মেধাবীরা যে কারণে সাংবাদিকতা ছাড়ছেন?

শান্তনু চৌধুরী: একটা সময় তরুণ-তরুণীদের স্বপ্নের পেশা ছিল সাংবাদিকতা। সাহসী ও চ্যালেঞ্জিং পেশা হিসেবে সাংবাদিকতাকেই বেছে নিতেন তারা। এখন বোধহয় সময় এসেছে কথাটি বদলানোর। দেশের পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সাংবাদিকতা বিষয়ে পড়াশোনার হার বাড়ছে। কিন্তু পড়াশোনা শেষে শিক্ষার্থীদের সাংবাদিকতায় আসার হার বাড়ছে না। আবার যারা এসেছেন, তাদের অনেকেই এই পেশা ছেড়েছেন, আর যারা আছেন, তাদের কেউ কেউ ছাড়ার অপেক্ষায় আছেন। সুযোগ পেলেই অন্য কোনও চাকরিতে চলে যাচ্ছেন তারা। গেলো এক বছরে আমার পরিচিত অনেকেই সাংবাদিক পেশা ছেড়েছেন। বিশেষ করে মেধাবী সাংবাদিকরা, যাদের রিপোর্ট আলোচনায় ছিল, যারা নজরকাড়া প্রতিবেদন করেছিলেন, তেমন কেউ যখন সাংবাদিকতা ছেড়ে দেন, তখন বিষয়টি বেশ আলোচনায় আসে।

গেলো ১৪ জুলাই পেশা ছেড়ে দেওয়ার কারণে ১১০ দশ জনের সদস্যপদ স্থগিত করে ঢাকা রিপোটার্স ইউনিটি। এর মধ্যে প্রবাসে চলে গেছেন ৬০জন। আর ৫০ জন পেশা বদল করেছেন। ডিআরইউ-এর সদস্য নন, এমন সাংবাদিকও পেশা ছেড়েছেন অনেকে। বিশেষ করে গেলো একমাসে পাঁচজন সাংবাদিক তাদের পেশা বদল করে কেউ করপোরেট কোম্পানিতে, কেউবা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে যোগ দিয়েছেন। এই পেশার জন্য এটি মেধার একটি বড় অপচয়! অথচ সংবাদমাধ্যমের ঊর্ধ্বতম কতৃপক্ষরা কখনও বসেছে বা ভেবেছে বলে মনে হয় না—কেন একজন মেধাবী সাংবাদিক তার পেশা বদল করছেন, কেন তরুণরা এই পেশায় আর আসতে চাইছেন না।
যারা এখনও পেশায় আছেন, তারাই বা কেন হতাশ, অনুশোচনায় ভুগছেন? আমরা বলে থাকি, একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হচ্ছে সংবাদমাধ্যম। সংবাদমাধ্যম তথা সাংবাদিকদের পেশা ছেড়ে দেওয়ার এই প্রবণতা এটাই ইঙ্গিত বহন করে যে, এদেশের গণতান্ত্রিক ভিত্তি ধীরে ধীরে অচল হয়ে পড়ছে। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো ঠিকভাবে কাজ করতে পারছে না বা করছে না। পুরো গণমাধ্যমই এখন কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। দিনে দিনে এই সমস্যা আরও বাড়বে বলেই আমার মনে হয়। এর কারণ সংবাদ মাধ্যমের ওপর থেকে মানুষের আস্থা উঠে যাচ্ছে। মানুষ প্রকৃত ঘটনা জানতে চায়। কিন্তু যে কোনও সাধারণ পাঠক, দর্শক বা শ্রোতার কাছে জানতে চান, তারা অনায়াসে বলবেন, গণমাধ্যমের কাছে যা চান, সেটি তারা পাচ্ছেন না। অনেক সময় এমনও হয়ে থাকে, কোনও একটি সংবাদ প্রচার হচ্ছে, কিন্তু মাঝপথে সেটি বন্ধ হয়ে গেলো। মানে এর কোনও ফলোআপ নেই। ‘ওই সংবাদ নেই কেন’–এর কোনও সদুত্তর দিতে পারেন না সংবাদকর্মীরা।

সংসদে দেওয়া তথ্যমন্ত্রীর তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখন দৈনিক পত্রিকা রয়েছে এক হাজার ২৪৮টি, এর মধ্যে ঢাকায় ৫০২টি এবং সারাদেশে ৭৪৬টি। টেলিভিশন চ্যানেল রয়েছে ৩২টি। এছাড়া সারাদেশে সাপ্তাহিক পত্রিকা রয়েছে এক হাজার ১৯২টি, মাসিক ৪১৪টি। এর বাইরে ২ হাজার ২১৭টি অনলাইন মিডিয়া রয়েছে। আরও আছে, অনলাইন পত্রিকা, অনলাইন টেলিভিশন ও রেডিও। অথচ হিসাব নিলে দেখা যাবে, হাতেগোনা কয়েকটি সংবাদমাধ্যম নিয়মিত বেতনভাতা পরিশোধ করছে। চাকরির অনিশ্চয়তা, পেশাদারিত্বের অভাবের কারণে অনেক মেধাবী সাংবাদিক এখন আর এই পেশায় থাকছেন না। মুখে যতই বলি না কেন এদেশে সাংবাদিকতা এখনও পেশা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এই পেশা অনিশ্চয়তায় ভরা। কাজের স্থায়িত্ব বা নিশ্চয়তা নেই। তাই ক্যারিয়ার হিসেবে তরুণরা সাংবাদিকতাকে আর বেছে নিতে পারছেন না। অনেকেই হয়তো আপদকালীন হিসেবে সাংবাদিকতায় আসছেন কিন্তু পরে সুযোগ বুঝে ছেড়ে দিচ্ছেন এই পেশা। কেউবা পার্টটাইম করছেন, তাও শখের বসে। মিডিয়া সেক্টরে পেশাদারিত্ব নেই বলেই পেশার প্রতি আগ্রহ বা ঝোঁকও নেই।

