পিবিএ ডেস্কঃ কোরবানি শব্দের অর্থ উৎসর্গ ও নৈকট্য অর্জন। শরিয়তের পরিভাষায় জিলহজ মাসের ১০, ১১ ও ১২ তারিখে নির্দিষ্ট নিয়ম ও সময়ে, নির্দিষ্ট জন্তুকে মহান আল্লাহর অধিক সান্নিধ্য লাভের উদ্দেশ্যে জবাই করাকে কোরবানি বলা হয়। কোরবানি আদায় করা বিত্তবানদের ওপর ওয়াজিব। তবে দরিদ্র ব্যক্তিও ইচ্ছা করলে কোরবানি আদায় করে ছাওয়াব অর্জন করতে পারেন।
কোরবানির ফজিলতঃ কোরবানির ফজিলত সীমাহীন। মহানবী সা: বলেছেন, ‘কোরবানির সময় আল্লাহর নিকট কোরবানির চেয়ে অধিক প্রিয় আর কোনো জিনিস নেই। কোরবানির সময় কোরবানিই সবচেয়ে বড় ইবাদাত। কোরবানি জবেহ করার সময় প্রথম যে রক্তের ফোঁটা পড়ে, তা মাটি পর্যন্ত পৌঁছার আগেই কোরবানি আল্লাহর দরবারে কবুল হয়ে যায়।’ (তিরমিজি) মহানবী সা: আরো বলেছেন, ‘কোরবানির জানোয়ারের যত পশম থাকে প্রত্যেক পশমের পরিবর্তে একেকটি নেকি লেখা হয়।’ অন্যত্র বলেছেন, ‘তোমরা মোটা ও তাজা জন্তু দিয়ে কোরবানি করো, কারণ উহা পোলসেরাতে তোমাদের সাথী হবে।’ (মেশকাত)
যাদের ওপর কোরবানি ওয়াজিবঃ ১০ জিলহজের ফজর হতে ১২ জিলহজের সন্ধ্যা পর্যন্ত সময়ের মধ্যে কোনো ব্যক্তি যদি মালিকে নিসাব (সাড়ে বায়ান্ন ভরি রুপা কিংবা সাড়ে সাত ভরি স্বর্ণ বা সমমূল্যের নগদ অর্থ অথবা কিছু স্বর্ণ, কিছু রুপা এবং কিছু নগদ অর্থ- সব মিলিয়ে যদি সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপার মূল্যের সমান হয়, এরূপ সম্পদের অধিকারী) হয়, তবে তার ওপর কোরবানি ওয়াজিব হবে। স্ত্রী ও বালেগ পুত্র, বালেগা কন্যা ধনী হলে তাদের নিজ থেকেই কোরবানি করা ওয়াজিব। কিন্তু নাবালেগ পুত্র, নাবালেগ কন্যা ধনী হলেও তাদের ওপর কোরবানি ওয়াজিব হবে না। স্বামী যদি স্ত্রীর পক্ষ থেকে তার অনুমতিক্রমে কোরবানি আদায় করে তাহলে স্ত্রীর ওয়াজিব আদায় হয়ে যাবে। মুসাফিরের ওপর মুসাফিরি অবস্থায় কোরবানি ওয়াজিব হবে না।
কোরবানির সময়সীমা : ১০ জিলহজের ফজর থেকে ১২ জিলহজের সূর্য অস্ত যাবার আগেই কোরবানি আদায় করতে হবে। এই তিন দিনের যে দিন ইচ্ছা সে দিনই কোরবানি করা যেতে পারে। তবে ঈদের নামাজের আগে কোরবানি করা ঠিক নয়। অবশ্য যে স্থানে ঈদের নামাজ ও জুমার নামাজ আদায় হয় না, সে স্থানে ১০ জিলহজ ফজরের পরও কোরবানি করা যেতে পারে। রাতের বেলা বা অন্ধকার স্থানে কোরবানি না করাই উত্তম।
কোরবানির পশুঃ বকরি, পাঁঠা, খাসি, ভেড়া, দুম্বা, গাভী, ষাঁড়, বলদ, মহিষ, উট এই কয় ধরনের জন্তুর দ্বারা কোরবানি করা যাবে। হরিণ, বক ইত্যাদি হালাল বন্য জন্তুর দ্বারা কোরবানি আদায় হবে না। বকরি, পাঁঠা, খাসি, ভেড়া, দুম্বা পূর্ণ এক বছরের কম বয়সের হলে তা দ্বারা কোরবানি আদায় হবে না। তবে ছয় মাসের বেশি বয়সের দুম্বার বাচ্চা যদি মোটা তাজা হওয়ার কারণে এক বছরের বাচ্চার মতো মনে হয় তবে তা দ্বারা কোরবানি করা বৈধ হবে। গরু, মহিষের বয়স কমপক্ষে দুই বছর এবং উটের বয়স পাঁচ বছর হতে হবে। কোরবানির পশু সুস্থ, সবল এবং দৃষ্টিনন্দন হতে হবে। অন্ধ, কানহীন জন্তু কিংবা একটি কানের বা লেজের এক-তৃতীয়াংশ বা তদাপেক্ষা বেশি কেটে গেছে, মূল থেকে ভেঙে যাওয়া শিংওয়ালা জন্তুর