যা থাকছে আওয়ামীলীগের ইশতেহারে

পিবিএ, ঢাকা: প্রধান দুই জোটেই চলছে ইশতেহার ঘোষণায় শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। আওয়ামী লীগ তাদের ইশতেহার ঘোষণা করবে ১৮ ডিসেম্বর। অন্যদিকে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ইশতেহার আসছে একদিন আগে, ১৭ ডিসেম্বর।

‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় অপ্রতিরোধ্য বাংলাদেশ’ স্লোগান সামনে রেখে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার প্রণয়নের কাজ চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। এবারের ইশতেহারে থাকছে উন্নয়ন-সমৃদ্ধির ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখার দৃঢ় প্রত্যয়। আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় গেলে দেশের প্রতিটি গ্রামকে শহরে পরিণত করা তথা গ্রামগুলোতেই আধুনিক নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করার অঙ্গীকার থাকছে ইশতেহারে। গ্রামীণ অর্থনীতি বিকাশের প্রতিশ্রুতিও থাকছে ইশতেহারে ।

অন্যদিকে ইশতেহারে নতুন চমক হিসেবে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য স্থায়ী বেতন কমিশন গঠনের অঙ্গীকারও করা হচ্ছে। আবার সরকার গঠনে সক্ষম হলে আমলাতন্ত্রকে নিয়মানুবর্তী ও জনগণের সেবক হিসেবে গড়ে তোলা এবং জনবান্ধব পুলিশ প্রশাসন প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতিও দিচ্ছে ক্ষমতাসীন দলটি। তরুণদের আকৃষ্ট করতে ইশতেহারে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর অঙ্গীকারও থাকতে পারে।

এ ছাড়া ডেল্টা প্ল্যান-২১০০, ব্লু ইকোনমি তথা সমুদ্র সম্পদভিত্তিক উন্নয়ন, তরুণদের ক্ষমতায়ন এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতিকেও প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। ইশতেহারে তরুণ ভোটারদের আকৃষ্ট করতে কর্মসংস্থান ও তরুণ উদ্যোক্তা সৃষ্টি, সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকার মানোন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়ন ও তাদের স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন, চরাঞ্চলের মানুষ ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উন্নয়ন, প্রান্তিক জনগণের জন্য আধুনিক প্রযুক্তির সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করাকেও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। সংশ্নিষ্টরা বলছেন, এবারের ইশতেহার হবে উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ নির্মাণের রোডম্যাপ।

আওয়ামী লীগ নেতারা জানিয়েছেন, ১৮ ডিসেম্বর (মঙ্গলবার) দলীয় সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইশতেহার ঘোষণা করবেন। গত দুটি নির্বাচনের ধারাবাহিকতায় এবারও বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রকে ইশতেহার ঘোষণার ভেন্যু হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে।

আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার উপকমিটির আহ্বায়ক ড. আবদুর রাজ্জাক সমকালকে বলেন, এবারের ইশতেহারে উন্নয়ন ও অগ্রগতির ধারা অব্যাহত রাখার অঙ্গীকারই প্রাধান্য পাচ্ছে। এরই মধ্যে ইশতেহারের খসড়া প্রণয়ন করে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার কাছে দিয়েছেন তারা। প্রধানমন্ত্রীর চূড়ান্ত অনুমোদনের পর এটি ঘোষণা করা হবে।

ইশতেহার প্রণয়ন উপকমিটির সূত্রগুলো জানায়, ৬৪ পৃষ্ঠার ইশতেহার তৈরির পাশাপাশি এর একটি সংক্ষিপ্তসারও করা হয়েছে। এবার ইশতেহারের মূল স্লোগান হিসেবে ১৩টি স্লোগানকে প্রস্তাব করা হয়েছিল। সেখান থেকে তিন-চারটি স্লোগানকে প্রাধান্য দিয়ে খসড়া তৈরির পর আওয়ামী লীগ সভাপতিকে দেওয়া হয়েছিল। সেখান থেকেই সামান্য সংশোধন করে ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় অপ্রতিরোধ্য বাংলাদেশ’ স্লোগানটি বেছে নিয়েছেন শেখ হাসিনা। আজকালের মধ্যে ইশতেহার ছাপানোর জন্য প্রেসে পাঠানোর কথা রয়েছে।

মূল স্লোগানের পাশাপাশি এবারের ইশতেহারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটি বিখ্যাত উদ্ধৃতিও ব্যবহার করা হয়েছে। সেটি হচ্ছে, ‘এ স্বাধীনতা আমার ব্যর্থ হয়ে যাবে, যদি আমার মানুষ পেট ভরে ভাত না খায়। এই স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না, যদি বাংলার মা-বোনেরা কাপড় না পায়। এই স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না, যদি এ দেশের মানুষ, যারা আমার যুবক শ্রেণী আছে তারা চাকুরি না পায় বা কাজ না পায়।’ মূলত জাতির পিতার এই উদ্ধৃতিতে বর্ণিত লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নের অঙ্গীকার নিয়েই এবারের ইশতেহার প্রণীত হয়েছে বলে সংশ্নিষ্টরা জানান।

যা থাকছে ইশতেহারে :ইশতেহারের মূল সুরই হচ্ছে উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার। ২০০৮ সালে ‘দিনবদলের সনদ’ দিয়ে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করা হয়। ওই ইশতেহার এবং পরবর্তী ২০১৪ সালের ইশতেহারেও ‘রূপকল্প-২০২১’ তথা ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ‘রূপকল্প-২০৪১’ তথা ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার প্রেক্ষিত পরিকল্পনা তুলে ধরা হয়।

আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, গত ১০ বছরে মহাজোট সরকার তাদের নির্বাচনী অঙ্গীকার বাস্তবায়নের পথে অনেকটাই সফল হয়েছে। এই সরকারের বিস্ময়কর উন্নয়ন-অগ্রগতির ফলে দেশ এরই মধ্যে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে পৌঁছে গেছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতিও পূরণ হয়েছে অনেক আগেই।

এসব কারণে এবারের ইশতেহারের ১১টি শিরোনামের (অনেকগুলো উপশিরোনামসহ) একাধিক অধ্যায়ে আওয়ামী লীগ সরকারের টানা দুই মেয়াদে উন্নয়ন-অগ্রগতির ধারা উপস্থাপন করা হয়েছে। পাশাপাশি আবার ক্ষমতায় গেলে আগামী মেয়াদের (২০১৯-২০২৩) লক্ষ্য ও উন্নয়ন পরিকল্পনা তুলে ধরা হচ্ছে। ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকারের ‘গৌরবোজ্জ্বল পাঁচ বছর’; ২০০১-২০০৬ মেয়াদে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের ‘দুর্নীতি, দুঃশাসন ও দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন’ শিরোনামে বক্তব্য স্থান পাচ্ছে। সামরিক স্বৈরশাসন ও প্রতিক্রিয়ার ধারা এবং বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ‘অসাংবিধানিক সরকার’ প্রতিষ্ঠার অপচেষ্টা ও তার প্রতিরোধ; সম্ভাবনার স্বর্ণদুয়ার উন্মোচন, সংকট উত্তরণ ও সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদবিরোধী জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি শিরোনামে নানা তথ্য স্থান পাচ্ছে। এ ছাড়া ২০০৮ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের ক্ষমতায় আসার প্রেক্ষাপটও তুলে ধরা হয়েছে।

ইশতেহারের শুরুতে ‘আমাদের অঙ্গীকার’ শিরোনামে ২১ দফা অঙ্গীকার করা হয়েছে। এর প্রধান বক্তব্যই হচ্ছে ‘আমার গ্রাম-আমার শহর :প্রতিটি গ্রামে আধুনিক নগর সুবিধা নিশ্চত করা।’ এ ছাড়া ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন শিরোনাম ও উপশিরোনামে সামষ্টিক অর্থনীতি :উচ্চ আয়, টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন ও বৈষম্য হ্রাস; কৃষি, খাদ্য, পুষ্টি ও গ্রাম উন্নয়ন; স্থানীয় সরকার, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি; শিল্প উন্নয়ন, অবকাঠামো রূপান্তরে বৃহৎ প্রকল্প, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, ব্লু-ইকোনমি, জলবায়ু পরিবর্তন, উষ্ণায়ন ও পরিবেশ, গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার থাকছে।

ইশতেহারে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ, সন্ত্রাস, সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদ নির্মূলের অঙ্গীকার, নারীর ক্ষমতায়ন; শিশু, প্রতিবন্ধী ও প্রবীণ কল্যাণ কর্মসূচি; তরুণ যুবসমাজকে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তর ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অন্তর্ভুক্তি, মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন; শ্রমনীতি, সংস্কৃতি ও ক্রীড়া; ক্ষুদ্র-নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও অনুন্নত সম্প্রদায়; গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও অবাধ তথ্যপ্রবাহ করার অঙ্গীকার করবে আওয়ামী লীগ।

ইশতেহারে এনজিও, প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র, এসডিজি, শেখ হাসিনার বিশেষ উদ্যোগ এবং উন্নয়ন, গণতন্ত্র, শান্তি ও সমতা প্রতিষ্ঠায় শেখ হাসিনার সম্মোহনী নেতৃত্বের ভূমিকার কথা তুলে ধরা হবে। সবশেষে ‘দেশবাসীর কাছে আহ্বান’ শিরোনামে আওয়ামী লীগকে আবারও নির্বাচিত করার আহ্বান থাকছে।

সূত্রমতে, ইশতেহারে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের উন্নত কাজের পরিবেশ, জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন ও সম্মানজনক জীবনধারণের জন্য মূল্যস্ম্ফীতির নিরিখে বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পুনর্নির্ধারণের জন্য স্থায়ী বেতন কমিশন গঠনের প্রতিশ্রুতি থাকছে। এর আগে আওয়ামী লীগ সরকার সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য শতকরা ১২৩ ভাগ বেতন বৃদ্ধি করেছে, যা স্মরণকালের মধ্যে সর্বোচ্চ।

ইশতেহার প্রণয়নে সংশ্নিষ্টরা জানান, এবারের নির্বাচনে তরুণ ভোটারদের আকৃষ্ট করাটাই হচ্ছে আওয়ামী লীগের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ জন্য ইশতেহারে তরুণ-যুবক, বিশেষ করে নতুন ভোটারদের আকৃষ্ট করার প্রচেষ্টাও থাকছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে তরুণ ভোটারদের আকৃষ্ট করতে ইশতেহারের বিষয়ে কিছু দিকনির্দেশনাও দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।

পিবিএ/এফএস

অারও পড়ুন:

আরও পড়ুন...