যারা মিডিয়ার মালিক, যারা মিডিয়া চালান তারা অনেকেই আবার মিডিয়াকে দেখেন তাদের অন্য ব্যবসা রক্ষার হাতিয়ার হিসেবে। এতে নিজেরা বা তাদের প্রতি ভক্তিতে গদগদ থাকা কিছু সাংবাদিক লাভবান হলেও ক্ষতিতে থাকে বিশাল একটি অংশ।

অবাক করার বিষয় হলো, এখনও নাকি তথ্যমন্ত্রণালয়ে সংবাদপত্র বা টিভির আবেদন জমা পড়ে আছে শতশত। প্রধানমন্ত্রীল ব্রুনাই সফর শেষে গণভবনে যে সংবাদ সম্মেলনে হয়েছিল, সেখানে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানালেন এই তথ্য। সেই অনুষ্ঠানে সিনিয়র সাংবাদিকরা সংবাদমাধ্যমের দুর্দিনের কথা তুলে ধরলে তিনি এই তথ্য জানান। সংবাদমাধ্যমের লাইসেন্স চাওয়ার বিষয়টিকে প্রধানমন্ত্রী ভালোভাবে দেখতে চাইলেও বাস্তবতা হচ্ছে, মালিকরা হয়তো ভালো আছেন। নানা সুযোগ সুবিধা পাচ্ছেন। কিন্তু বেশ কয়েকটি সংবাদ মাধ্যমে কর্মচারীরা মাসের পর মাস বেতনহীনই থাকছেন। গার্মেন্টসেও কর্মী ছাঁটাই নীতিমালা আছে। শ্রম আইন আছে। কিন্তু সংবাদ মাধ্যমের ক্ষেত্রে দেখা যায় কোনও নীতিমালার তোয়াক্কা নেই।

যারা নিয়মনীতি কিছুটা মানেন, তাদেরও ভাবটা এমন, ‘অন্যরা তো দিচ্ছে না, আমরা তাও দিচ্ছি’। এসব কারণে হলফ করে বলা যাবে, সংবাদকর্মীদের বেশিরভাগই আজ অসুখী। প্রতিনিয়ত তাদের মাঝে টেনশন কাজ করে। এই বুঝি চাকরি হারাতে হলো। এছাড়া হরহামেশাই কর্মী ছাঁটাই তো চলছেই। যারা পারছেন পেশা বদল করছেন, বিদেশ যাচ্ছেন আর যারা মাসের পর মাস বেতন পাচ্ছেন না, তারা অনেকে ঢাকা শহর থেকে পরিবারকে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। সন্তান নিয়ে কষ্ট আর কতটা সহ্য করা যায়। এছাড়া বাসাভাড়া সময়মতো দিতে না পারলে কে থাকতে দেবে? অন্যপেশায় যেখানে দেখা যায়, অভিজ্ঞ ও মেধাবীদের মূল্যায়ন বেশি এই পেশায় তার উল্টো। বয়স হলেই চাকরি হারানোর আতঙ্ক। বেশি মেধাবী হওয়ার দরকার নেই। টিভি হলে হাতে ‘বুম’ আর কিছুটা লিখতে জানলেই হলো। এসব কারণে কমে যাচ্ছে মেধাবী সাংবাদিকের সংখ্যা। এত এত সাংবাদিক সংগঠন হচ্ছে, বড় বড় নেতা সৃষ্টি হচ্ছে কিন্তু সংবাদকর্মীদের রুটি রুজির প্রশ্নে কোনও অগ্রগতি নেই। বরং তাদের অনেকের লেখা বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই মন্তব্যে হতাশার চিত্রই ফুটে উঠছে। একজন মানুষের চাকরি হারানো মানে শুধু তার চাকরি হারানো নয়, তার সামাজিক মর্যাদা, দৈনন্দিন চলাফেরা—সর্বোপরি একটি পরিবার যেন পতনের দিকে এগিয়ে যাওয়া।