দ্বারা কোরবানি বৈধ হবে না। অনুরূপভাবে অতি কৃশকায়, দন্তহীন জানোয়ার, তিন পায়ে ভর দিয়ে চলা খোঁড়া জন্তু দ্বারা কোরবানি করা বৈধ হবে না। শিংহীন জন্তু বা শিং উঠেছে কিন্তু ভেঙে গেছে, খাসি বানিয়ে দেয়া জন্তু বা জন্তুর গায়ে বা কাঁধে অল্প দাঁদ বা খুজলি হয়েছে এ রূপ জন্তু দ্বারা কোরবানি বৈধ। ভালো পশু ক্রয় করার পর যদি কোনো কারণে কোরবানি করার অনুপযুক্ত হয়ে পড়ে তবে অন্য একটি পশু ক্রয় করে কোরবানি করতে হবে। মালিকে নিসাব না হলে সে সেই পশু দ্বারাই কোরবানি করতে পারবে।
কোরবানি কত নামে করা যাবেঃ গরু, মহিষ ও উটের ক্ষেত্রে ১ হতে ৭ নাম দেয়া যেতে পারে। অন্যান্য জন্তুর ক্ষেত্রে ১ নাম দেয়া যাবে। গরু, মহিষ ও উট ক্রয় করার আগে ৭ জন ভাগীদার ঠিক করে নেয়া উত্তম। যদি কেহ ক্রয় পরবর্তী ভাগীদার পাওয়ার ইচ্ছায় একা গরু, মহিষ বা উট ক্রয় করে তবে তা বৈধ হবে। একা করার নিয়তে পশু ক্রয় করার পর পরবর্তীতে কাউকে ভাগীদার হিসাবে নিলে তা বৈধ হলেও উত্তম নয়। উল্লেখ্য, ক্রেতা গরিব হলে সে অন্যকে ভাগীদার হিসেবে নিতে পারবে না।
কোরবানি করার নিয়মঃ কোরবানির পশুকে কেবলার দিকে শুইয়ে ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবর’ বলে যবেহ করতে হবে। কোরবানি করার সময় মুখে নিয়ত করা ও দোয়া উচ্চারণ করা জরুরি নয়। স্মরণ থাকলে কোরবানির জন্য নির্ধারিত দোয়া পড়া যেতে পারে। ক্রয়কৃত জন্তুর বাচ্চা হলে ওই বাচ্চাকে কোরবানি করে গরিব মিসকিনকে দিয়ে দিতে হবে, নিজে খাওয়া যাবে না। বাচ্চাকে জবেহ না করে গরিবকে দান করে দেয়া যেতে পারে।
হারিয়ে যাওয়া পশুঃ কোরবানির জীব হারিয়ে গেলে তৎপরিবর্তে অন্য পশু ক্রয় করার পর প্রথম পশুটি পাওয়া গেলে ক্রেতা মালিকে নিছাব হলে তার জন্য যেকোনো একটি কোরবানি করা ওয়াজিব হবে। যদি মালিকে নিছাব না হয় তবে উভয়টি কোরবানি করা ওয়াজিব হবে। একটি কোরবানি করার পর অন্যটি ১২ জিলহজের পর পাওয়া গেলে গরিব লোকটি সেই পশুটিকে ছদকা করে দেবেন।
গোশত ভক্ষণ ও বণ্টন : কোরবানির পশুর গোশত পরিবার পরিজন ও আত্মীয়স্বজন নিয়ে তৃপ্তিসহকারে ভক্ষণ করা যাবে। গোশত বণ্টনের মুস্তাহাব নিয়ম হচ্ছে তিন ভাগ করে এক ভাগ গরিবদের, এক ভাগ আত্মীয়স্বজন ও এক ভাগ নিজে রেখে দেয়া। নিজে বেশি অংশ রেখে গরিবদের সামান্য দান করলেও কোরবানি আদায় হয়ে যাবে।
কোরবানির পশুর চামড়াঃ কোরবানির পশুর চামড়ার প্রকৃত হকদার হচ্ছে এতিম-মিছকিন তথা গরিবরা। যদি কেহ তা বিক্রি করে তবে বিক্রীত অর্থ সম্পূর্ণটুকুুই দান করে দিতে হবে। নিজের কাজে ব্যবহার করা যাবে না। পশু যবেহের বিনিময় কিংবা বানানোর পারিশ্রমিক চামড়া বিক্রির পয়সা বা গোশত দ্বারা দেয়া যাবে না। মসজিদ নির্মাণ, মেরামত কিংবা অন্য কোনো নেক কাজে এই অর্থ দান করা যাবে না।
মৃত ব্যক্তির জন্য কোরবানি : মৃত্যুর আগে কেহ কোরবানির জন্য অছিয়ত করে গেলে তার অংশের সমস্ত গোশত দান করে দেয়া ওয়াজিব। তবে স্বীয় ইচ্ছায় মৃতকে সাওয়াব পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে কোরবানি করা হলে ওই অংশের গোশত ইচ্ছা অনুযায়ী ভক্ষণ ও দান করা যবে।
পিবিএ/এমআর