যুদ্ধ বনাম শান্তি

অলোক আচার্য: বর্তমানে বাংলাদেশ জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ হিসেবে শীর্ষে অবস্থান করছে। গত কয়েক দশক ধরেই শান্তি মিশনে গৌরবের সাথে দায়িত্ব পালন করে আসছেন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা। নানা প্রতিকূল পরিবেশ মোকাবেলা করে সংঘাতপূর্ণ বিভিন্ন এলাকায় শান্তির বার্তা ছড়িয়ে দিচ্ছেন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা। আফ্রিকাসহ বিভিন্ন বিশে^র বিভিন্ন প্রান্তে জাতিগত সংঘাত মোকাবেলায় তারা রাখছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত গর্বের। বিশ্ব প্রকৃতপক্ষে শান্তি চায়। যুদ্ধ এবং উত্তেজনা শান্তির অন্তরায়। বর্তমান অস্থির বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন হলেও মাঝে মধ্যেই উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে ওঠে কোনো দেশ বা অঞ্চল। মূলত নিজের আধিপত্য জানান দিতেই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়। অনেক উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার পর আলোচনার মাধ্যমে আপাতত ভারত ও চীন সীমান্তে শান্তিপূর্ণ অবস্থান বজায় রেখেছে। তবে কতদিন তা থাকবে বলা যায় না। সম্প্রতি সংযুক্ত আরব আমিরাত,বাহরাইনের সাথে ইসরাইলের ঐতিহাসিক চুক্তি ঐ অঞ্চলের শান্তি প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হবে বলে মনে করা হচ্ছে। এই চুক্তিকে মধ্যপ্রাচ্যের নতুন ভোর বলে উল্লেখ করেছেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এটি ট্রাম্প প্রশাসনের একটি সফলতা। কিন্তু এসব সহাবস্থানের ঘটনা যে সবার কাছে সমান গ্রহণযোগ্যতা পাবে তার কোনো কথা নেই। অর্থাৎ বর্তমান পরিস্থিতি বিশ্ব শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া এবং কেউ তার নিজের নিজের অবস্থান থেকে সরে আসতে সম্মত নয়। এই যে আজ বিশ^ এক মহা সংকটের সামনে দাড়িয়ে রয়েছে এবং এখান থেকে বেরিয়ে আসার জন্য ঐক্যমত অত্যন্ত জরুরী, তা সত্ত্বেও কিন্তু বিশে^ অস্থিরতা বিরাজ করছে।

করোনা মহামারীর চেয়ে বিশে^ ক্ষমতার প্রয়োগের মহামারী মানুষের ধ্বংসের জন্য বেশি দায়ী। করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন বিভিন্ন দেশে আবিষ্কারের চেষ্টা চলছে। একসময় তা কার্যকরভাবে মানুষের ওপর প্রয়োগ করা হবে। তবে মানুষের মনে অশান্তির বীজ রোপিত হয়েছে তা থেকে মানুষ কি কোনোদিন বেরিয়ে আসতে পারবে? তা করতে হলে নিজেকে নিজের জায়গা থেকে একটু সরে আসতে হবে। আর শক্তিমত্তা যাচাইয়ে মানুষ তা কোনোদিনই করবে বলে মনে হয় না। সামরিক খাতে নতুন নতুন অস্ত্র যোগ করা এবং বিশ^ প্রতিযোগীতায় নিজেকে উপযুক্ত করে গড়ে তোলা এখন প্রতিযোগীতামূলক বিশে^র প্রবণতা। প্রত্যেকেই যার যার মতো করে নিজের সুরক্ষায় ব্যস্ত। এক্ষেত্রে কোনোদেশই পিছিয়ে থাকতে চাইছে না। প্রতিটি দেশেরই বহিঃশত্রুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। সেই অধিকার থেকেই নিজেকে সুরক্ষার প্রচেষ্টা করে। দুর্বল বা সবল কোনো দেশ এক্ষেত্রে ছাড় দিতে রাজি নয়। প্রয়োজনে মিত্রদেশের সাথে জোটভুক্ত হয়েও নিজেকে সুরক্ষা দিতে ব্যস্ত। যুদ্ধ আসলে মানব সভ্যতাকে কোনোদিনই ভালো কিছু দিতে পারেনি। যা দিয়েছে তা হলো মানবিক যন্ত্রণা যা দীর্ঘমেয়াদে নারী-পুরুষ ও শিশুরা ভোগ করছে। দিয়েছে অশান্তি যার আগুনে পুড়েছে পুরো মানব সভ্যতা। অসংখ্য মানুষ তাদের বাস্তুচুত্য হয়েছে। তারা আজ আশ্রয়হীন হয়ে পরাধীন জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছে। অথচ তাদের দায় কেউ নিচ্ছে না।

