ইসলামের পরিভাষায়, দোয়া (আরবি: دُعَاء বহুবচন: আদ ইয়াহ, আরবি: أدْعِيَة) বলা হয়। শব্দটির আক্ষরিক অর্থ ‘আহবান’ বা ‘ডাকা’, যা ইসলামে একটি বিশুদ্ধ মিনতি প্রক্রিয়া। এই শব্দটি এসেছে একটি আরবি শব্দ থেকে যার বাংলায় অনুবাদ ডাক বা তলব কর।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘দোয়া ইবাদতের সারাংশ’; আর আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তার প্রেরিত ধর্মগ্রন্থ কোরআন-এ বলেছেন, ‘তোমাদের পালনকর্তা বলেন, তোমরা আমাকে ডাক, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেবো। যারা আমার এবাদতে অহংকার করে তারা সত্বরই জাহান্নামে দাখিল হবে, এবং লাঞ্চিত হবে’। (সূরা: আল-মু’মিন, আয়াত: ৬০)
আফসোসের বিষয় এই যে, মানুষ বিপদে পড়লেই দোয়া করে, যেন বিপদমুক্ত হওয়া যায়। সুস্থ কিংবা ভালো অবস্থায় দোয়া করে না। এ বিষয়ে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- ‘ভালো অবস্থায় তুমি আল্লাহকে চিনেত শেখ; তবেই বিপদের অবস্থায় আল্লাহ তোমাকে চিনবে’।
আমাদের দোয়া কবুল হয় না যেসব কারণে
ফরজ-ওয়াজিব বিধানের লঙ্ঘন, হারাম ও নিষিদ্ধ কাজ করাই দোয়া কবুলের পথে অন্তরায়। কেননা এসব কাজের মাধ্যমে আল্লাহর সঙ্গে বান্দার সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। তাই তাদের দোয়া আল্লাহ কবুল করেন না। যেমন-
(১) আল্লাহ তাআলার অবাধ্য হয়ে দোয়া করলে: আল্লাহ রাব্বুল আলামিন হজরত ইউনুস আলাইহিস সালাম সম্পর্কে বলেন, ‘তিনি যদি আগে তাসবিহকারীদের অন্তর্ভূক্ত না হতেন তাহলে তিনি কেয়ামত পর্যন্ত মাছের পেটে থাকতেন’।
আবার আল্লাহ তাআলা ফেরাউন সম্পর্কে কোরআনে বলেছেন, ‘যখন পানি ফেরাউনকে ডুবিয়ে দিল তখন সে বললো, আমি ঈমান আনলাম, (আল্লাহ বলেন) এখন? এর আগে তুমি নাফরমানি করেছ এবং তুমি ছিলে ফাসাদ সৃষ্টিকারীদের অন্তর্ভূক্ত’।
উক্ত দুই আয়াতে দোয়া কবুলের জন্য আল্লাহর আদেশ মানা ও নিষিদ্ধ কাজ থেকে দূরে থাকার কথা পরিষ্কার করে বলা হয়েছে।
হজরত ইউনুস আলাইহিস সালাম আল্লাহর অনুগত ও বাধ্য ছিলেন এবং আল্লাহর আদেশ পালন করেছেন। তাই তার দোয়া কবুল হয়েছে। পক্ষান্তরে ফেরাউন আল্লাহর অবাধ্য ছিল ও তার আদেশ মানতো না। তাই তার দোয়া ও তওবা কবুল হয়নি।
(২) হারাম কাজ করা: হারাম আয় দ্বারা খাদ্য-পানীয় খাওয়া ও হারাম অর্থের কনা পোশাক পরা দোয়া কবুলের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা। এ প্রসঙ্গে হাদিসে এসেছে-
‘যে ব্যক্তি আকাশের দিকে দুইহাত তুলে হে প্রভু! হে প্রভু! বলে দোয়া করে। অথচ তার খাবার হারাম, পানীয় হারাম, পোশাক হারাম এবং হারাম দ্বারাই তার রক্ত-মাংস তৈরি। তার দোয়া কীভাবে কবুল হবে’? (মুসলিম)
নবীজি আরো বলেছেন, ‘তোমরা খাবারকে পবিত্র করো, তাহলে তোমাদের দোয়া কবুল হবে’।
(৩) শিরক ও বিদাত করা: শিরক ও বিদআতের কারণে দোয়া কবুল হয় না। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা আল্লাহকে ডাকো এবং তার দ্বীনকে ইখলাসপূর্ণ ও একনিষ্ঠ করো’।
ইখলাস এবং একনিষ্ঠতার মূল হচ্ছে- শিরক ও বিদাত থেকে দূরে থাকা। যারা আল্লাহর সঙ্গে দেবতা, কবরবাসী, নেকলোক, মাজার ও অন্যান্য জিনিসকে শরিক করে এবং তাদের সাহায্য চায়, তাদের দোয়া কবুল হবে না। কেননা আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আল্লাহর সঙ্গে অন্য কাউকে তোমরা ডেকো নো’।
