মেধা : জন্মগত,না অর্জিত?

পিবিএ: চার বন্ধু একই স্কুলে লেখাপড়া করে। তাদের বার্ষিক পরীক্ষার ফল বের হল। দু’বন্ধু ভাল রেজাল্ট করল, বাকি দু’জন ফেল করল। জরিপে দেখা গেল, পাশ করা দু’জনের মধ্যে একজনের মা-বাবা কেউই মেধাবী নয়; কিন্তু সে মেধাবী। আবার কৃতকার্য হওয়া দ্বিতীয় জনের মা-বাবা উভয়েই মেধাবী। বন্ধুটি নিজেও মেধাবী। এবার ফেল করা ছাত্রদের কথা বলা যাক। তাদের একজনের মা-বাব কেউউ মেধাবী নয়, সে নিজেও নয়। অন্য ছাত্রটির মা-বাবা উভয়েই মেধাবী, কিন্তু সে নয়। এমন সব ঘটনা আমরা বাস্তব জীবনে প্রায়ই লক্ষ করে থাকি। এখন প্রশ্ন – কেন এমন হয়? মেধা কি জন্মগত, না অর্জিত, এ প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে আগে মানুষের ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে কিছু জানা প্রয়োজন। ব্যক্তিত্ব হলো ব্যক্তির সেই সত্তা যা ব্যক্তির আচরণকে সংগঠিত ও নিয়ন্ত্রিত করে। ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য, সহজাত প্রবৃত্তি, মানসিক প্রবণতা, ব্যক্তির আশা, কামনা, অভ্যাস, অভিজ্ঞতা, কল্পনাশক্তি, বুদ্ধি, দোষ-গুন – সবকিছুর সংমিশ্রণই হল ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব। আমরা কোনো ব্যক্তির কথাবার্তা, চিঠি, নাম, হাতের লেখা, কাপড়-চোপড়, চেহারা প্রভৃতি দেখে বা শুনে তার ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে ধারণা নিতে পারি।
ব্যক্তিত্বহীন বলতে কেউ নেই। কম-বেশি সকল মানুষেরই ব্যক্তিত্ব আছে। আবার কেউ কেউ বলেন – লোকটি খুবই ব্যক্তিত্ববান। এটাও যুক্তিসঙ্গত নয়। মেধার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। সকল মানুষেরই কম-বেশি মেধা রয়েছে।
মেধা সম্পর্কে বিশেজ্ঞরা বিভিন্নভাবে তাদের মতামত ব্যক্ত করেছেন। কেউ বলেছেন ব্যাপারটি জন্মগত, আবার কেউ বলেছেন অর্জিত। মনোবিদ ফ্রয়েড একে বংশগত ব্যাপার বলে অভিহিত করেছেন। তিনি এও বলেছেন মেধাবিকাশের জন্য বংশগত ও পরিবেশগত দুটো উপাদানই প্রয়োজন। একজন কলামিস্টের কথাই ধরি। তিনি জন্মগতভাবেই লেখক হন না। অনেক জ্ঞান অর্জন, অধ্যয়ন ও লেখালেখির একপর্যায়ে অক্লান্ত চেষ্টার পর তিনি কলামিস্টের যোগ্যতা অর্জন করেন। তার মানে এটি তার অর্জিত মেধা। অন্যদিকে মেধাবী হাসিখুশি, চ লমনা, মিশুক মেয়েটির কথাই চিন্তা করি যার মা-বাবা, ভাই-বোন সবাই মেধাবী। মেয়েটিও অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী; বর্তমানে নিজেও প্রতিষ্ঠিত। এ অবস্থায় আমরা বলে থাকি, বংশগতভাবেই মেয়েটি মেধাবী। তাহলে বোঝা গেল, কখন মেধা জন্মগত, আর কখন মেধা অর্জিত।
মানুষের মধ্যে দু ধরনের উপাদান লক্ষ করা যায় – একটি ইতিবাচক এবং অপরটি নেতিবাচক। উভয় উপাদানই বংশগত ও পরিবেশগত প্রভাবে সৃষ্ট। মানুষের ইতিবাচক দিকগুলো হল – বুদ্ধিমত্তা, স্বাধীনচেতা, মনোভাব, নির্ভরযোগ্য, আত্নপ্রতিষ্ঠা, শান্ত মনোভাব, মিশুক স্বভাব, মার্জিত আচরণ, অধ্যবসায়, বিশ্বস্ততা প্রভৃতি। নেতিবাচক দিকগুলো হল ভীরুতা, লজ্জা, নির্বুদ্ধিতা, অস্থিরতা, বিষণ্নতা, পরনির্ভরতা, নিষ্ঠুরতা, হীনম্মন্যতা, নির্জীবতা, শত্রুতা প্রভৃতি।
মেধার বিকাশ ও উন্নয়নের চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীরা বলেন- পুষ্টিকর খাদ্যগ্রহণ, দুশ্চিন্তাহীন মন, সুস্থ দেহ ও চাহিদা পূরণের মাধ্যমে মেধার উৎকর্ষতা সম্ভব। ছাত্রদের প্রতিভা বিকাশের জন্য পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে চারুকলা, সংগীত, খেলাধুলা, পাঠ-বহির্ভূত বই অধ্যয়ন প্রভৃতি বিষয়গুলোর দিকে মনোযোগ দিতে হবে।
