যাকাতের তাৎপর্য ও নির্ণয়ের পদ্ধতি

প্রতীকি ছবি

ফরহাদ হোসেন চৌধুরী

‘‘তোমরা নামায কায়েম কর, যাকাত দাও এবং রাসূলের আনুগত্য কর, যাতে তোমরা অনুগ্রহ-ভাজন হতে পার।’’ (সূরা নূর-৫৬) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘হে মু’আয! তুমি জানিয়ে দাও আল্লাহ তাদের সম্পদের উপর যাকাত ফরয করেছেন, যা ধনী ব্যক্তিদের থেকে নিয়ে দরিদ্র ব্যক্তিদের মাঝে বিতরণ করা হবে।’’ (বুখারী, মুসলিম ও তিরমিযি)

যাকাত কি?

যাকাত ইসলামের মৌলিক ইবাদত সমূহের মধ্যে অন্যতম ইবাদত।প্রত্যেক মুসলমানকে যেমন যাকাত ফরয হওয়ার বিষয় সম্পর্কে বিশ্বাস করতে হবে, ঠিক তেমনিভাবে যার উপর যাকাত ফরয তাকে তা নিয়মিত পরিশোধও করতে হবে। পবিত্র কুরআনের ২৮ স্থানে নামাযের পাশাপাশি যাকাত প্রদানের হুকুম দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘‘তোমরা নামায কায়েম কর, যাকাত প্রদান কর এবং রুকুকারীদের সাথে রুকু কর’’ (সূরা বাক্বারা, আয়াত-৪৩)। মহানবী (সা.) বলেন, ‘‘ইসলামের ভিত্তি পাঁচটি স্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত। আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কোন মাবুদ নাই এবং মুহাম্মাদ (সা.) আল্লাহর প্রেরিত রাসূল- এতে সাক্ষ্য দেয়া, নামায প্রতিষ্ঠা করা, যাকাত দেয়া, শারীরিক ও আর্থিক সামর্থ্য থাকলে হজ্জ্ব করা এবং রমযান মাসে রোযা রাখা।’’ (বুখারী ও মুসলিম)

যাকাত ফরয হওয়ার নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক সকল মুসলিম নর-নারীর উপর যাকাত প্রদান করা ফরয। কোন ব্যক্তি নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হওয়ার পর চাঁদের হিসাবে পরিপূর্ণ এক বছর অতিবাহিত হলে তার উপর পূর্ববর্তী বছরের যাকাত প্রদান করা ফরয। অবশ্য যদি কোন ব্যক্তি যাকাতের নিসাবের মালিক হওয়ার পাশাপাশি ঋণগ্রস্ত হয়, তবে ঋণ বাদ দিয়ে নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হলে তার উপর যাকাত ফরয হবে। যাকাত ফরয হওয়ার পর যদি কোন ব্যক্তি যাকাত প্রদান না করে অর্থ-সম্পদ খরচ করে ফেলে তাহলেও তার পূর্বের যাকাত দিতে হবে।

যাকাত বহির্ভূত সম্পদ জমি, বাড়ি-ঘর, দালান, দোকানঘর, কারখানা, কারখানার যন্ত্রপাতি, কলকব্জা, যন্ত্রাংশ, কাজের যন্ত্র, হাতিয়ার, অফিসের আসবাবপত্র ও সরঞ্জাম, যানবাহনের গাড়ি, নৌকা, লঞ্চ, জাহাজ, বিমান ইত্যাদি, যানবাহন বা চলাচলের অথবা চাষাবাদের পশু, ব্যবহারিক গাড়ি, ব্যবহারিক কাপড়-চোপড়, ঘরের আসবাবপত্র ও সরঞ্জামাদি, নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যবহার্য সামগ্রী, গৃহপালিত পাখি, হাঁস-মুরগি ইত্যাদির যাকাত হয় না।

শস্য ও গবাদি পশুর যাকাত পরিশোধ করার পর ঐ শস্য বা গবাদি পশু বিক্রি করে নগদ অর্থ প্রাপ্ত হলে ঐ প্রাপ্ত অর্থের উপর একই বছরে যাকাত দিতে হবে না। কারণ একই সম্পদের একই বছরে দুইবার যাকাত হয় না। মৌলিক প্রয়োজনীয় সম্পদ ‘মৌলিক চাহিদা’ কথাটি দ্বারা প্রচলিত প্রথা ও রীতি অনুযায়ী সামাজিক সংহতি ও সম্পূর্ণতা অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রিকে বুঝায়। একজন মুসলমান অপচয় বা কার্পণ্য ছাড়াই তার পরিবারের অন্যান্য প্রয়োজন মিটাবে। মৌলিক ও নিত্য প্রয়োজনীয় সম্পদের যাকাত হয় না। এসব সম্পদ বলতে বুঝায়, বসবাসের ঘর, পেশাগত সামগ্রী, কারখানার যন্ত্রপাতি, যোগাযোগের বাহন, ঘরের আসবাপত্র, তৈজসপত্র, খাদ্যদ্রব্য, পোশাক-পরিচ্ছদ, গৃহস্থালীর সামগ্রী ইত্যাদি এবং নিজের, তার উপর সরাসরি নির্ভরশীলদের ও নির্ভরশীল আত্মীয়-স্বজনদের জন্য দৈনন্দিন খরচসমূহ।

যাকাত ধার্য হওয়ার ব্যাপারে একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হল যার উপর যাকাত আরোপিত হবে তার নিকট একান্ত চাহিদা পূরণের পর অতিরিক্ত সম্পদ থাকতে হবে। যে অর্থ বা সম্পদ প্রয়োজনের অতিরিক্ত বলে বিবেচিত হয় এবং পরবর্তী বছরের জন্য সংরক্ষিত থাকে, তা যাকাতের নিসাব নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিবেচিত হবে। যাকাতের নিসাব রূপা ৫৯৫ গ্রাম (৫২.৫০ ভরি) কিংবা স্বর্ণ ৮৫ গ্রাম (৭.৫০ ভরি) অথবা স্বর্ণ বা রূপা যে কোন একটির নিসাবের মূল্য পরিমাণ অর্থ-সম্পদ বা ব্যবসায়িক সামগ্রীকে যাকাতের নিসাব বলে।

কোন ব্যক্তির মৌলিক প্রয়োজন পূরণের পর যদি নিসাব পরিমাণ সম্পদ তার মালিকানায় থাকে এবং চন্দ্র মাসের হিসাবে এক বছর তার মালিকানায় স্থায়ী থাকে তাহলে তার উপর এ সম্পদ থেকে চল্লিশ ভাগের এক ভাগ যাকাতরূপে প্রদান করা ফরয।

