মূল্যবোধহীন উন্নয়ন কখনই টেসকসই উন্নয়ন হয় না: ইকবাল মাহমুদ

দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ

পিবিএ, ঢাকা: দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেছেন, মূল্যবোধহীন উন্নয়ন কখনই টেসকসই উন্নয়ন হয় না। তিনি সরকারের উদ্দেশে বলেন, প্রতিটি উন্নয়ন প্রকল্পে দুর্নীতির ফাঁকফোঁকড় যাতে না থাকে অর্থাৎ মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা যাতে থাকে সেজন্য পরিকল্পনা নিন। প্রকল্প বা জন-কর্মসূচিতে দুর্নীতি প্রতিরোধে কমিশন সহযোগিতা করতে প্রস্তত।

দুদক চেয়ারম্যান আক্ষেপ করে বলেন, আজকে কেন যেন মনে হয়, অনিয়মকে সবাই নিয়মে পরিণত করছে। এই নিগড়ে আমরা সবাই বাঁধা পড়েছি। বনানীর এই বিয়োগাত্মক ঘটনা এসব অনিয়মের পরিণতি। এই জাতীয় অনিয়মকে দুর্নীতি অবহিত করে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, বনানীর এফ আর টাওয়ার নির্মাণে অনিয়মকারীদের সবাই ছেড়ে দিলেও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ছাড়বে না।

তিনি আরো বলেন, সময়মতো কাজ করবেন না, এটাও দুর্নীতি।

তিনি বলেন, ১৮তলা ভবনের অনুমোদন পেলো, বানালো ২৩তলা। এই অনিয়মের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের ক্ষমা হবে না। এভাবে জনগণের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা আর সহ্য করা ঠিক হবে না। এদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনতে হবে।

ইকবাল মাহমুদ বলেন, ঘুষ-দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে দুদক কাজ করছে। তবে এ কথাও ঠিক কমিশনের একার পক্ষে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় ঘুষ-দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। কেন সম্ভব নয় প্রশ্ন করে তিনি বলেন, একটি প্রতিষ্ঠান দিয়ে সবকাজ সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। তারপরও আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। সমাজের সবস্তরে মূল্যবোধ বিকশিত করার জন্য আমাদের এই প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা হবে।

তিনি গণমাধ্যমকর্মীদের উদ্দেশ্যে বলেন, আপনারা কমিশনের ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে লিখবেন, আপনাদের গঠনমূলক সমালোচনাকে আমরা সর্বদাই স্বাগত জানাই।

আর্থিক সীমাবদ্ধতা নিয়েও আমরা সততা সংঘ এবং সততা স্টোর নিয়ে কাজ করছি দাবি করে তিনি বলেন, আমাদের সীমিত অর্থ দিয়ে প্রতিটি সততা সংঘের সদস্যরা যাতে সাং-বাৎসরিক ভিত্তিতে বিতর্ক প্রতিযোগিতা, রচনা প্রতিযোগিতা এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করতে পারেন সে ব্যবস্থা করা হয়েছে। এক্ষেত্রে সমাজের বিত্তবানদেরও এগিয়ে আসতে হবে।

সমাজ শক্তির অংশগ্রহণ ছাড়া এ জাতীয় কার্যক্রম বিকশিত হয় না জানিয়ে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, আসুন সম্মিলিতভাবে দুর্নীতি প্রতিরোধ এবং নৈতিক মূল্যবোধ বিকাশের সামাজিক আন্দোলনে অংশগ্রহণ করি। আমরা অনেক কাজই করতে পারি না। কেন পারি না? এর উত্তর দেওয়া কঠিন। কারণ আমরা একটি গণ্ডির মধ্যে কাজ করি। কমিশনের অভিযোগ কেন্দ্রের হটলাইন-১০৬ এ লাখ লাখ ফোন কল এসেছে। এর সামান্য সংখ্যক অভিযোগই আমলে নেওয়া হয়েছে। আর যেসব অভিযোগ কমিশন আইনের আওতায় নেই, সে বিষয়েও আমরা সঠিক পরামর্শ দিচ্ছি। আর যাই হোক হটলাইন-১০৬ এখন জনগণের অভিযোগ জানানোর এক বিশ্বস্ত প্লাটফর্মে পরিণত হয়েছে। এসব অভিযোগের ভিত্তিতেই কমিশনের এনফোর্সমেন্ট ইউনিটের মাধ্যমে দেশব্যাপী তাৎক্ষণিক দুর্নীতি প্রতিরোধে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। অধিকাংশ অভিযানই সফল হচ্ছে এবং দুর্নীতি ঘটার আগেই তা প্রতিরোধ করা যাচ্ছে। মূলত ১০৬ হচ্ছে তাৎক্ষণিকভাবে দুর্নীতি প্রতিরোধের অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে দুর্নীতি সংঘটিত হওয়ার আগেই তা প্রতিরোধ করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, যেসব দুর্নীতিবাজ সরকারি সম্পদ অবৈধভাবে দখল করে ভোগদখল করছেন, নদী দখল করেছেন, লুটপাট করে সম্পত্তি গ্রাস করেছেন, এসব জনগণের সম্পত্তি ত্যাগ করুন, নইলে আপনাদের জন্য কঠোর পরিণতি অপেক্ষা করছে।

