যেসব কবিরা গুনাহের কারণে ইবাদত কবুল হয় না

সেলিম উদ্দিন নিজামী: আল্লাহ তায়ালা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন তাঁর ইবাদাতের জন্য। আল্লাহ তায়ালার ইবাদাত কবুল হওয়ার জন্য ইবাদাতের সাথে সাথে গুনাহ থেকে বেঁচে থাকতে হয়। বিশেষ করে কবিরাহ বা বড় গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা ইবাদাত কবুল হওয়ার প্রধান শর্ত। কবিরা গুনাহ যা তওবা ছাড়া মাফ হয় না। একটি গুনাহই জাহান্নামে পৌঁছে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।

মহান আল্লাহ বলেন, “তোমরা যদি গুরুতর নিষিদ্ধ কাজ অর্থাৎ বড় বড় পাপ সমূহ থেকে বিরত থাক তাহলে আমি তোমাদের অন্যান্য লঘু পাপ সমূহ ক্ষমা করে দিবো এবং তোমাদেরকে মহা-সম্মানজনক স্থানে প্রবেশ করাবো।” (সূরা-নিসা-৩১) সুতরাং মহান আল্লাহর এই মহা অনুগ্রহ তথা মহা পুরস্কার পেতে হলে আমাদেরকে অবশ্যই কবিরা গুনাহ থেকে বেঁচে ইবাদাত করতে হবে।