মনে রাখতে হবে বছরের শুরু ও শেষে এ নিসাব বিদ্যমান থাকা জরুরী। বছরের মাঝখানে এ নিসাব পূর্ণ না থাকলেও যাকাত প্রদান করতে হবে। সম্পদের প্রত্যেকটি অংশের উপর এক বছর অতিবাহিত হওয়া শর্ত নয় বরং শুধু নিসাব পরিমাণের উপর বছর অতিবাহিত হওয়া শর্ত।

অতএব, বছরের শুরুতে শুধু নিসাব পরিমাণ অর্থ-সম্পদ থাকলেও বছরের শেষে যদি সম্পদের পরিমাণ বেশি হয় তাহলে ঐ বেশি পরিমাণের উপর যাকাত প্রদান করতে হবে। বছরের যে কোন অংশে অধিক সম্পদ যোগ হলে তা পূর্ণ এক বছর অতিবাহিত হওয়া শর্ত নয়। যাকাত ফরয হওয়ার ক্ষেত্রে মূল নিসাবের উপর বছর অতিক্রম করা শর্ত। যাকাত, যাকাতুল ফিতর, কুরবানী এবং হজ্ব এ সকল শরীয়তের বিধান সম্পদের মালিকানার সাথে সম্পৃক্ত।

যে সকল সম্পদের যাকাত ফরয (১) স্বর্ণ-রূপা ও নগদ অর্থ ও (২) বাণিজ্যিক পণ্য (৩) মাঠে বিচরণকারী গবাদি পশু (৪) শস্য ও ফলমূল।

স্বর্ণ ও রূপার যাকাত

যদি কারো নিকট ৮৫ গ্রাম বা ৭.৫০ ভরি (১ ভরি = ১১.৬৬৪ গ্রাম) স্বর্ণ অথবা ৫৯৫ গ্রাম (৫২.৫০ ভরি) রূপা থাকে তাহলে তার উপর যাকাত ফরয। স্বর্ণ-রূপা চাকা হোক বা অলঙ্কার, ব্যবহৃত বা অব্যবহৃত, স্বর্ণ বা রৌপ্য নির্মিত যে কোন বস্তু, সর্বাবস্থায় স্বর্ণ-রূপার যাকাত ফরয। হীরা, ডায়মন্ড, হোয়াইট গোল্ড, প্লাটিনাম প্রভৃতি মূল্যবান ধাতু যদি সম্পদ হিসাবে বা টাকা আটকানোর উদ্দেশ্যে ক্রয় করা হয়, তাহলে বাজার মূল্য হিসাবে তার যাকাত দিতে হবে। অলঙ্কারসহ সকল প্রকার স্বর্ণ-রূপার যাকাত দিতে হবে। হাদীসে বর্ণিত আছে, একদা দু’জন মহিলা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট আসল। তাদের দু’জনের হাতে স্বর্ণের কঙ্কন ছিল। তখন নবী করীম (সা.) তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘তোমরা কি পছন্দ করবে যে, আল্লাহ তায়ালা তোমাদেরকে আগুনের দু’টি বালা পরিয়ে দিবেন’’? তারা দু’জন বলল, ‘‘না’’। তখন নবী (সা.) বললেন, ‘‘তাহলে তোমরা এ স্বর্ণের যাকাত প্রদান কর’’। (তিরিমিযি)

