জেনে নিন যৌন আকর্ষণ কী?

পিবিএ ডেস্ক: চীনে নিষ্কাম ব্যক্তিদের সংখ্যা বাড়ছে, তারা এখন ইন্টারনেট-ভিত্তিক নানা ফোরামে বেশ সক্রিয় ডায়ানে শি কখনো যৌন আকর্ষণ অনুভব করেন না। বিষয়টি নিয়ে তিনি চিন্তিতও নন। কারো সাথে তার যৌন সম্পর্ক করার বিষয়টি তিনি ভাবতেই পারেন না। বলেন, আমার কাছে মনে হয়, যৌন আকর্ষণ কী জিনিস সেটা আমি জানি না। কিন্তু আমি মনে করি যৌন আকাঙ্ক্ষা থেকে মুক্ত থাকা আমার জন্য ভালো বিষয়। কারণ, আমি মনে করি যৌনতা একটি অর্থহীন বিষয়।

 

চীনে যৌন আকাঙ্ক্ষা অনুভব করেন না এমন মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। তবে তাদের সুনির্দিষ্ট সংখ্যা সম্পর্কে কোনো পরিসংখ্যান নেই। কানাডার মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক অ্যান্থনি বোগার্টের ধারণা ব্রিটেনে নিষ্কাম ব্যক্তি মোট প্রাপ্ত বয়স্কদের ১ শতাংশ। সে হিসেবে চীনের গবেষকরা মনে করেন, দেশটিতে প্রায় ১০.৮ মিলিয়ন নিষ্কাম ব্যক্তি আছেন। চীনে নিষ্কাম ব্যক্তিরা এখন ইন্টারনেট-ভিত্তিক নানা ফোরামে বেশ সক্রিয়। এগুলোর মধ্যে কিছু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অ্যাপ আছে যেগুলো বেশ জনপ্রিয়। তারা নিজেদের মধ্যে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ করে, নিজেদের অভিজ্ঞতা বিনিময় করে এবং নিজেদের ভাষাও তৈরি করেছে।

নিষ্কাম হিসেবে চিহ্নিত হওয়া
নিষ্কাম বিষয়টি নিজের মতো বিয়ে কিংবা যৌন সম্পর্ক থেকে বিরত থাকার মতো নয়। ডায়ানের বয়স যখন ২০’র কোঠায় পা দিলো তখন সে হংকং, ব্রিটেন এবং নেদারল্যান্ডসে পড়াশুনা করেছে। নেদারল্যান্ডসে পড়ার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ডাচ পুরুষের সাথে তার পরিচয় হয়েছিল। সে ব্যক্তির সাথে তার যখন প্রথম ডেটিং হলো তখন ডায়ানে নিজেকে নিষ্কাম হিসেবে আবিষ্কার করলো। দুজনের মধ্যে রোমান্টিক আবহ তৈরি হবার পরেও ডায়ানে বুঝতে পারছিল না যে কেন লোকটির প্রতি সে কোনো যৌন আকর্ষণ বোধ করেনি।

তখন সে নিজের সম্পর্কে জানার জন্য বিষয়গুলো নিয়ে অনলাইনের দ্বারস্থ হয়। এক পর্যায়ে সে একটি নেটওয়ার্ক খুঁজে পায়, যেটি বিশ্বে নিষ্কাম ব্যক্তিদের সবচেয়ে বড় প্লাটফর্ম। নিষ্কাম সম্পর্কে পড়াশুনার পর ডায়ানে বুঝতে পারলো, সে নিজেও ওই দলের অন্তর্ভুক্ত। আমার চারপাশের প্রতিটি মেয়ে প্রেম নিয়ে রীতিমতো পাগল ছিল। তারা ছেলেদের নিয়ে কথা বলতো। কিন্তু এগুলোর প্রতি আমার কোন ঝোঁক ছিল না’, বলেছিলেন ডায়ানে। তিনি বলেন একজন চীনা নারী হিসেব নিজেকে বাবা-মায়ের সামনে নিষ্কাম ব্যক্তি হিসেবে প্রকাশ করা খুব কঠিন কাজ। চীনা সংস্কৃতিতে পরিবার খুব গুরুত্বপূর্ণ। বাবা-মা যদি কোনভাবে বুঝতে পারে যে তাদের সন্তান বিয়ে করতে চায়না কিংবা তাদের সন্তান থাকবে না তখন তারা খুব উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন।