প্রতিটি মানুষের ভেতরেই সৃজনশক্তি লুকিয়ে আছে। কিন্তু সৃজনশীল প্রতিভা বলতে যা বোঝায় সেটা অন্য ব্যাপার। যেমন, আলবার্ট আইনস্টাইন, পাবলো পিকাসো – এদের সৃজনশীল প্রতিভা অতুলনীয় ও বিস্ময়কর। তবে তাঁদের সহযোগী স্রোত হিসেবে অনেকেই নিজেদের তুলে ধরতে সক্ষম হন। অনেকে লিখতে পারেন ভালো, অভিনয় করতে পারেন ভালো, অনেকে গান গাইতে পারেন, কিন্তু এমনভাবে পারেন না, যাতে তাকে টি.এস. ইলিয়ট, চার্লি চ্যাপলিন বা এলভিস প্রিসলি মনে করা যেতে পারে। তবে হ্যাঁ আমরা নিজেদের মতো করে মেধাকে নির্মাণ করতে পারি। এ জন্য দরকার সচেতনতা।
চার্লস ডারউইনের কথাই ধরি, যিনি জৈব বিবর্তন ও মানুষের উদ্ভব সম্পর্কে চা ল্য সৃষ্টিকারী গবেষণা তত্ত্ব উপস্থাপন করেছেন মানুষের সামনে। প্রথম জীবনে কোথাও কোনো পাত্তা পান নি। হতাশার কালো ধোঁয়ায় ছেয়ে গিয়েছিল তাঁর জীবন। কিন্তু উত্তরকালে বিরাট সম্মানের জন্য প্রস্তুত হতে হয়েছিল তাঁকে। আর এটি তো সত্য, এরকম ব্যক্তি ছাড়া মানবপ্রগতিও সম্ভব নয়।
মেধার বিকাশে জন্মগত ও পরিবেশগত উভয় প্রভাবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি মানুষেরই ভেতর লুকিয়ে আছে প্রতিভা নামক শব্দটি। আর এর বিকাশের দায়িত্ব নিতে হবে আমাদের সকলেরই। আমরা আমাদের ভিতরের সৃজনশীলতা প্রকাশের মাধ্যমে আমাদের মেধার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটাতে পারি।
প্রতিভা বিকশিত হয় পরিশ্রমের মাধ্যমে। প্রতিভা একটি ফসলের ক্ষেতের মতো। যে যত পরিশ্রম ও সাধনা করবে, সে তত ভালো ফসল পাবে এবং তার মেধার জমিও ততই ঊর্বর হবে। পৃথিবীতে যারা বড় হয়েছেন, তারা পরিশ্রম ও সাধনার জোরে বড় হয়েছেন। বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী নিউটন বলেছেন, ‘আমার আবিষ্কারের কারণ আমার প্রতিভা নয়; বহু বছরের পরিশ্রম ও নিরবচ্ছিন্ন চিন্তার ফলেই আমি আমাকে সার্থক করেছি। আমার মনের সামনে যখন যা আসে, তখন তারই মীমাংসায় ব্যস্ত থাকতাম, অস্পষ্টতা সরিয়ে ধীরে ধীরে স্পষ্টতা অর্জন করেছি।’
ভলটেয়ার বলেছেন, ‘প্রতিভা বলে কোনো জিনিস নেই। পরিশ্রম কর, সাধানা কর – প্রতিভা অর্জন করতে পারবে।’
ডালটনকে লোকে প্রতিভাবান বলত। তিনি অস্বীকার করে বলতেন, ‘পরিশ্রম ছাড়া আমি কিছু জানি না। পরিশ্রম, পর্যবেক্ষণ ও সাধনার সামনে কিছুই অস্পষ্ট নয়।’
স্যার রবার্ট পিল যখন বালক, তখন তার বাবা তাকে একটা ছোট টেবিলের উপর তুলে দিয়ে বক্তৃতা দিতে বলতেন। প্রথম প্রথম কিছু হতো না, কিন্তু বারে বারে চেষ্টা করার ফলে তার মধ্যে শক্তি জেগে উঠল। শেষ বয়সে অসাধারন বক্তৃতা দেয়ার ক্ষমতা অর্জন করেন। তিনি বলতেন, তার অসাধারণ এ ক্ষমতা ছোট বেলারই সাধনার ফসল।
ডা: লুৎফর রহমান বলেছেন, ‘প্রতিভাকে যদি সাধনা বা পরিশ্রম দ্বারা উজ্জ্বল করে তোলা না যায়, তবে তার আদর হয় না।’
এবার নিশ্চয়ই আমরা বুঝতে পেরেছি, মানুষ প্রতিভা নিয়ে পৃথিবীতে আসে না। বরং পরিশ্রম ও সাধনার বলে তারা প্রতিভা অর্জন করেছে। তবে পরিশ্রম করা চাই সঠিক পদ্ধতিতে। তবেই মেধা অর্জন করা যাবে।

লেখক, জহির উদ্দিন প্রভাষক(ব্যবস্থাপনা) প্রিন্সিপাল কাজী ফারুকী কলেজ। রাখালিয়া, রায়পুর, লক্ষ্মীপুর।

পিবিএ/বাখ

আরও পড়ুন...