নগদ অর্থের যাকাত

নগদ অর্থ, টাকা-পয়সা, ব্যাংকে জমা, পোস্টাল সেভিংস, বৈদেশিক মুদ্রা (নগদ, এফসি একাউন্ট, টিসি, ওয়েজ আর্নার বন্ড), কোম্পানির শেয়ার, মিউচুয়াল ফান্ড, ঋণপত্র বা ডিবেঞ্চার, বন্ড, সঞ্চয়পত্র, জমাকৃত মালামাল (রাখী মাল), প্রাইজবন্ড, বীমা পলিসি (জমাকৃত কিস্তি), কো-অপারেটিভ বা সমিতির শেয়ার বা জমা, পোস্টাল সেভিংস সার্টিফিকেট, ডিপোজিট পেনশন স্কিম কিংবা নিরাপত্তামূলক তহবিলে জমাকৃত অর্থের যাকাত প্রতি বছর যথা নিয়মে প্রযোজ্য হবে। প্রতিষ্ঠানের রীতি অনুযায়ী বাধ্যতামূলকভাবে চাকরিজীবীর বেতনের একটি অংশ নির্দিষ্ট হারে কর্তন করে ভবিষ্য তহবিলে জমা করা হলে ঐ অর্থের উপর যাকাত ধার্য হবে না, কারণ ঐ অর্থের উপর চাকরিজীবীর কোন নিয়ন্ত্রণ থাকে না। কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ভবিষ্য তহবিলের অর্থ ফেরত পাওয়ার পর যাকাতের আওতাভুক্ত হবে। ঐচ্ছিকভাবে (অপশনাল) ভবিষ্য তহবিলে বেতনের একটা অংশ জমা করা হলে তার উপর যাকাত প্রযোজ্য হবে অথবা বাধ্যতামূলক হারের চাইতে বেশি হারে এই তহবিলে বেতনের একটা অংশ জমা করা হলে ঐ অতিরিক্ত জমা অর্থের উপর বছরান্তে যাকাত প্রযোজ্য হবে। চাকরিজীবীর অন্যান্য সম্পদের সাথে এই অর্থ যোগ হয়ে নিসাব পূর্ণ হলে যাকাত প্রদান করতে হবে। পেনশনের টাকাও হাতে পেলে যাকাত হিসেবে আসবে। মান্নত, কাফফারা, স্ত্রীর মোহরের জমাকৃত টাকা, হজ্ব ও কুরবানির জন্য জমাকৃত টাকার উপরেও বছরান্তে যথানিয়মে যাকাত দিতে হবে। ব্যাংক জমা বা সিকিউরিটির (ঋণপত্র বা ডিবেঞ্চার, বন্ড, সঞ্চয়পত্র ইত্যাদি) উপর অর্জিত সুদ ইসলামের দৃষ্টিতে বৈধ উপার্জন নয় বিধায় যাকাতযোগ্য সম্পদের সঙ্গে যোগ করা যাবে না। অর্জিত সুদ কোন জনহিতকর কাজে ব্যয় করতে হবে। তবে মূল জমাকৃত অর্থের বা সিকিউরিটির ক্রয় মূল্যের উপর যাকাত প্রদান করতে হবে। ব্যাংক জমার উপর বৈধ মুনাফা প্রদান করা হলে ঐ মুনাফা মূল জমার সঙ্গে যুক্ত করে যাকাতযোগ্য অন্যান্য সম্পত্তির সাথে যোগ করতে হবে। বৈদেশিক মুদ্রার উপর যাকাত যাকাত প্রদানের সময় উপস্থিত হলে মালিকানাধীন সকল বৈদেশিক মুদ্রার নগদ, ব্যাংকে জমা, টিসি, বন্ড, সিকিউরিটি ইত্যাদি যাকাত প্রদানকারী ব্যক্তির বসবাসের দেশের মুদ্রাবাজারে বিদ্যমান বিনিময় হারে মূল্য নির্ধারণ করে অন্যান্য যাকাতযোগ্য সম্পদের সাথে যোগ করে যাকাত প্রদান করতে হবে। মোহরানার অর্থের উপর যাকাত ‘মাহর’ বিধানের মাধ্যমে ইসলাম নারীদের জন্য এক অনন্য অধিকার নিশ্চিত করেছে। কনে, বরের সাথে তার বিবাহ বন্ধনে স্বীকৃতির সম্মানীস্বরূপ, বরের কাছ থেকে মাহর (মোহরানা) পেয়ে থাকে। মাহর বাবদ প্রাপ্ত জমাকৃত অর্থের উপর যাকাত ধার্য হবে। মাহরের অর্থ নিসাব মাত্রার হলে অথবা অন্যান্য যাকাতযোগ্য সম্পদের সাথে যোগ হয়ে নিসাব পূর্ণ হলে যাকাত প্রদান করতে হবে। মোহরানার যে অর্থ আদায় করা হয়নি তার উপর যাকাত ধার্য হবে না, কারণ এই অর্থ তার আওতাধীনে নাই। প্রচলিত মুদ্রায় (টাকায়) ধার্যকৃত ‘মাহর’ বিয়ের সময় সাথে সাথে পরিশোধ না করে, বিলম্বে প্রদান করা হলে তা আর্থিক ক্ষতির কারণ হয়। বর্তমানকালে বিদ্যমান মুদ্রার ক্রমবর্ধমান মূল্য হ্রাসের ফলে এই পাওনা পরবর্তীতে যখন পরিশোধ করা হয়, তখন মাহরের বিনিময়ে প্রাপ্ত অর্থ একান্ত নগন্য বা তুচ্ছ পরিমাণ হয়ে যায়। শরীয়াহ বিশারদগণ এই সমস্যার সমাধানে দৃঢ় মত পোষণ করেন যে, প্রচলিত মুদ্রার পরিবর্তে স্বর্ণ বা রৌপ্যের পরিমাণের ভিত্তিতে ‘মাহর’ নির্ধারণ করা উচিত, যাতে করে বিবাহিত নারীদের এই অধিকার যথার্থভাবে সংরক্ষিত থাকে এবং পরবর্তীকালে প্রচলিত মুদ্রার মূল্যহ্রাসজনিত কারণে তাদের ক্ষতি হওয়া থেকে রক্ষা পায়। শেয়ার যৌথ মূলধনী কোম্পানির মোট মূলধনকে সমমূল্য বিশিষ্ট বহুসংখ্যক ক্ষুদ্রাংশে বিভক্ত করা হয়। এরূপ ক্ষুদ্রাংশগুলোকে শেয়ার বলে। শেয়ার মালিককে কোম্পানির নিট সম্পত্তির একজন অংশীদার হিসেবে গণ্য করা হয়। শেয়ার ক্রয়ের উদ্দেশ্য বৃহৎ কোম্পানির ব্যবসায় বিনিয়োগ, কোম্পানির আংশিক মালিকানা অর্জন এবং লভ্যাংশ বা মুনাফা উপার্জন করা। ইসলামের দৃষ্টিতে নিষিদ্ধ যেমন : অসামাজিক বা অনৈতিক ব্যবসায়ে লিপ্ত, নিষিদ্ধ পণ্য উৎপাদন ও বিক্রয় বা সুদী কারবার ও দৈবনির্ভর লেনদেনে নিয়োজিত কোম্পানির শেয়ার ক্রয় বৈধ নয়। কোম্পানি নিজেই যদি শেয়ারের উপর যাকাত প্রদান করে তাহলে শেয়ারমালিককে তার মালিকানাধীন শেয়ারের উপর যাকাত দিতে হবে না। কোম্পানি যাকাত প্রদান করতে পারবে যদি কোম্পানির উপ-বিধিতে এর উল্লেখ থাকে অথবা কোম্পানির সাধারণ সভায় এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় অথবা শেয়ার মালিকগণ কোম্পানিকে যাকাত প্রদানের ক্ষমতা প্রদান করেন।

কোম্পানি নিজে তার শেয়ারের উপর যাকাত প্রদান না করলে শেয়ার মালিককে নিম্নোক্ত উপায়ে যাকাত প্রদান করতে হবে :

১. শেয়ার মালিক যদি শেয়ারগুলো বার্ষিক লভ্যাংশ অর্জনের কাজে বিনিয়োগ করে, তাহলে যাকাতের পরিমাণ নিম্নোক্ত উপায়ে নির্ণয় করা হবে : (ক) শেয়ার মালিক যদি কোম্পানির হিসাবপত্র যাচাই করে তার মালিকানাধীন শেয়ারের বিপরীতে যাকাতযোগ্য সম্পদের পরিমাণ জানতে পারেন তাহলে তিনি ২.৫% হারে যাকাত প্রদান করবেন। (খ) কোম্পানির হিসাবপত্র সম্পর্কে যদি তার কোন ধারণা না থাকে তাহলে তিনি তার মালিকানাধীন শেয়ারের উপর বার্ষিক অর্জিত মুনাফা যাকাতের জন্য বিবেচ্য অন্যান্য সম্পত্তির মূল্যের সঙ্গে যোগ করবেন এবং মোট মূল্য নিসাব পরিমাণ হলে ২.৫% হারে যাকাত প্রদান করবেন।