উপর থেকে চাপ প্রয়োগ
সরকারী পর্যায় থেকেও বিয়ে এবং সন্তান নেবার বিষয়ে চাপ থেকে। কারণ চীনের জনমিতি নিয়ে দেশটির ক্রমাগত উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে। চীনে ১৯৭০’র দশকের পরে যারা জন্ম নিয়েছে তাদের মধ্যে সাধারণ জনসংখ্যার অনুপাতের তুলনায় পুরুষদের সংখ্যা এখন অতিরিক্ত। কারণ ১৯৭০’র দশকের পরে দেশটিতে কন্যা শিশু গর্ভপাতের হার বেড়ে যায়। একটা উদ্বেগ তৈরি হয়েছে যে পুরুষরা বিয়ের জন্য নারী পাবে না। আমি বহুবার আমার বাবা-মাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি। শেষ পর্যন্ত আমার মা বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। তিনি আমার সাথে প্রতিজ্ঞা করেছেন যে আমাকে এমন একটি অবস্থায় ঠেলে দেবেন না যেখানে আমি অসুখী হবো। কিন্তু আমার বাবা খুব একরোখা। তিনি মনে করেন, আমার যদি পছন্দমতো ব্যক্তির সাথে দেখা হয় তাহলে আমি যৌনাকাঙ্ক্ষা অনুভব করবো।

‘বিশাল ফাঁদ’
যৌনতা এবং সম্পর্কের বিষয়গুলো নিয়ে পুনরায় ভাবনা তৈরি হয়েছে চীনে অনেকে নারীর মধ্যে। ডায়ানে তাদের মধ্যে একজন। এই সংখ্যা এখন আরো বাড়ছে। তারা শুধু যৌনতা এবং সম্পর্ক নিয়েই ভাবছে না, তারা বিয়ের মূল্যবোধ এবং সন্তান জন্মদানের বিষয়গুলো নিয়েও পুনরায় ভাবছে। আমি মনে করি বিয়ে বিষয়টি নারীর জন্য ভালো কিছু বয়ে আনে না। এটা একটা বিশাল ফাঁদ’, বলছিলেন ডায়ানে। যদি বিয়ে এবং যৌন সম্পর্ক ছাড়া সন্তান জন্ম দেয়া যেত, তাহলে মানুষ আরো অনেকে বেশি স্বাধীনতা ভোগ করতো। তাহলে ডায়ানে কি কখনোই কারো সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়াবেন না? তিনি কি নিঃসঙ্গ বোধ করেন না? জবাবে তিনি বলেন, তার অনেক ঘনিষ্ঠ বন্ধু আছে। তিনি মনে করেন তার বাকি জীবন একা কাটবে। কারণ, ডায়ানে তার মতো একজন নিষ্কাম ব্যক্তি খুঁজে পাবে না, যার সাথে প্রেমের সম্পর্ক হতে পারে।

শারীরিক সম্পর্ক

প্রেমের সম্পর্কে আগ্রহী অথবা অনাগ্রহী
চীনে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিষ্কাম বিষয়টি বেশ পরিচিত হয়ে উঠছে। কারণ নিষ্কাম ব্যক্তিরা এসব প্লাটফর্মে এখন যোগ দিচ্ছেন। চীনে জনপ্রিয় অ্যাপ জিহু, ইউচ্যাট এবং কিউকিউতে নিষ্কাম ব্যক্তিদের কমিউনিটি আছে। তাদের সদস্য সংখ্যা হাজার-হাজার। চীনে বিভিন্ন এজেন্সি এবং ওয়েবসাইট আছে যারা নিষ্কাম মানুষদের জন্য বিয়ের ঘটকালি করে। অধ্যাপক ডে অং গত পাঁচ বছর যাবত চীনের নিষ্কাম মানুষদের নিয়ে গবেষণা করছেন।

মালকা বানুর দেশে রে, বিয়ের বাদ্য বাজনা বাজে রে..

তিনি বলেন, নিষ্কাম মানুষদের মধ্যে কয়েকটি ধরণ আছে। তবে যৌন চাহিদা থাকা এবং না থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে শ্রেণিভেদ করার বিষয়টি আরো বেশি সুস্পষ্ট হওয়া দরকার বলে তিনি মনে করেন। যেসব নিষ্কাম মানুষ প্রেমের সম্পর্ক জড়ায় তাদের মধ্যে যৌন আকাঙ্ক্ষা থাকে না। তারা প্রেমের আকর্ষণ অনুভব করে। কিছু মানুষ বিষয়টিকে ‘প্লেটোনিক লাভ’ বা যৌনতা ছাড়া ভালোবাসা হিসেবে বর্ণনা করেন। এই প্রেমের সম্পর্ক বিপরীত লিঙ্গের সাথে হতে পারে, সম-লিঙ্গের সাথে হতে পারে কিংবা দুই ধরনের মানুষের সাথেই হতে পারে। আরো বিস্তারিত হলো, কিছু নিষ্কাম মানুষ আছে যারা সব লিঙ্গের মানুষে প্রতি রোমান্টিকতা অনুভব করে। এক্ষেত্রে মানুষের লৈঙ্গিক পরিচয় গুরুত্বপূর্ণ নয়। এ ধরনের মানুষদের ‘প্যানরোমান্টিক অ্যাসেক্সুয়াল’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়।

