পিবিএ ডেস্ক: ১৮৭১ সালের ১১ জুলাই । কলকাতার ‘এক্সচেঞ্জ গেজেট’ নামে একটি পত্রিকায় ‘বিবাহ’ নামে একটি বিজ্ঞাপন ছাপা হয় । সেদিন ছিল মঙ্গলবার । বিজ্ঞাপনে যা লেখা হয়েছিল:
‘একজন কর্মচারী যিনি ২০ বৎসর কর্মকার্য করিয়াছেন, এখন তাঁহার বিবাহ করিবার ইচ্ছা হইয়াছে তিনি এমন একটি কনে চান যাহার বয়স ২৫ বৎসরের অধিক নহে এবং সংসারের কাজকর্মে বিশেষ নিপুণ । টাকাকড়ির প্রয়োজন নাই । বর বেশ সুখে স্বচ্ছন্দে আছেন । কনেরা দরখাস্তের সঙ্গে যেন নিজ নিজ চেহারার ছবি পাঠাইয়া দেন । যাঁহার চেহারা পছন্দ না হইবে তাঁহার চেহারা [ছবি] ফিরাইয়া দেওয়া হইবেক । কনেরা ‘ও কে’ নামে শিরোনাম দিয়া এক্সচেঞ্জ গেজেট ছাপাখানার অধ্যক্ষের নিকট দরখাস্ত পাঠাইয়া দিবেন।’
এই বিজ্ঞাপন দেখে তো চোখে ধাঁধা দেখলেন কলকাতা নগরীর মানুষ। পথে প্রান্তরে ঘুরতে লাগল আলোচনা—এ আবার কেমন কথা ! নির্লজ্জ ছেলে কিনা নিজেই নিজের বিয়ের কথা লিখছে ! এ আবার হয় নাকি ! কোথায় পাত্রপক্ষ কন্যার বাড়ি গিয়ে তাঁকে দেখতে দেখতে মণ্ডা মিঠাই গান্ডেপিন্ডে গিলে আসবে, তা নয়, শেষ পর্যন্ত খবরের কাগজে সম্বন্ধ স্থাপন !
মজার ব্যাপার হল, একদল আবার ছেলেটিকে ছেড়ে মেয়েটিকে নিয়ে পড়লেন । অথচ কী আশ্চর্যের কথা, পাত্রীকে এখানে চাওয়া হয়েছে । কোনও নির্দিষ্ট পাত্রী বেচারি সিনেও নেই । গোঁড়া সমাজ বলতে শুরু করল—সে কীরকম মেয়ে রে বাবা, যে নিজের বিয়ের জন্য নিজেই দরখাস্ত করবেন !
খবরের কাগজগুলিতেও এ নিয়ে চর্চা শুরু হয়ে গেল । ‘সুলভ সমাচার’ তো লিখেই বসল—‘খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়া লোকে তো ঘর বাড়ি গাড়ি ঘোড়াই কিনিয়া থাকে কিন্তু বিজ্ঞাপন দ্বারা কিরূপে বিবাহের সম্বন্ধ স্থির হইতে পারে, আমরা তো তাহা ভাবিয়া চিন্তিয়া ঠিক করিয়া উঠিতে পারিলাম না। কন্যাটি কেমন ঘরের মেয়ে, উহার চরিত্র কিরূপ, কেবল একখানা দরখাস্ত পড়িয়া যে কিরূপে এই সমস্ত অবগত হওয়া যায় এবং কিরূপেই বা এই সমস্ত গুরুতর বিষয় বিশ্বাস করিতে পারা যায়, বাঙ্গালির বুদ্ধিতে ইহা ঘটিয়া উঠা দায় । ছি ছি ছি লজ্জার কথা, দরখাস্ত করিয়া একজন কুলকামিনী অপর একজন অপরিচিত ব্যক্তিকে পতিত্বে বরণ করিবে ? এমন বিবাহের চেয়ে যাবজ্জীবন আইবুড়ো থাকা ভাল ।’
এ আসলে কি ইংরেজদের স্টাইল ? তা নিয়ে প্রশ্নটা উঠছিল । অনেকেই বললেন, বাঙালির ঘরের বিয়ে আর ইংরেজদের বিয়ের মধ্যে আকাশ পাতাল ফারাক রয়েছে। অনেকেই বললেন—ওরা বাবা-মাকে দূরে রেখে নিজেরাই নিজেদের পাত্রী পছন্দ করে বলে ওদের বিবাহিত জীবন সুখী নয় । সে জন্য তাদের স্ত্রীদের অধিকাংশকেই দুঃখে কাটাতে হয় । অধিকাংশেরই বিয়ে টেকে না । বাঙালির বিয়ের জন্য বিজ্ঞাপনকে অনেকেই কটাক্ষ করে বললেন, এ আসলে ইংরেজি শিক্ষার প্রভাব । ‘সুলভ সমাচার’ লিখল—‘সাহেবদিগের আচার ব্যবহারের প্রতি দোষারোপ করা আমাদের এই প্রস্তাব লিখিবার উদ্দেশ্য নহে। দেশীয় সুশিক্ষিত নব্য সম্প্রদায়ের সাহেবী চাল দেখিয়া বড় ভয় হইয়াছে বলিয়াই, আমরা এই বিষয়ে দুই চারিটি কথা বলিতে বাধ্য হইলাম।’
তবে সে যুগ অবশ্য পার হয়ে গেছে । এখন পাত্র একাই নয়, পাত্রীরাও বিজ্ঞাপন দেন বিবাহের ইচ্ছা জানিয়ে । তবে বেশিরভাগই এখন মনের মানুষটিকে খুঁজে নিচ্ছেন সোস্যাল নেটওয়ার্কিংয়ে । কথা হচ্ছে, একসাথে বেড়ানো হচ্ছে, পছন্দ হলে তারপরই বিয়ে । আসলে সম্পর্কের ভাষাটা যে বদলে গেছে অনেকটাই ।
তবে এখনও রমরমিয়ে চলছে পাত্রপাত্রী ক্লাসিফায়েডের বিজ্ঞাপনের কলাম । বিজ্ঞাপন চলুক। ঘটক ‘পাখী ভাই’র মতো অনেক প্রতিষ্ঠান এখন রমরমিয়ে ব্যবসা করছে। জয় হোক এই বাণিজ্যের।
পিবিএ/জেআই