২. শেয়ার মালিক যদি শেয়ার বেচাকেনার ব্যবসা (মূলধনীয় মুনাফা) করার জন্য শেয়ারগুলো ব্যবহার করেন তাহলে যেদিন যাকাত প্রদেয় হবে, শেয়ারের সেদিনের বাজার মূল্য ও ক্রয়মূল্যের মধ্যে যেটি কম তারই ভিত্তিতে মূল্যায়ন করে ২.৫% হারে যাকাত প্রদান করবেন। একজন শেয়ার মালিক ইচ্ছে করলে যে কোন সময় শেয়ার বিক্রি করে দিতে পারেন। কোম্পানির শেয়ার ক্রয় ও বিক্রয়ের এই স্বাধীনতা শেয়ার বাজারকে এমন পরিণতির দিকে নিয়ে যায় যে, কিছু ব্যক্তি নিজেদের স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে শেয়ারের মূল্য বাড়িয়ে বা কমিয়ে একটি সাধারণ ব্যবসা কার্যক্রমকে প্রায় জুয়াখেলায় পরিণত করে। ইহা ইসলামী শরীয়ার দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ অবৈধ। বাণিজ্যিক সম্পদের যাকাত ব্যবসার নিয়তে (পুনঃবিক্রয়ের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ মুনাফা অর্জনের জন্য) ক্রয়কৃত, আমদানি-রফতানি পণ্য, ট্রানজিট বা পরিবহন পণ্য, বিক্রয় প্রতিনিধির (এজেন্ট) কাছে রাখা পণ্যদ্রব্য ও মজুদ মালামালকে ব্যবসার পণ্য বলে। ব্যবসার পণ্যের উপর সর্বসম্মতভাবে যাকাত ফরয। এমনকি ব্যবসার উদ্দেশ্যে ক্রয়কৃত জমি, দালান বা যে কোন বস্তু অথবা মালামালের মূল্যের উপরও যাকাত প্রদান করতে হবে। বাকি বিক্রির পাওনা, এলজি মার্জিন ও আনুষঙ্গিক খরচ, ব্যবসার নগদ অর্থসহ অন্যান্য চলতি সম্পদ যাকাতের হিসাবে আনতে হবে। অন্যদিকে ব্যবসার দেনা যেমন বাকিতে মালামাল বা কাঁচামাল ক্রয় করলে কিংবা বেতন, মজুরি, ভাড়া, বিদ্যুৎ, টেলিফোন ও গ্যাস বিল, কর ইত্যাদি পরিশোধিত না থাকলে উক্ত পরিমাণ অর্থ যাকাতযোগ্য সম্পদ থেকে বাদ যাবে। যাকাত নির্ধারণের জন্য বিক্রেতা তার পণ্যের ক্রয়-খরচ মূল্যকে (ক্রয়মূল্যের সাথে ভাড়াসহ ক্রয় সংক্রান্ত অন্যান্য খরচ যোগ করে) হিসাবে ধরবেন। ‘‘আল্লাহতায়ালা ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে হারাম করেছেন।’’ (সূরা বাকারা-আয়াত-২৭৫)

উৎপাদিত পণ্য :

তৈরি বা উৎপাদিত পণ্য, উপজাত দ্রব্য, প্রক্রিয়াধীন গণ্য, উৎপাদন প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত কাঁচামাল ও প্যাকিং সামগ্রী ইত্যাদি যাকাতের আওতাভুক্ত হবে। যাকাত নির্ধারণের জন্য তৈরি বা উৎপাদিত পণ্যের মূল্যায়ন উৎপাদন খরচ মূল্যের অথবা পাইকারি বাজার দরের ভিত্তিতে হবে। প্রক্রিয়াধীন বা অসম্পূর্ণ পণ্যের মূল্যায়ন ব্যবহৃত কাঁচামাল ও অন্যান্য উপাদানের খরচের ভিত্তিতে করতে হবে। মজুদ কাঁচামাল এবং উৎপাদন প্রক্রিয়ায় কাঁচামালের সাথে ব্যবহৃত প্যাকিং সামগ্রী ক্রয়-খরচমূল্যের ভিত্তিতে হিসাব হবে এবং যাকাতের আওতাধীন পণ্যদ্রব্যসহ ব্যবসার নগদ অর্থ ও অন্যান্য চলতি সম্পত্তির সাথে যোগ করে যাকাত নির্ধারণ করতে হবে। উৎপাদন প্রক্রিয়ায় নিয়োজিত স্থায়ী সম্পদ যেমন- জমি, দালান, যন্ত্রপাতি, আসবাবপত্র, যানবাহন ইত্যাদির উপর যাকাত প্রযোজ্য হবে না।

স্থায়ী সম্পত্তির যাকাত

স্থায়ী সম্পত্তি বলতে বোঝায় জমি, দালানকোঠা, আসবাবপত্র, যন্ত্রপাতি, যানবাহন ইত্যাদি।

ক. বসবাস, ব্যবহার, উৎপাদন কাজে বা কার্য সম্পাদনের উদ্দেশ্যে, নিয়োজিত স্থায়ী সম্পত্তির উপর যাকাত ধার্য হয় না।

খ. আয় উপার্জনের জন্য ভাড়ায় নিয়োজিত স্থায়ী সম্পত্তি যেমন- গৃহ, দোকান, দালানকোঠা, জমি, যন্ত্রপাতি, গাড়ি, যানবাহন ইত্যাদির উপর যাকাত ধার্য হয় না। তবে এসব সম্পত্তি থেকে ভাড়া বাবদ অর্জিত নিট আয় অন্যান্য যাকাতযোগ্য সম্পত্তির সঙ্গে যোগ করে ২.৫% হারে যাকাত প্রদান করতে হবে।

গ. বেচাকেনার উদ্দেশ্যে নিয়োজিত স্থায়ী সম্পত্তি যেমন- জমি, গৃহ, দোকান, এপার্টমেন্ট, দালানকোঠা, আসবাবপত্র, যন্ত্রপাতি, গাড়ি, যানবাহন ইত্যাদি ব্যবসায়িক পণ্য বলে গণ্য করা হবে এবং এগুলোর মূল্যের উপর যাকাত ধার্য হবে।

ঋণ ও যাকাত

ঋণদাতার উপর যাকাত:

ক. আদায়যোগ্য ঋণ আদায় হওয়ার পর অন্যান্য যাকাতযোগ্য সম্পদের সাথে যোগ করে যাকাত প্রদান করতে হবে।

১. যে ঋণ নগদে বা কোন দ্রব্যের বিনিময়ে কারো কাছে পাওনা হয়, এরূপ ঋণ আদায় হওয়ার পর যাকাত দিতে হবে এবং বিগত বছরসমূহের যাকাত প্রদান করতে হবে।