কবিরা গুনাহ গুলো হচ্ছে-
১। শিরক করা। মহান আল্লাহর সৃষ্টি জগতের কোনো কিছুর সাথে তাঁর সাদৃশ্য স্থাপন করার নাম শিরক। কি কি কাজ করলে শিরক হয় তা জানার পরেও যদি কেউ শিরক করে এবং শিরক করা অবস্থায় মারা যায় তবে মহান আল্লাহ তার গুনাহ মাফ করবেন না। (সূরা-মায়িদাহ-৭২, সূরা-নিসা-৪৮ ও ১১৬, বুখারি-৩৩৩৪, মুসলিম-২৮০৫)।
২। পিতা মাতার অবাধ্য হওয়া। (সূরা-বানী ইসরাইল-২৩, লুকমান-১৪, বুখারী-৬৮৭১)
৩। অন্যায়ভাবে কোনো ব্যক্তিকে হত্যা করা। (সূরা-বানী ইসরাইল-৩৩, মায়িদাহ-৩২, নিসা-৩০)
৪। মিথ্যা কথা বলা। (সূরা-মুমিন-২৮, তুর-১১ ও ১২, বুখারি-১৯০৩)
৫। মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান করা। (সূরা-ফুরকান-৭২, বুখারি-৬৮৭১, মিশকাত-৩৭৫৯)
৬। জাদু করা। জাদু বা গনকের কাছে গেলে ৪০ দিন পর্যন্ত কোনো ইবাদাতই কবুল হয় না। (সূরা-বাকার-১০২, বুখারি-৭৬৬, মুসলিম-৮৯)
৭। দারিদ্রের ভয়ে সন্তান হত্যা করা ও জন্ম নিরোধ করা। (সূরা-বানী ইসরাইল-১৭/৩১)
৮। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সাঃ) কে নিয়ে হাসি তামাশা করা। (সূরা-তাওবা-৬৫ ও ৬৬, মায়িদাহ-৪৭ ও ৫৮, নিসা-১৪০)
৯। মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সাঃ) কে অমান্য করা। (সূরা-জ্বিন-২৩, নিসা-১৪, আযহাব-৩৬)
১০। আল্লাহ কর্তৃক প্রেরিত দ্বীনকে দম্ভভরে প্রত্যাখ্যান করা। (সূরা-সাবা-৩৪)
১১। আল্লাহর বাণী ও বিধানকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা এবং অহংকার করে তা হতে দূরে থাকা। (সূরা-আরাফ- ৩৬ ও ৪০)
১২। আল্লাহর উপর মিথ্যা আরোপ করা অথবা তাঁর নিকট হতে আগত সত্যকে অস্বীকার করা। (সূরা-হুদ-২৮, আনকাবুত-৬৮, আরাফ-৩৭)
১৩। রাসূল (সাঃ) কে অমান্য করা, অবিশ্বাস করা এবং তাঁর নামে মিথ্যাচার করা। (সূরা-নিসা-৮০, মুহাম্মদ-৩৩, আহকাফ-৩১, ইমরান-১৮৪)
১৪। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ব্যতিত অন্যকে শাফায়াতের অধিকারী মনে করা। (বুখারি-৬৫৬৫)
১৫। রাসূল (সাঃ) এর উপর অবতীর্ণ শরীয়তকে অসম্পূর্ণ মনে করা, মানব রচিত দ্বীনকে বিশ্বাস করা। (সূরা-ইমরান-৮৩, নিসা-১১৫)
১৬। কাফির-মুশরিকদের ধর্মও সঠিক হতে পারে বলে সন্দেহ করা ও তাদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করা। (সূরা-ইমরান-২৮, বাকারা-২২১, তাওবা-২৮)
১৭। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কর্তৃক আনীত দ্বীনকে অপছন্দ করা। (সূরা-মুহাম্মদ-৯, মুমিনুন-৭০, তাওবা-৪৮)।
১৮। ইচ্ছাকৃতভাবে সালাত পরিত্যাগ করা। (সূরা-মুদ্দাসির-৪০ ও ৪৩, আনকাবুত-৪৫, তিরমিযী-৪৬৪, মুসলিম-১৫৪)
১৯। শারঈ কারণ ব্যতিত নামাজে শৈথিল্য প্রদর্শন করা। (সূরা-মাঊন-৪ ও ৫)
২০। যাকাত আদায় না করা। (সূরা-মুমিনুন-৪)
২১। কোনো ওজর ব্যতিত রমজানের সিয়াম (রোজা) নষ্ট করা। (সূরা-বাকারা-১৮৩ ও ১৮৫, বুখারি-১৮৯১ ও ১৮৯৪, মুসলিম-১১৫১)
২২। সামর্থ থাকা সত্ত্বেও হজ্জ্ব পালন না করা। (সূরা-ইমরান-৯৭)
২৩। আত্মীয় স্বজনদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা। (সূরা-মুহাম্মদ-২২ ও ২৩, নিসা-৩৬, বুখারি-৪৮৩০, মুসলিম-২৫৫৪)
২৪। বিবাহ বহির্ভূত যৌন সম্পর্ক, যেনা, ব্যভিচার, সমকামীতা ও যৌন বিকারে লিপ্ত হওয়া। (সূরা-বানী ইসরাইল-৩২)