দুদক চেয়ারম্যান বলেন, গণপূর্ত, সড়ক ও জনপথ, বাংলাদেশ রেলওয়ে কিংবা বন বিভাগের সম্পত্তি দখল করে রেস্ট হাউজ বানিয়েছেন। নিয়ম অনুযায়ী সরকারের সম্পত্তি সরকারের কাছে সমর্পণ করুন। নইলে কঠিন পরিণতি ভোগ করতে হবে। যারা অনিয়মের মাধ্যমে জনগণের অর্থ নিয়েছেন অথবা যারা অর্থ দিয়েছেন এইসব অর্থ লোপাটকারীরাও আইনের আওতায় আসবে। তাই যারা অবৈধভাবে অর্থ নিয়েছেন অথবা অর্থ দিয়েছেন দয়া করে জনগণের অর্থ বিধিমত জনপ্রতিষ্ঠানের জনগণের কাছে জমা দিন, নইলে পরিণতি সুখকর হবে না।

তিনি শ্রেণিকক্ষে শিক্ষা নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়ে উপস্থিত শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে বলেন, আপনার আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জিম্মাদার, আপনারা আমাদের জিম্মি করবেন না। কোচিং বাণিজ্য ও নোট বাণিজ্য থেকে আমাদের শিক্ষাকে মুক্ত করুন। আমাদের নৈতিকমূল্যবোধ সম্পন্ন জাতি গঠনে আপনারা কার্যকর ভূমিকা রাখুন।

দুর্নীতি প্রতিরোধে সমন্বিত উদ্যোগের কোনো বিকল্প নেই। আসুন, আমরা সবাই মিলে জাতির পিতার স্বপ্নের বৈষম্যহীন, শোষণমুক্ত, দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণে আত্মনিয়োগ করি।

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালা অডিটোরিয়ামে শ্রেষ্ঠ দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি, বিতর্ক প্রতিযোগিতায় বিজয়ী, দুদক মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড প্রদান অনুষ্ঠান ও সততা সংঘের সমাবেশে বক্তব্য রাখেন দুদক চেয়ারম্যান।

অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, ‘এখন দুর্নীতির মাত্রা কমছে কি না, প্রশ্ন আছে। আশা করি কমছে।’ তবে রাজনীতি বা অর্থবিত্তের কাছে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান যাতে চাপা না পড়ে, সে বিষয়ে নজর দিতে দুদকের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, ‘শিক্ষার ক্ষেত্রে সবাই জিপিএ-ফাইভের দিকে ছুটছে। কিন্তু শুধু জিপিএ-ফাইভের মাধ্যমে নৈতিকতা ও মূল্যবোধ অর্জন করা যাবে না। দুদক শ্রেণিকক্ষের ভেতরে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছে। সে জন্য শিক্ষা আন্দোলনের একজন কর্মী হিসেবে দুদককে ধন্যবাদ জানাই।’

দুদক সচিব মুহাম্মদ দিলোয়ার বখত, দুদক মিডিয়া জুড়িবোর্ডের সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল, বিতার্কিক আলিফ আল জামাল, সততা সংঘের সদস্য সঞ্চিতা রহমান মিম, নেত্রকোনা জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সাধারণ সম্পাদক আমজাদ খান, সাভার উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সাধারণ সম্পাদক মো. সালাউদ্দীন নাঈম, প্রিন্ট মিডিয়া ক্যাটাগরিতে দুদক মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড বিজয়ী ও প্রথম আলোর সিনিয়র রিপোর্টার মো. ফখরুল ইসলাম হারুণ, ইলেকট্রনিক ক্যাটাগরিতে বিজয়ী মাছরাঙা টিভির বিশেষ প্রতিনিধি বদরুদ্দোজা বাবু প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।

এসময় অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন দুদক কমিশনার ড. মো. মোজাম্মেল হক খান ও এএফএম আমিনুল ইসলাম।

এবার দুদক মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড বিজয়ীরা হলেন- ইলেকট্রনিক ক্যাটাগরিতে প্রথম স্থান অর্জনকারী মাছরাঙা টিভির বিশেষ প্রতিনিধি বদরুদ্দোজা বাবু, দ্বিতীয় স্থান ৭১টিভির সিনিয়র রিপোর্টার পারভেজ নাদির রেজা এবং প্রিন্ট ক্যাটাগরিতে প্রথম স্থান অধিকার দৈনিক প্রথম আলোর সিনিয়র রিপোর্টার ফখরুল ইসলাম হারুণ এবং দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছেন দৈনিক সমকাল পত্রিকার বিশেষ প্রতিনিধি হকিকত জাহান হকি। প্রথম পুরস্কার হিসেবে রয়েছে নগদ ৫০ হাজার টাকা, ক্রেস্ট ও সার্টিফিকেট এবং দ্বিতীয় পুরস্কার হিসেবে রয়েছে নগদ ৪০ হাজার টাকা ও ক্রেস্ট ও সার্টিফিকেট।

পিবিএ/এএইচ

আরও পড়ুন...