২. যে পাওনা কোন দ্রব্য বা নগদ ঋণের বিপরীতে নয়, যেমন- উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত অস্থাবর সম্পদ, দান, অছিয়ত, মোহরানার অর্থ ইত্যাদি বাবদ প্রাপ্ত হয়। এরূপ ক্ষেত্রে আদায়ের পর যাকাত ধার্য্য হবে। এগুলোর উপর বিগত বছরসমূহের যাকাত প্রদান করতে হবে না।

খ. আদায় অযোগ্য বা আদায় হবার ব্যাপারে সন্দেহ থাকলে সে ঋণ যাকাতের হিসাবে আসবে না। যদি কখনও উক্ত ঋণের টাকা আদায় হয়, তবে কেবলমাত্র ১ (এক) বছরের জন্য উহার যাকাত দিতে হবে।

ঋণগ্রহীতার উপর যাকাত :

ক. ঋণগ্রহীতার ঋণের টাকা মোট যাকাতযোগ্য সম্পদ থেকে বাদ যাবে। কিন্তু যদি ঋণগ্রহীতার মৌলিক প্রয়োজনের অতিরিক্ত স্থায়ী সম্পত্তি (যেমন- অতিরিক্ত বাড়ি, দালান, এপার্টমেন্ট, জমি, মেশিনারী, যানবাহন, গাড়ি ও আসবাবপত্র ইত্যাদি) থাকে যাহা দ্বারা এরূপ ঋণ পরিশোধ করতে সক্ষম, তবে উক্ত ঋণ যাকাতযোগ্য সম্পদ থেকে বাদ যাবে না। খ. স্থাবর সম্পদের উপর কিস্তিভিত্তিক ঋণ (যেমন- হাউজিং লোন ইত্যাদি) যাকাতযোগ্য সম্পদ থেকে বাদ যাবে না। তবে বার্ষিক কিস্তির টাকা অপরিশোধিত থাকলে তা যাকাতযোগ্য সম্পদ থেকে বাদ যাবে। গ. ব্যবসায়ে বিনিয়োগের জন্য ঋণ নেয়া হলে উক্ত ঋণের টাকা যাকাতযোগ্য সম্পদ থেকে বাদ যাবে। কিন্তু যদি ঋণগ্রহিতার মৌলিক প্রয়োজনের অতিরিক্ত স্থায়ী সম্পত্তি থাকে তবে উক্ত ঋণ যাকাতযোগ্য সম্পদ থেকে বাদ যাবে না। ঘ. শিল্প-বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ঋণের টাকা যাকাতযোগ্য সম্পদ থেকে বাদ যাবে। তবে যদি ঋণগ্রহিতার মৌলিক প্রয়োজনের অতিরিক্ত স্থায়ী সম্পত্তি থেকে উক্ত ঋণ পরিশোধ করা যায় তবে তা যাকাতযোগ্য সম্পদ থেকে বাদ যাবে না। ঙ. যদি অতিরিক্ত স্থায়ী সম্পত্তির মূল্য ঋণের পরিমাণের চেয়ে কম হয়, তবে ঋণের পরিমাণ থেকে তা বাদ দিয়ে বাকি ঋণের টাকা যাকাতযোগ্য সম্পদ থেকে বাদ যাবে। বিলম্বে প্রদেয় বা পুনঃতফসিলিকৃত ঋণের বেলায় শুধুমাত্র ঋণের বার্ষিক অপরিশোধিত কিস্তি যাকাতযোগ্য সম্পদ থেকে বাদ যাবে।

পশুর যাকাত

উটের সর্বনিম্ন হিসাব পাঁচটি, গরু-মহিষের ত্রিশটি এবং ছাগল-ভেড়ার চল্লিশটি। তবে এ ধরনের পশু বছরের অর্ধেকের বেশি সময় মুক্তভাবে চারণভূমিতে খাদ্য গ্রহণ করলেই এসব পশুর উপর সংখ্যভিত্তিক যাকাত ধার্য হবে। ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে যেকোন পশুসম্পদ প্রতিপালন করা হলে সেগুলোকে ব্যবসায়িক পণ্য বলে গণ্য করা হবে এবং এদের উপর যাকাত সংখ্যার ভিত্তিতে নয়, মূল্যের ভিত্তিতে ধার্য হবে। ব্যবসার উদ্দেশ্যে খামারে পালিত মৎস্য, হাঁস-মুরগী, গরু-ছাগল ইত্যাদি এবং খামারে উৎপাদিত দুধ, ডিম, ফুটানো বাচ্চা, মাছের রেণু, পোনা ইত্যাদি ব্যবসার সম্পদ হিসাবে যাকাত প্রদান করতে হবে। প্রিয়নবী মুহম্মদ সা. পানিতে বাস করা অবস্থায় মাছ ক্রয়-বিক্রয় করতে নিষেধ করেছেন। মাছ যখন বিক্রির জন্য ধরা হবে তখনই এর যাকাত পরিশোধ করতে হবে।

শস্য ও ফলের যাকাত (উশর)