কবর পুজারীরা মৃতদের উসিলায় দোয়া কবুলের আহ্বান জানায় এবং বলে, আমরা অমুকের উসিলায় কিংবা তার সম্মানের উসিলায় দোয়া কবুলের দরখাস্ত করছি। তাদের এই দোয়া শিরক ও বিদাত।
কেননা আল্লাহ তাআলা কাউকে মাধ্যম কিংবা উসিলা বানিয়ে দোয়া করার নির্দেশ দেননি। তিনি বরং সরাসরি তার কাছে দোয়া করার নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, ‘তোমরা আমার কাছে দোয়া করো, আমি কবুল করবো’।
তবে হাদিসে পাকে নেক (আমলের) কাজের দোহাই দিয়ে দোয়া করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যেন এক গুহায় পাথর দ্বারা অবরুদ্ধ তিন ব্যক্তি তাদের তিনটি নেক আমলের কথা উল্লেখ করে দোয়া করায় আল্লাহ তাআলা তাদের দোয়া কবুল করেন এবং গুহার মুখ অবরুদ্ধকারী পাথরটিকে সরিয়ে তাদেরকে মুক্তি দেন। তাই কোনো নেক ব্যক্তি নয়, বরং নেক আমলকে উসিলা হিসেবে উপস্থাপন করা যায়। তবে আল্লাহ তাআলা তার কাছে কোনো উসিলা ছাড়াই দোয়া করার নির্দেশ দিয়েছেন।
(৪) অজ্ঞতা ও উদাসিনতা: গাফেল ও উদাস মনের ব্যক্তির দোয়াও আল্লাহ তাআলা কবুল করেন না। হাদিসে পাকে এসেছে- হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা এমনভাবে আল্লাহর কাছে দোয়া করো যেন তা কবুল হওয়ার দৃঢ় বিশ্বাস থাকে। তোমরা জেনে রাখো! গাফেল ও উদাস মনের ব্যক্তির দোয়া আল্লাহ কবুল করেন না’। (মুসতাদরাকে হাকেম)
(৫) সৎ কাজ না করা ও অসৎ কাজ প্রতিরোধ না করা: হজরত হুজায়ফা বিন ইয়ামান রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আমার প্রাণ যার হাতে, সেই আল্লাহর শপথ! হয় তোমরা সৎ কাজের আদেশ দাও এবং অসৎ কাজের প্রতিরোধ করবে, না হয় শিগগিরই তোমাদের উপর নিজ আজাব পাঠাবেন; এরপর তোমরা তার কাছে দোয়া করবে, তিনি দোয়া কবুল করবেন না’। (তিরমিজি)
হজরত আলি রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘দোয়া মুমিনের হাতিয়ার ও দ্বীনের খুঁটি এবং আসমান ও জমিনের আলো’। (মুসতাদরাকে হাকেম)
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে বিপদ নাজিল হয়েছে কিংবা এখনও নাজিল হয়নি তার জন্য দোয়া উপকারী। হে আল্লাহর বান্দারা, তোমাদের দোয়া করা জরুরি’। (মুসতাদরাকে হাকেম)
ইমাম ইবনুল কায়্যিম রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন, ‘মকসুদ অর্জন ক্ষতিকর জিনিস প্রতিরোধে দোয়া হচ্ছে শক্তিশালী উপায়। দোয়ার ফলাফল কয়েক কারণে দেখা যায় না। যদি মন্দ কাজ বা লক্ষ্য অর্জনের জন্য দোয়া করা হয় তাতে আল্লাহ তাআলার নাফরমানি থাকায় তা কবুল করেন না। দুর্বল মন ও বেপরোয়া মনের দোয়াও আল্লাহ কবুল করেন না। তিনি আরো বলেন, ‘দোয়া হচ্ছে সর্বোত্তম চিকিৎসা। তা বিপদের শত্রু এবং তা নাজিলে বাধা সৃষ্টি করে কিংবা হাল্কা করতে সাহায্য করে। দোয়া মুমিনের অস্ত্র।
(৬) তাড়াহুড়ো না করা: নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, দোয়া কবুলের ব্যাপারে তাড়াহুড়ো করলে দোয়া কবুল হয় না’। (মুসলিম, তিরমিজি)
সুতরাং মুমিন মুসলমানের উচিত, দোয়া কবুলে বাধা হয়ে দাঁড়ায় এমন সব কাজ থেকে বিরত থাকা। খাঁটি ও বিশুদ্ধ নিয়ত ধীরস্থিরভাবে দোয়া করা। কোরআন-সুন্নাহর দিকনির্দেশনা মোতাবেক দোয়া করা। আর তাতে দোয়া কবুল হবেই ইনাআল্লাহ! আল্লাহুম্মা আমিন।