকারী সকলের বোরকা-হিজাব খুলে তাদের মুখমণ্ডলটা দেশবাসীকে দেখানো হোক। তাদের চেহারা পর্দার অন্তরালে রাখতে দেওয়া ঠিক হবে না। দেশবাসী দেখুক কারা অপরাধী।
বোরকা-হিজাব পরিহিত ক’জন অভিযুক্তকে দেখছে সবাই, কিন্তু এই পোশাকের আড়ালে থাকা মুখগুলো কেউ দেখছে না। এ অবস্থায় আমরা ক’জন অপরাধীর নাম পড়ছি আর দেখছি যাদের তাদের মুখমণ্ডল কালো কিংবা বাহারি কাপড়ে ঢাকা। অপরাধীর মুখ প্রকাশ্য হলে সে হয়ত লজ্জিত হতো। কারণ লজ্জা অন্য কোথাও নয়, চোখে-মুখে! তাই পর্দা দিয়ে ঢাকতে না দিয়ে অপরাধীর মুখ প্রকাশ্য করুন। এখানে ধর্মীয় তরিকার পোশাক পরিচ্ছদ কিংবা কথিত পর্দার দোহাই দেওয়া উচিত হবে না।
পিবিএ/এমএস