শস্য ও ফলমুলের যাকাতকে উশর বলে। জমি থেকে উৎপন্ন সকল প্রকার শস্য, শাকসবজি, তরি-তরকারি ও ফলের উপর যাকাত প্রযোজ্য। ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে বিনিয়োগ করা হলে বনজ বৃক্ষ, ঘাস, নলখাগড়া, ওষুধি বৃক্ষ, চা বাগান, রাবার চাষ, তুলা, আগর, ফুল, অর্কিড, বীজ, চারা, কলম ইত্যাদি যাকাতের আওতাভুক্ত হবে। ফসল আসার সাথে সাথে উশর পরিশোধ করতে হয়। এক্ষেত্রে বছর অতিক্রান্ত হওয়ার প্রয়োজন নাই। বছরে একাধিকবার ফসল আসলে একাধিবার উশর পরিশোধ করতে হবে। অনেক ধরনের ফল, ফসল ও শাক-সবজি একই সাথে কাটা বা উত্তোলন করা যায় না। যেমন-মরিচ, বেগুন, পেঁপে, লেবু, কাঁঠাল ইত্যাদির পরিপক্বতা বুঝে কিছু কিছু করে কয়েকদিন পর পর পুরো কৃষি মওসুমে বার বার উত্তোলন করা হয়। ফসলের মালিক যদি ফসলের আনুমানিক পরিমাণ নিরূপণ করতে সমর্থ হন এবং তা যদি নিসাব পরিমাণ হয় তবে প্রথম থেকেই প্রতি উত্তোলনের সাথে সাথে উশর (যাকাত) পরিশোধ করবেন। যদি মালিকের পক্ষে ফল-ফসলের পরিমাণ নিরূপণ করা সম্ভব না হয়, তবে তিনি প্রথম উত্তোলন থেকে ফসলের হিসাব রাখবেন এবং যখনই মোট উত্তোলিত ফসলের পরিমাণ নিসাব পরিমাণে পৌঁছবে তখনই ঐ দিন পর্যন্ত মোট উত্তোলিত ফসলের যাকাত পরিশোধ করবেন এবং তৎপরবর্তী প্রতি উত্তোলনের সাথে সাথে যাকাত পরিশোধ করবেন। জ্বালানি কাঠ, আসবাবপত্র ও গৃহনির্মাণে ব্যবহার উপযোগী বৃক্ষের ক্ষেত্রে এরূপ বৃক্ষ যখন কাটা হবে তখন এগুলোর উপর যাকাত প্রযোজ্য হবে, তা যত দীর্ঘ সময় পর কাটা হোক না কেন। যে জমিতে সেচ প্রয়োজন হয় না, প্রাকৃতিকভাবে সিক্ত হয়, তার ফসলের যাকাত হবে দশভাগের একভাগ (১০%) আর যে জমিতে সেচের প্রয়োজন হয়, তার ফসলের যাকাত হবে বিশ ভাগের একভাগ (৫%)। ফসল উৎপাদনের ব্যয় যেমন- চাষ, সার, কীটনাশক, বপণ ও কর্তন ইত্যাদি খরচ উৎপাদিত ফসলের পরিমাণ থেকে বাদ যাবে, তবে এসব খরচ মোট উৎপাদিত ফসলের এক তৃতীয়াংশের বেশি বাদ যাবে না। ফসলের নিসাবের পরিমাণ ৫ ওয়াস্ক বা ৬৫৩ কিলোগ্রাম। অনেক কৃষি ফসল আছে যা মাপা বা ওজন করা হয় না। যেমন বিভিন্ন ধরনের ফল, ফসল, শাকসবজি, ফুল, অর্কিড, চারা, বৃক্ষ ইত্যাদি। এগুলোর নিসাব নির্ধারণের ক্ষেত্রে দেশের সাধারণ ফসল চাল বা গমের ৬৫৩ কেজির মূল্য (স্থানীয় বাজারে গড় মূল্য) নিসাব হিসাবে গণ্য করা যাবে।

যাকাতুল ফিতর (ফিতরা)

ঈদুল ফিতরের দিন সূর্যোদয়ের পূর্বে যার নিকট যাকাত ফরয হওয়ার পরিমাণ অর্থ-সম্পদ থাকে তার উপর ফিতরা ওয়াজিব। পূর্ণ বছর নিসাব পরিমাণ অর্থ-সম্পদের মালিক থাকার দরকার নাই। যাকাতের ক্ষেত্রে ঘরের আসবাবপত্র হিসাব হয় না। কিন্তু ফিতরার ক্ষেত্রে অত্যাবশ্যকীয় আসবাপত্র ব্যতিত অন্যান্য সৌখিন দ্রব্যাদি, অতিরিক্ত ঘর (খালি বা ভাড়ায় ব্যবহৃত) ইত্যাদি সম্পদ গণ্য হবে। ফিতরা নিজের পক্ষ থেকে এবং পিতা হলে নিজের নাবালেগ সন্তানদের পক্ষ থেকে দেয়া ওয়াজিব। আর পরিবারে ভরণ-পোষণে নির্ভরশীল বালেগ সন্তান, স্ত্রী ও মাতা-পিতা, চাকর-চাকরাণীর ফিতরা দেওয়া গৃহকর্তার দায়িত্ব।

রোযাদার ব্যক্তির চিত্তের পরিশোধনের অন্যতম উপায় হিসাবে তার উপর যাকাতুল ফিতর ধার্য্য করা হয়। এ জন্য শেষ রমযানের দিন সূর্যাস্তের পরই যাকাতুল ফিতর প্রদেয় হয়। সুন্নাহ অনুযায়ী ঈদের নামাযের পূর্বেই যাকাতুল ফিতর প্রদান করা উচিত। ইবনে ওমর (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, ‘‘আল্লাহর রাসূল (সা.) ঘোষণা করেছেন যে, স্বাধীন কিংবা দাস, যুবা কিংবা বৃদ্ধ, স্ত্রী কিংবা পুরুষ নির্বিশেষে সকল মুসলমানকে এক ‘সা’ পরিমাণ খেজুর যব (বার্লি) যাকাতুল ফিতর বাবদ অবশ্যই প্রদান করতে হবে’’।

যাকাতুল ফিতরের পরিমাণ হলো এক ‘সা’ চাল অথবা সমপরিমাণ খাদ্যদ্রব্য যেমন গম, খেজুর, দানাদার শস্য, ভূট্টা, ময়দা, গুঁড়া দুধ, পনির বা মাংস। উল্লেখ্য, ‘সা’ হচ্ছে পরিমাপের একক (পাত্র বা ভান্ড) যা মোটামুটি ২.৫০০ কেজি চালের সমান। মনে রাখতে হবে যে, ঘনত্ব ও ওজনের তারতম্যহেতু অন্যান্য শস্যদানার ওজনে এর কিছুটা কম-বেশি হতে পারে। আমাদের দেশের প্রধান খাদ্য চাল। চাল একটি উৎকৃষ্ট খাদ্য। পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষের প্রধান খাদ্য চাল। সৌদি আরব, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা, সিঙ্গাপুর, ব্রুনাই, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ অনেক দেশে চাল দিয়ে ফিতরা প্রদান করা হয়।

ফিতরা প্রদানের মূল উদ্দেশ্য ঈদুল ফিতরের দিন গরীবদেরকে খাদ্য দান করা, তবে অনেক আলেম খাদ্যের পরিবর্তে (সমমানের খাদ্যের বর্তমান বাজার মূল্যে) নগদ অর্থ প্রদান করা সমর্থন করেন। যাকাত প্রদানের খাত আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘‘যাকাত তো কেবল নিঃস্ব, অভাবগ্রস্ত ও তৎসংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের জন্য, যাদের চিত্ত আকর্ষণ করা হয় তাদের জন্য, দাসমুক্তির জন্য, ঋণ ভারাক্রান্তদের, আল্লাহর পথে ও মুসাফিরের জন্য’’ (সূরা তওবা, আয়াত-৬০)।