দেশগুলো নিজেদের ব্যয়িত অর্থের একটি বড় অংশই অস্ত্র প্রতিযোগীতার পেছনে ব্যয় করছে। অনেক দেশে সামরিক খাতের ব্যয় অনেক বেশি। কিন্তু কেন এই প্রতিযোগীতা? আমরা কার কাছ থেকে নিরাপদে থাকতে চাইছি? আমাদের প্রধান শত্রু কে? এসব প্রশ্নের সঠিক উত্তর জানা আবশ্যক। সময় এসেছে আমাদের আত্নবিশ্লেষণ করার। নিজেকে সুরক্ষিত রাখা বা অন্যকে ভয় দেখানো যদি আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য হয় তাহলে আমাদের মূল উদ্দেশ্য থেকে দূরে সরে যাচ্ছি বলেই আমার মনে হয়। পৃথিবীর অস্তিত্তই যদি হুমকির সম্মুখীন হয় তাহলে নিজেকে সুরক্ষিত করার কোনো অর্থ হয় না। আজকের যে আক্রমণাত্বক প্রবণতা তা অতীতেও ছিল। যখন রাজায় রাজায় যুদ্ধ হতো আর উলুখাগড়ার প্রাণ যেতো। তারাও তাদের শক্তিমত্তা জানান দিতে প্রায়ই অন্যদেশ আক্রমণ করতো। যুদ্ধের নতুন নতুন কৌশল বের করতো। নতুন নতুন অস্ত্র দিয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতো। মানুষকে মারার জন্য মানুষের এত কৌশল! সে সময়ও ছোট ছোট রাজ্যগুলো একজোট হয়ে বড় রাজ্যকে প্রতিহত করতো। সেই কৌশলের আজও কোনো পরিবর্তন হয়নি। পরিবর্তন হয়েছে রণক্ষেত্রের। মানুষের এসব কাজের দ্বারা, অস্ত্রের দ্বারা মানুষের কি উপকার হয়েছে। মানব জাতি আজ অস্তিত্ব সংকটে।

যুদ্ধ এবং শান্তি পরস্পর বিপরীতমুখী প্রক্রিয়া। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে বর্তমান বিশ্বে দুটো বিষয়ই পাশাপাশি চলছে। একদিকে একে অন্যকে আক্রমণাত্বক বক্তব্য ছুড়ছে অন্যদিকে শান্তির বুলি। মানুষ আসলে কি চায় তা মনে হয় নিজেও জানে না। যুদ্ধ না শান্তি? অস্ত্র না মানবতা? এসব তো পাশাপাশি চলতে পারে না। প্রত্যেকেই সামরিক সক্ষমতা বাড়াতেই ব্যস্ত। এশিয়ায় শক্তিমত্তা বাড়িয়ে চলেছে চীন ও ভারত। এশিয়ায় নিজেদের প্রভাব বাড়াতে এবং যুক্তরাষ্ট্রের হুমকি মোকাবেলায় শিজিনপিংয়ের মেয়াদকালের শুরু থেকেই সামরিক সক্ষমতা বাড়ানোর ওপর জোর দিতে শুরু করে চীন। তাহলে বিশে^র পরিণতি কি হবে? আমরা কি নিজেদের রক্ষা করতে গিয়ে হারিয়ে ফেলবো? মানুষ সত্যিই কত বোকা! যখন পৃথিবীর অস্তিত্ত নিয়েই প্রশ্ন ওঠে তখন কেবল নিজেকে রক্ষা করার জন্য বিপদমুক্ত করার জন্য অত্যাধুনিক সব মারণাস্ত্র অর্থ ব্যয় করছি। এর থেকে অনেক বেশি জরুরী পৃথিবী বসবাসযোগ্য করা। পৃথিবীতে বহু মানুষ আজ আশ্রয়হীন,খাদ্য নিরাপত্তায় ভুগছে। বহু শিশু তার মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশগুলো পুর্নগঠন করা জরুরি। তারপরেও মানুষ অস্ত্র প্রতিযোগীতার মাধ্যমে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন অস্ত্রের জন্ম হচ্ছে। বিশ্ব এখন প্রবেশ করেছে হাইপারসনিক যুগে। সম্প্রতি ভারতও এ খাতায় নাম লিখিয়েছে। কিন্তু পৃথিবী আজ যেসব কারণে হুমকি তা ঠেকানোর মতো কোনো অস্ত্র আবিষ্কৃত হয়নি। কথা হলো নগর যদি পুড়ে যায় তাহলে দেবালয় কি বাঁচানো যায়। ধ্বংস দিয়ে শান্তি আনা যায় না। শান্তির জন্য ক্ষমতার বাতাবরণ ভেদ করতে জানতে হয়। এই প্রতিযোগীতামূলক বিশে^ তা আর কোনোদিন হবে বলে মনে হয় না।

অলোক আচার্য
কলাম লেখক, পাবনা।

আরও পড়ুন...