সংবাদমাধ্যমের দুর্দিনের আরও একটি কারণ হলো বিজ্ঞাপন কমে যাওয়া। যে হারে গণমাধ্যমের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, সে হারে কিন্তু বিজ্ঞাপনের বাজার বাড়েনি। আগে বিজ্ঞাপন অফিসে আসতো আর এখন বিজ্ঞাপনের জন্য নানা তদ্বির লাগে। সাংবাদিকদের একট অংশ এখন নির্ভর হয়ে পড়েছেন দৈনন্দিন সংবাদ মানে ডেজ ইভেন্ট বা প্রেস রিলিজের ওপর। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা নেই বললেই চলে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে সাংবাদিক ‘ম্যানেজ’ হয়ে যাচ্ছে। যে কারণে অসি এখন মসির চেয়ে শক্তিশালী। সংবাদপত্র শিল্পের এমন দুর্দিন আমরা দেখেছি সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ও। তখন সেনাপ্রধান মইন উ আহমদ সম্পাদকদের সঙ্গে বৈঠকে বলেছিলেন, ‘বর্তমান সরকার সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী এবং অতীতের মতো গণমাধ্যমের ব্যাপারে স্পর্শকাতর নয়।’ কিন্তু ওই সময় দুর্নীতির অভিযোগ এনে গ্রেফতার করা হয়েছিল অনেক সংবাদমাধ্যমের মালিক ও সম্পাদককে।

বর্তমান প্রধানমন্ত্রীও মালিকদের সম্পদ ও দুর্নীতি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করতে বলেছেন সংবাদকর্মীদের। বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম যে খারাপ সময় পার করছে তা সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনেও প্রকাশ পেয়েছে। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে চার ধাপ অবনমনের মধ্য দিয়ে সাত বছরের মধ্যে সবচেয়ে বাজে অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। প্যারিসভিত্তিক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারসের করা এই বার্ষিক সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান এবার ১৮০ দেশের মধ্যে ১৫০তম। ২০১৯ সালের ‘ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স’ বলছে, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সাংবাদিকদের অধিকারের প্রশ্নে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশই সবচেয়ে পিছিয়ে। বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ যে কঠোর পথ বেছে নিয়েছে, তার শিকার হতে হচ্ছে সাংবাদিকদেরও।’ অবশ্য আমাদের তথ্যমন্ত্রী এই প্রতিবেদন মানতে রাজি নন। তিনি বলেছেন, লন্ডনের চেয়ে বাংলাদেশের সাংবাদিকরা বেশি স্বাধীনতা ভোগ করছেন। চলমান অস্থিরতা ও হতাশা আরও বাড়িয়ে দেয় প্রশাসনের উচ্চপদে থাকা কর্মকর্তারা যখন সাংবাদিকদের সবক দেন, কীভাবে সাংবাদিকতা করতে হবে তা শেখান এবং আত্মহত্যা করার প্ররোচনাও দেন। প্রশাসনের এমন বক্তব্য সাংবাদিকদের মধ্যে ভীতি সৃষ্টি করে। এমনিতে তথ্য প্রবাহ আইন, ৫৭ ধারার মতো আইন নিয়ে ভয়ে থাকেন সংবাদ কর্মীরা।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রায় সময় গর্ব করে বলেন, তিনি তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করতে অনেকগুলো টিভির লাইসেন্স দিয়েছেন। সংবাদমাধ্যম বাড়িয়েছেন। অনেকের কর্মসংস্থান হয়েছে। একথা সত্য বটে। কিন্তু এই শিল্প যে ধুঁকে ধুঁকে চলছে, সেটি দেখার দায়িত্বও কিন্তু সরকারের রয়েছে। সেটি দিক-নির্দেশনা হতে পারে বা বিনিয়োগ বাড়াতে বেসরকারি খাতকে উৎসাহিত করেও হতে পারে। তবে এই উদ্যোগটা নিতে হবে এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত কর্তা ব্যক্তিদের। ভুলতে হবে নিজেদের মধ্যে দলাদলি ও ভেদাভেদ। ভাবতে হবে কেন একজন মেধাবী তরুণ এই পেশায় এসে হতাশায় থাকবেন, কেন পেশা ছাড়ার জন্য উন্মুখ হয়ে পড়বেন। একসময় একতা ছিল বলেই সরকার অন্যায় করতে ভয় পেতো। আর এখন থোড়াই কেয়ার করে। সেই একতাটা জরুরি। এই পেশায় যে অঢেল অর্থ নেই সেটি সংবাদকর্মী মাত্রই জানেন। সেটিকে কেয়ার না করাই একজন সাংবাদিকের শক্তি। এরপরও পরিস্থিতি উন্নতি হচ্ছিল। কিন্তু মালিকদের অতিলোভ, চাটুকার প্রবৃত্তি সেই প্রচেষ্টাকে আবারও নষ্ট করে ফেললো। অনেকেই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে হয়তো নিজেকে বদলে নিয়েছেন। কিন্তু যারা নীতি আর বেঁচে থাকার সঙ্গে আপস করতে পারেননি, তারা পেশা বদল করেছেন বা পেশা ছেড়ে বিদেশ পাড়ি দিয়েছেন। কারণ সংবাদপত্রের স্বাধীনতা বলুন আর আদর্শিক লড়াই বলুন, ভাত কাপড়ের নিশ্চয়তাটা আগে চাই।

লেখক: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক।

পিবিএ/বিএইচ

আরও পড়ুন...