অসহায় এতিম, গরীব, মিসকীন, আশ্রয়হীন, গরীব বাস্তুহারা, দরিদ্র শিক্ষার্থী প্রভৃতি দুঃখী জনগোষ্ঠি যাকাতের প্রকৃত হকদার। ইহাদের মধ্যে গরীব আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশী অধিক হকদার। কর্মঠ গরীবদেরকে আত্মকর্মসংস্থানে সহায়তা করে স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য যাকাতের অর্থ ব্যয় করা যায়।

দ্বীনের প্রসারে ও দ্বীনি শিক্ষার বিস্তারে যাকাতের অর্থ ব্যয় করা যায়। যথার্থ কারণে ঋণগ্রস্ত এবং ঋণ পরিশোধে অক্ষম হয়ে পড়লে তাদের ঋণ মুক্তির জন্য যাকাতের অর্থ দিয়ে সাহায্য করা যায়। সফরকারী যদি আর্থিক অসুবিধায় পতিত হয়, তবে তাকে যাকাতের অর্থ দিয়ে সাহায্য করা যায়, যদিও তার বাড়ির অবস্থা ভালো হয়। নও-মুসলিমকে পুনর্বাসনের জন্য যাকাতের অর্থ দিয়ে সাহায্য করা যায়। যাকাত এমন লোককেই দিতে হবে যারা যাকাত নিতে পারে। যাদের যাকাত দেয়া যাবে না ধনী ব্যক্তির জন্য যাকাত খাওয়া বা ধনী ব্যক্তিকে যাকাত দেয়া জায়েয নয়। আপন দরিদ্র পিতামাতা, দাদা-দাদী, নানা-নানী তথা ঊর্ধ্বস্থ সকল নারী-পুরুষ, অনুরূপ পুত্র-কন্যা, নাতি-নাতনী ও অধস্তন সকল নারী-পুরুষ এবং স্বামী-স্ত্রীকে যাকাত প্রদান করা জায়েয নাই। যাকাত বহির্ভূত সম্পদের দ্বারা তাহাদের ভরণ-পোষণ করা ওয়াজিব। অনুরূপ মুহাম্মাদ (সা.)-এর প্রকৃত বংশধরদের সম্মান ও মর্যাদার কারণে যাকাতের অর্থ দ্বারা সাহায্য করা জায়েয নয়। একমাত্র দানের অর্থ দ্বারাই তাদের খেদমত করা জরুরী।

মসজিদ, মাদরাসা, রাস্তাঘাট ইত্যাদি নির্মাণের জন্য যাকাতের অর্থ ব্যয় করা নিষেধ।

সাধারণ আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করাও জায়েয নয়। তবে আশ্রয় কেন্দ্রে দুরবস্থা সম্পন্ন আশ্রয়প্রার্থীদের ব্যক্তি মালিকানাধীন ঘরবাড়ি নির্মাণ করে দেয়া জায়েয।

মনে রাখতে হবে যাকাত পরিশোধ হওয়ার জন্য ব্যক্তিকে মালিক বানিয়ে দেয়া শর্ত। সুতরাং যাকাতের অর্থে মৃত ব্যক্তির দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করাও জায়েয নয়। যাকাত দেয়া যেমন শরীয়তের বিধান, অনুরূপ যাকাত পাওয়ার যোগ্য ব্যক্তিকেই দেয়া শরীয়তের বিধান। সঠিক পাত্রে যাকাত প্রদান না করলে যাকাত পরিশোধ হবে না।

যাকাত হিসাব করার পদ্ধতি

নিসাব পরিমাণ অর্থ সম্পদের মালিক প্রত্যেক মুসলমানকে বছরান্তে যাকাত প্রদান করতে হবে। সম্পদের প্রকৃতি ও ধরণ অনুযায়ী যাকাতের হার ভিন্ন ভিন্ন হবে- ক) স্বর্ণ, রৌপ্য, নগদ অর্থ, ব্যবসায়িক মালামাল, আয়, লভ্যাংশ, কাজের মাধ্যমে উপার্জন, খনিজ সম্পদ ইত্যাদির উপর যাকাত ২.৫% হারে হিসাব করতে হবে। খ) ফল ও ফসল উৎপাদনে যান্ত্রিক সেচ সুবিধা গ্রহণ করলে ৫% হারে যাকাত হিসাব করতে হবে। গ) ফল ও ফসল উৎপাদনে জমি প্রাকৃতিকভাবে সিক্ত হলে ১০% হারে যাকাত হিসাব করতে হবে। স্বর্ণ বা রূপার নিসাবের ভিত্তিতে প্রতি চন্দ্র বছরে (৩৫৪ দিন) নিজের পূর্ণ মালের যাকাত হিসাব করে প্রথমে সম্পদ থেকে যাকাতের অংশ অর্থাৎ পূর্ণ মালের চল্লিশ ভাগের এক ভাগ বা শতকরা আড়াই ভাগ বা ২.৫% পৃথক করে নিতে হবে। আর যদি হিসাবপত্র সৌর বছর অর্থাৎ ৩৬৫ দিনের (যেমন ৩০ চৈত্র, ৩০ জুন বা ৩১ ডিসেম্বর) ভিত্তিতে হয় তাহলে যাকাত ধার্য হবে ২.৫৭৭% হারে। স্বর্ণের বাজার দর প্রতি গ্রাম ২,৫০০ টাকা হলে ৮৫ গ্রামের মূল্য ২,১২,৫০০ টাকা যার উপর যাকাত হবে ২.৫% হারে = ৫,৩১২.৫০ টাকা। আর রূপার বাজার দর প্রতি গ্রাম ৬০ টাকা হলে ৫৯৫ গ্রামের মূল্য ৩৫,৭০০ টাকা যার উপর যাকাত হবে ২.৫% হারে =৮৯২.৫০ টাকা। যাকাত হিসাব করার সময় এসব স্বর্ণ ও রৌপ্যের বিক্রয় মূল্যের (অর্থাৎ যাকাত হিসাব করার সময় বিক্রয় করতে চাইলে যে মূল্য পাওয়া যাবে।) ভিত্তিতে যাকাত হিসাব করতে হবে। যাকাতের অংশ পৃথক করার সময় বা প্রদান করার সময় অবশ্যই নিয়ত করতে হবে। নচেৎ যাকাত পরিশোধ হবে না। যৌথ মালিকানার মালের যাকাত ব্যক্তিগতভাবে নিজের অন্যান্য মালের সাথে দেয়া যায় আবর সম্মিলিতভাবেও শুধু যৌথ মালিকানার মাল থেকে যাকাত পরিশোধ করা যায়। যাকাত নগদ অর্থে প্রদান করা উচিত। গরীবের কাছে নগদ অর্থই অধিকতর কল্যাণকর। কারণ নগদ অর্থের দ্বারা যে কোন প্রয়োজন মিটনো যায়। যাকাত কোন প্রকার দয়া বা অনুগ্রহ নয়। সর্বপ্রকার লৌকিকতা, যশ-খ্যাতি ও পার্থিব স্বার্থের উদ্দেশ্য থেকে মুক্ত হয়ে একমাত্র মহান আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে যাকাত প্রদান করতে হবে।