বেইজিং এর বাসিন্দা জু এরকম একজন মানুষ। তার একটি ছেলে বন্ধু রয়েছে। তবে সে ছেলে বন্ধুটি নিষ্কাম নয়। কিন্তু এখনো তাদের মধ্যে ভালো সম্পর্ক রয়েছে। আমি তার সাথে সেভাবে অন্তরঙ্গ হতে চাই না। তারপরেও সে আমাকে পছন্দ করে। আমার জন্য এটা সন্তুষ্টি দেবার মতো সম্পর্ক’, বলছিলেন জু। যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হবার বিষয়টি আমার কাছে স্বস্তিদায়ক নয়। কিন্তু আমার বয়ফ্রেন্ড মেয়েদের প্রতি যৌন আকাঙ্ক্ষা অনুভব করে। সেজন্য আমাদের মধ্যে একটি সমাধান খুঁজতে খুব কষ্ট করতে হয়েছে। জু মনে করে, নিষ্কাম হয়েও একজন মানুষ সুখী হতে পারে। এটা কোনো রোগ নয়। কিন্তু জু বিষয়টি এখনো তার বাবা-মায়ের কাছে পুরোপুরি তুলে ধরতে পারেননি। বিষয়টি নিয়ে জু যখন তার বাবা-মায়ের সাথে কথা বলতে গেছে তখন তারা বিষয়টিকে হেসে উড়িয়ে দিয়েছেন।

সামাজিক লজ্জা
অধ্যাপক অং বলেন, চীনের সমাজে একজন নিষ্কাম নারীকে কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়। নিষ্কাম নারীদের মধ্যে বেশিরভাগই বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রিধারী। চীনে সংস্কারের পরে বহু যৌন স্বাস্থ্য ক্লিনিক খুলেছে। এসব ক্লিনিকে বিয়ের সম্প্রীতি নিয়ে গুরুত্ব দেয়া হয়। তবুও আপনার যদি যৌন চাহিদার অভাব থাকে, আপনাকে লোকে লজ্জা দেবে, কারণ আপনি বিয়ের সম্পর্ক এবং সামাজিক স্থিতিশীলতা নষ্ট করছেন’, বলছিলেন অধ্যাপক অং। অনলাইনে যেসব নিষ্কাম কমিউনিটি আছে সেগুলো পর্যবেক্ষণ করেছেন তিনি। অধ্যাপক অং লক্ষ্য করেছেন, যেসব পুরুষ নারীদের প্রতি যৌন আকর্ষণ বোধ করে তারা নানা রকম মন্তব্য করে। কেউ কেউ বলে, ‘তুমি যদি আমার সাথে যৌনতার লিপ্ত হও তাহলে তুমি ভিন্ন কিছু অনুভব করবে। এটি নারীর প্রতি এক ধরনের অবমাননাকর বিষয়। বিষয়টা এরকম যে পুরুষরা যৌনতায় ভালো এবং তারা শেখাতে পারে কিভাবে একজন নারী যৌন আকাঙ্ক্ষা বোধ করতে পারে’, বলছিলেন অধ্যাপক অং।

 

নতুন ভাষা
করো সাথে বৈরিতায় না গিয়ে নিষ্কাম কমিউনিটি নিজেদের আলাদা ভাষা এবং পরিচয় গড়ে তুলছে বলে জানান অধ্যাপক অং। চীনে সন্তান-বিহীন পরিবারের সংখ্যা বাড়ছে। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই আয় করছেন, কিন্তু তাদের কোনো সন্তান নেই। নিষ্কাম দম্পতিরা এ ধরনের পরিবারকে আদর্শ মনে করে। বিয়ে হবে কিন্তু সেখানে কোন যৌনতার দিক থাকবে না।

অনলাইন ফোরামগুলো নিষ্কাম মানুষদের জন্য নতুন ভাষা এবং সংস্কৃতি তৈরির পাশাপাশি তাদের মতো অন্য মানুষদের সাথে সংযোগ করিয়ে দিচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় গৌ জু একবার এক পুরুষের সাথে দেখা হয়েছিল যিনি নিষ্কাম ব্যক্তি এবং সম-লিঙ্গের মানুষের প্রতি প্রেম অনুভব করেন। তিনি ব্যক্তি বলেন, তিনি এমন একজন মানুষকেও খুঁজে পাচ্ছেন না যাকে নিজের সম্পর্কে বলতে পারেন। তার কথা আমাকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল। কারণ, অধিকাংশ নিষ্কাম ব্যক্তি এরকমই অনুভব করেন। আমরা মনে করি বিষয়টি যেন আমাদের গোপন রাখতে হবে’। তিনি মনে করেন, নিষ্কাম ব্যক্তিরা অন্যদের কাছে তাদের পরিচয় যাতে তুলে ধরতে পারেন এবং অন্যদের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারেন, সেটি গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যদি মনে করেন আপনি নিষ্কাম, তাহলে আপনি নিষ্কাম। নিষ্কাম ব্যক্তিদের বৈচিত্র্যকে আমাদের সম্মান জানানো দরকার।

পিবিএ/বিএইচ

আরও পড়ুন...