২৫। মদ্যপান করা। (সূরা-মায়িদাহ-৯০, বুখারি-৫৫৯০)
২৬। সুদ গ্রহণ ও প্রদান করা। (সূরা-বাকারা-২৭৫, ২৭৮ ও ২৭৯, ইমরান-১৩০, বুখারি-২০৮৬)
২৭। ইয়াতিমদের সম্পদ ভক্ষন করা ও তার উপর অত্যাচার করা। (সূরা-বানী ইসরাইল-৩৪, বুখারি-২৭৬৬ ও ২৫৬৩, মুসলিম-৮৯)
২৮। জিহাদ চলাকালে যুদ্ধক্ষেত্র হতে পলায়ন করা। (সূরা-আনফাল-১৫ ও ১৬)
২৯। শাসক কর্তৃক শাসিতের উপর অত্যাচার করা। (সূরা-শুরা-৪২, বুখারি ও মুসলিম-৩৬৮৭)
৩০। আমানতের খেয়ানত করা। (সূরা-আনফাল-২৭)
৩১। অহংখার করা। (সূরা-লুকমান-১৮, মুসলিম-৯১)
৩২। তাস, কেরাম, দাবা বা লুডুর সাহায্যে জুয়া খেলা। (সূরা-মায়িদাহ-৯০, মুসলিম-৪৫০০)
৩৩। সতী-সাধ্বী নারীর বিরুদ্ধে অপবাদ বা কুৎসা রটনা করা। (সূরা-নূর-৪)
৩৪। রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাৎ করা। (সূরা-ইমরান-১৬১)
৩৫। চুরি-ডাকাতি করা। (সূরা-মায়িদাহ-৩৮)
৩৬। মিথ্যা শপথ করা। (মুসলিম-৩৭৬০)
৩৭। কারও উপর অন্যায়ভাবে অত্যাচার ও জুলুম করা। (সূরা-শুরা-৪২, হুদ-১০২ ও ১১৩)
৩৮। হারাম উপার্জন ও ভক্ষন করা। (সূরা-বাকারা-১৮৮, মুসলিম-২৭৬০)
৩৯। বিচার কার্যে অসততা ও দুর্নীতি করা। (সূরা-মায়িদাহ-৪৪, ৪৫ ও ৪৭)
৪০। ঘুষ খাওয়া। (বাকারা-১৮৮)
৪১। নারীরা পুরুষদের এবং পুরুষরা নারীদের সাদৃশ্যপূর্ণ বেশভূষা ধারণ করা। (বুখারি-৫৮৮৫ ও ৫৪৫৭)
৪২। নিজ পরিবারবর্গকে নামাজের আদেশ না দেওয়া এবং পাপাচারে প্রশ্রয় দেওয়া। (সূরা-ইব্রাহিম-৪০)
৪৩। ঋতুবতী স্ত্রীর সাথে সহবাসে লিপ্ত হওয়া। (সূরা-বাকারা-২২২)
৪৪। অন্যকে দেখানোর উদ্দেশ্যে ভালো কাজ করা। (সূরা-বাকারা-২৬৪, নিসা-৩৮ ও ১৪২, মাঊন-৪ ও ৫)
৪৫। বিশ্বাস ঘাতকতা, বিশ্বাস ভঙ্গ করা। (সূরা-হুজরাত-১১ ও ১২)
৪৬। দান খয়রাত করার পর তার খোটা দেওয়া। (সূরা-বাকারা-২৬৪)
৪৭। অপরের সম্পদ আত্মসাৎ করা। (সূরা-বাকারা-১৮৮, নিসা-২৯)
৪৮। ওয়াদার খেলাপ বা ওয়াদা ভঙ্গ করা। (সূরা-নাহল-৯১,৯২ ও ৯৪, বানী ইসরাইল-৩৪)
৪৯। বিনা-অপরাধে কোনো মুসলিমকে অভিশাপ বা গালি দেওয়া। (বুখারি-৪৮ ও ৬০৪৪, মুসলিম-১২৪)
৫০। স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের অধিকার নষ্ট করা। (সূরা-নিসা-৩৪, বাকারা-২২৮)
৫১। অহংকার ও দাম্ভিকতা প্রকাশ করা। (সূরা-লুকমান-১৮, বনী ইসরাইল-৩৭, আরাফ-৩৬)
৫২। ওজনে কম দেওয়া বা বেশি নেওয়া। (সূরা-বনী ইসরাইল-৩৫, আরাফ-৮৫)
৫৩। প্রতিবেশীকে কষ্ট দেওয়া। (সূরা-নিসা-৩৬)
৫৪। যৌতুক আদান-প্রদান করা। (সূরা-বাকারা-১৮৮)
৫৫। কৃপণতা করা বা অপব্যয় করা। (সূরা-বনী ইসরাইল-২৬, ২৭ ও ২৯, নিসা-৩৭)
৫৬। অপরের দোষ তালাশ, গীবত করা অর্থাৎ চোগলখুরী বা নিন্দা করা। (সূরা-হুজরাত-১১ ও ১২, হুমাযাহ-১, বুখারি-৬০৬৫)
৫৭। গান-বাজনা, নৃত্য করা ও দেখা। (সূরা-লুকমান-৬, আরাফ-৩৩)
৫৮। পর্দার বিধান লঙ্ঘন করা। (সূরা-মুমিনুন-৫)
৫৯। জেনে শুনে নিজেকে অন্যের সন্তান বলে পরিচয় দেওয়া অর্থাৎ নিজ পিতার পরিবর্তে অন্যকে পিতা বলে পরিচয় করা। (বুখারি, মুসলিম ও মিশকাত-৩৩১৪ ও ৩৩১৫)
৬০। মুসলিমদের ক্ষতি সাধনে অমুসলিমদের সাহায্য করা। তাদের গোপনীয় বিষয় অনুসন্ধান করা ও শত্রুর নিকট প্রকাশ করা। (সূরা-মুমতাহিনা-১ ও ২, মায়িদাহ-৫১)।

(লেখক- সেলিম উদ্দিন নিজামী, বিশিষ্ট সাংবাদিক)

পিবিএ/হক

আরও পড়ুন...