যাকাত পরিশোধ না করার পরিণাম

আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর যারা স্বর্ণ ও রৌপ্য পুঞ্জীভূত করে এবং উহা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না, তাদেরকে মর্মন্তুদ শাস্তির সংবাদ দাও। যেদিন জাহান্নামের অগ্নিতে উহা উত্তপ্ত করা হবে এবং উহা দ্বারা তাদের ললাট, পার্শ্বদেশ ও পৃষ্ঠদেশে দাগ দেয়া হবে। সেদিন বলা হবে, ইহাই উহা যাহা তোমরা নিজেদের জন্য পুঞ্জীভূত করতে। সুতরাং তোমরা যাহা পুঞ্জীভূত করেছিলে তাহা আস্বাদন কর’’ (সূরা তওবা, আয়াত ৩৪-৩৫)।

আবদুল্লাহ বিন মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেন, ‘‘কোন ব্যক্তি যদি তার ধন সম্পদের যাকাত না দেয় তবে ঐ সম্পদ কিয়ামতের দিন অজগর সাপের আকার ধারণ করে তার গলদেশ বেষ্টন করবে’’। রাসুল (সা.) তারপর তিলাওয়াত করলেন, ‘‘আর আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে যাহা তোমাদিগকে দিয়েছেন তাহাতে যাহারা কৃপণতা করে তাহাদের জন্য উহা মঙ্গল, ইহা যেন তাহারা কিছুতেই মনে না করে। না, ইহা তাহাদের জন্য অমঙ্গল। যাহাতে তাহারা কৃপণতা করিবে কিয়ামতের দিন উহাই তাহাদের গলায় বেড়ি হইবে’’। (সূরা আল-ইমরান, আয়াত ১৮০) নাসায়ী ও ইবনে মাজাহ। হযরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেন, ‘‘সুদখোর, সুদদাতা, উহার সাক্ষী ও লেখক, উল্কি অংকনকারিণী এবং যে নারী উল্কি অংকন করায়, অবিশপ্ত ঐ ব্যক্তি যে যাকাত দিতে অস্বীকার করে, হিল্লাকারী ও যার জন্য হিল্লা করানো হয়, এদেন সকলের উপর আল্লাহর অভিশাপ বা লা’নত’’। (আহমদ নাসায়ী) ‘‘যারা বিশ্বাস স্থাপন করেছে, সৎ কাজ করেছে, নামায প্রতিষ্ঠিত করেছে এবং যাকাত প্রদান করেছে, তাদের জন্য পুরস্কার তাদের পালনকর্তার কাছে রয়েছে। তাদের কোন ভয় নাই এবং তারা দুঃখিত হবে না’’। (সুরা বাকারা, আয়াত-২৭৭)

যাকাত হিসাবের ফরম

নাম……………………যাকাত বছর……….হিজরি ক) ব্যক্তিগত সম্পদ স্বর্ণ, রূপা ও স্বর্ণ-রূপার অলংকারি = শেয়ার বিনিয়োগ = সিকিউরিটিতে বিনিয়োগ : ঋণপত্র বা ডিবেঞ্চার, বন্ড, সঞ্চয় পত্র, ট্রেজারি বন্ড ইত্যাদি = বীমা, ডিপিএস, প্রভিডেন্ট ফান্ড ইত্যাদি = স্থায়ী সম্পত্তির উপর নিট আয় = (গৃহ, দোকান, দালানকোঠা, জমি, যন্ত্রপাতি, গাড়ি, যানবাহন ইত্যাদি ভাড়া বাবদ নিট আয়)= বৈদেশীক মুদ্রা : নগদ ও ব্যাংকে জমা, বন্ড, টিসি ইত্যাদি (বিনিময় হারে=টাকা) = ব্যাংকে জমা : ফিক্সড, সঞ্চয়ী, চলতি, বিশেষ জমা, পোস্টাল সেভিংস ইত্যাদি = ঋণ/পাওনা আদায় = অন্যান্য = হাতে নগদ = মোট = বাদ : বাদযোগ্য ঋণ, বকেয়া কিস্তি, অন্যান্য বাদযোগ্য দেনা = যাকাতযোগ্য সম্পদ খ) ব্যবসায়িক সম্পদ বিক্রির জন্য দোকানে, গুদামে ও বিক্রয় প্রতিনিধির (এজেন্ট) কাছে রাখা পণ্যদ্রব্য = পরিবহন ও ট্র্যানজিট পণ্য = উৎপাদিত তৈরি পণ্য উৎপাদন প্রক্রিয়াধীন বা অসম্পূর্ণ পণ্য = মজুত কাঁচামাল ও প্যাকিং সামগ্রী = বাকী বিক্রির পাওনা = পাওনা আয়, বিল ও অন্যান্য পাওনা হিসাব = ব্যাংকে জমা = অন্যান্য = হাতে নগদ = মোট = বাদ : বাদযোগ্য ঋণ, বকেয়া কিস্তি, পাওনাদার, প্রদেয় বিল ও অন্যান্য বাদযোগ্য দেনা = যাকাতযোগ্য সম্পদ সর্বমোট যাকাতযোগ্য সম্পদ (ক+খ) = যাকাতের পরিমাণ ২.৫০% = এই ফরমে সকল যাকাতযোগ্য সম্পদের উল্লেখ নাই। ঋণের ব্যাপারে যাকাত ও ঋণের নিয়মাবলি জেনে নিন। বিস্তারিত জানতে স্থানীয় ইমাম অথবা বিজ্ঞ আলেমের সাথে যোগাযোগ করুন।

পিবিএ/এএইচ

আরও পড়ুন...