মুফতি ইসমাঈল: ইবরাহিম (আ.) কাবাঘরের পুনর্নির্মাণের কাজ শেষ করে আল্লাহ তাআলার নির্দেশে হজের ঘোষণা করেন। তার এ ঘোষণা তখন পৃথিবীতে বিদ্যমান ও কিয়ামত পর্যন্ত আগমনকারী সব মানুষের কানে পৌঁছে দেওয়া হয়। কিয়ামত পর্যন্ত যারা হজ করবেন, তারা সেদিন ইবরাহিম (আ.)-এর ওই আহ্বানে সাড়া দিয়ে বলেছিলেন, ‘লাব্বাইক, আল্লাহুম্মা লাব্বাইক।’ (তাফসিরে ইবনে কাসির, খণ্ড: ০৩, পৃষ্ঠা: ২৬০)
হজ ও ওমরাহর সংজ্ঞা
‘হজ’ অর্থ—কোনো মহৎ কাজের ইচ্ছা করা। হজের নিয়তসহ ইহরাম ধারণ করে নির্দিষ্ট দিনে আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করা ও কাবা শরিফ তাওয়াফ করাকে হজ বলে। (ফাতাওয়া শামি : ২/৪৫৪) আর ‘ওমরাহ’ অর্থ—পরিদর্শন করা। ওমরাহর নিয়তে ইহরাম ধারণ করে তাওয়াফ ও সায়ি করে মাথা কামিয়ে ইহরামমুক্ত হওয়াকে ওমরাহ বলে। (ফাতহুল বারি : ৩/৫৯৭)
হজ কার ওপর ফরজ
হজ ইসলামের মৌলিক পাঁচ ভিত্তির অন্যতম। নবম হিজরি, মতান্তরে ষষ্ঠ হিজরিতে তা ফরজ হয়। প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ ও মক্কায় গিয়ে হজকার্য সম্পন্ন করে ফিরে আসার সামর্থ্য রাখে, এমন প্রত্যেক মুসলমান নারী-পুরুষের ওপর জীবনে একবার হজ করা ফরজ। তবে নারীদের জন্য স্বামী বা মাহরাম পুরুষ সঙ্গে থাকা শর্ত। (ফাতাওয়া শামি : ২/৪৫৫)
নারীদের মাহরাম কারা
যাদের সঙ্গে কখনো বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়া যায় না, তারাই মাহরাম। যেমন—পিতা, পুত্র, আপন ও সত্ভাই, দাদা-নানা, আপন চাচা ও মামা, ছেলে বা নাতি, জামাতা, শ্বশুর, দুধভাই, দুধ ছেলে প্রমুখ। তবে একা একা দুধভাইয়ের সঙ্গে এবং যুবতি শাশুড়ি জামাতার সঙ্গে যাওয়া নিষেধ। (রদ্দুল মুহতার, খণ্ড: ০২, পৃষ্ঠা: ৪৬৪)
হজের সওয়াব ও ফজিলত
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হজ করে এবং অশ্লীল ও গুনাহর কাজ থেকে বেঁচে থাকে, সে নবজাতক শিশুর মতো নিষ্পাপ হয়ে যায়। আর প্রকৃত হজের পুরস্কার জান্নাত ছাড়া অন্য কিছুই নয়।’ (বুখারি, হাদিস নং: ১/২০৬)
হজ করতে বিলম্ব করা উচিত নয়
যে বছর হজ ফরজ হয়, সে বছরই তা আদায় করা উচিত। অযথা বিলম্ব করা গুনাহ। হজ একবার ফরজ হলে তা আর কখনো মাফ হয় না। (আহসানুল ফাতাওয়া : ৪/৫২৮) মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি হজের ইচ্ছা করে, সে যেন তা দ্রুত আদায় করে নেয়। কেননা মানুষ কখনো অসুস্থ হয়ে পড়ে, কখনো সম্পদ খরচ হয়ে যায়, কখনো সমস্যার সম্মুখীন হয়।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস নং: ২০৭)
হজ না করার পরিণতি
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘হজ ফরজ হওয়ার পর তা আদায় না করে মৃত্যুবরণ করা আর ইহুদি বা খ্রিস্টান হয়ে মৃত্যুবরণ করার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।’ (তিরমিজি : ১/১৬৭)
হজের সময় ও তার নির্ধারিত স্থান
হজের নির্দিষ্ট সময়—শাওয়াল, জিলকদ ও জিলহজের প্রথম ১০ দিন। বিশেষত ৮ জিলহজ থেকে ১২ জিলহজ পর্যন্ত পাঁচ দিন। এ পাঁচ দিনই মূলত হজ পালন করা হয়। হজের নির্ধারিত স্থান—কাবা শরিফ, সাফা-মারওয়া, মিনা, আরাফাত ও মুজদালিফা। (আসান ফিকাহ : ২/২৫১)
হজ তিন প্রকার
ইফরাদ : শুধু হজের নিয়তে ইহরাম ধারণ করে ওই ইহরামেই হজকার্য সম্পন্ন করা।
তামাত্তু : শুধু ওমরাহর নিয়তে ইহরাম ধারণপূর্বক ওমরাহর আমল সম্পন্ন করে মাথা মুণ্ডন করে ইহরামমুক্ত হওয়া। অতঃপর সে সফরেই হজের নিয়তে ইহরাম বেঁধে হজকার্য সম্পাদন করা।
কিরান : একসঙ্গে ওমরাহ ও হজের নিয়তে ইহরাম ধারণ করে ওই একই ইহরামে ওমরাহ ও হজ পালন করা। এ তিন প্রকারের মধ্যে উত্তম হলো ‘কিরান।’ কিন্তু ইহরাম দীর্ঘায়িত হওয়ার কারণে নিষেধাজ্ঞাবলি সঠিকভাবে মেনে চলতে না পারার আশঙ্কা থাকলে ‘তামাত্তু’ই উত্তম। (ফাতাওয়া শামি : ২/৫২৯)
হজ-সফরের প্রাথমিক কার্যক্রম সম্পন্ন হওয়ার পর করণীয়
মানুষের অধিকারের প্রতি যত্নবান হওয়া। ঋণ থাকলে তা পরিশোধ করা। ইবাদতে কোনো ত্রুটি থাকলে তা শুধরে নেওয়া। তাওবা—ইস্তিগফার করা। এমন সফরসঙ্গী নির্বাচন করা, যিনি নেককার ও সহযোগিতাকারী। বেশি বেশি কোরআন তিলাওয়াত ও জিকির করা। হজের মাসালা-মাসায়েল শেখা। (ফাতাওয়া আলমগিরি : ১/২২০)
হজের নিয়ত খাঁটি হওয়া জরুরি
হজে যাওয়ার সময় নিয়ত বিশুদ্ধ করে নিতে হবে। মহান আল্লাহর হুকুম পালনার্থে তার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য হজ করছি—এমন নিয়ত করতে হবে। লোকে হাজি বলবে, সম্মান দেখাবে, প্রসিদ্ধি অর্জন হবে, ব্যবসা ভালো জমবে, ইলেকশনে ভালো করা যাবে—এ ধরনের মনোভাব নিয়ে হজ করলে সাওয়াব তো হবেই না; বরং লৌকিকতার কারণে গুনাহ হবে। (মুসলিম, হাদিস : ১৯০৫)
হালাল টাকা হজ কবুলের পূর্বশর্ত
হজের জন্য যে টাকা খরচ করা হবে, তা হালাল হতে হবে। হজের মধ্যে হারাম টাকা খরচ করাও হারাম। যে হজে হারাম টাকা খরচ করা হয়, সে হজ কবুল হয় না। (রদ্দুল মুহতার : ৩/৫১৯)
লেখক: শিক্ষক, জামিয়া আম্বরশাহ আল ইসলামিয়া, কারওয়ান বাজার, ঢাকা।
পিবিএ/জেআই