রমজানের প্রথম রাত: যা কখনো মিস করা উচিত নয়

প্রথম রোজা
‘‘রমজানের প্রথম রাত, আল্লাহ তার প্রিয় বান্দাদের দিকে তাকান। আর যাদের মুখের দিকে তাকান, তাদেরকে তিনি কখনো শাস্তি দিবেন না।’’ – আল হাদীস

মুহাম্মদ আবুল হুসাইন

পবিত্র মাহে রমজান সমাগত। এই মুহূর্তে আমাদেরকে মহানবীর (সা.) এই হাদীসটি স্মরণে রাখা উচিত:

‘‘আমার উম্মতকে পাঁচটি উপহার দেয়া হয়েছে যা আগের আর কোন নবীকে দেয়া হয়নি। এক: রমজানের প্রথম রাত, আল্লাহ তার প্রিয় বান্দাদের দিকে তাকান। আর যাদের মুখের দিকে তাকান, তাদেরকে তিনি কখনো শাস্তি দিবেন না। দুই: ইফতারির আগমুহূর্তে রোজাদারদের মুখের গন্ধ আল্লাহর নিকট যে কোন উৎকৃষ্ট সুগন্ধির চেয়েও বেশি আনন্দের। তিন: রোজাদারদের মাগফিরাত কামনায় ফেরেশতাগণ রাত-দিন আল্লাহর দরবারে দোয়া করতে থাকেন। চতুর্থ: আল্লাহ জান্নাতকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘আমার বান্দাদের জন্য প্রস্তুত হও এবং সুসজ্জিত হও। তারা পার্থিব জীবনের যন্ত্রণা থেকে মুক্তির কাছাকাছি চলে এসেছে এবং আমার বেহেশ্ত এবং সম্মানের দিকে যাত্রা করছে।’ পঞ্চম: মাহে রমজানের সর্বশেষ রাত; তখন তিনি সব রোজাদারদেরকে ক্ষমা করে দেন।’’ [আহমদ ও আল বা’জার]

পবিত্র রমজান মাসের প্রতিটি রাতই সাধারণভাবে মাহাত্ম্যপূর্ণ, গুরুত্বপূর্ণ। তারপরও প্রথম রাতটিকে পৃথকভাবে বিশেষ মর্যাদা দেয়া হয়েছে। উপরোক্ত হাদীস অনুসারে প্রথম রাতে আল্লাহ তার বান্দাদের দিকে রহমতের দৃষ্টিত তাকাবেন। আর মহান রাব্বুল আ’লামীন একবার যার মুখের দিকে রহমতের দৃষ্টিতে তাকাবেন, তাকে তিনি আর কখনো শাস্তি দিবেন না।

মহান রাব্বুল আ’লামীনের এই যে রহমতের দৃষ্টি, যা রমজানের প্রথম রাতে মুসলিম নর-নারীরা পেতে পারেন, এ ব্যাপারে আমার মনে কিছু প্রশ্নের উদ্রেক করেছে-

পবিত্র রমজান মাসের প্রথম রাতটিকে কেন আলাদাভাবে অন্যান্য মাস থেকে বিশেষ মর্যাদা দেয়া হয়েছে, যে রাতে আল্লাহ তাঁর রোজাদার বান্দাদের প্রতি বিশেষ রহমতের দৃষ্টিতে তাকাবেন?

কীভাবে আমি আমার অন্যান্য প্রিয় মুসলিম ভাই ও বোনদের মত মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর রহমতের দৃষ্টি লাভ করে ধন্য হতে পারি?

এতে কোন সন্দেহ নেই যে, এই প্রথম রাতের মাহাত্ম্য এবং এই রাতে তাঁর বিশেষ দয়া প্রদর্শনের কারণ সম্পর্কে তিনিই সবচেয়ে ভাল জানেন, কারণ তিনি সর্বজ্ঞানী ও সর্বশক্তিমান। তবে আমাদের ক্ষুদ্র জ্ঞানে যা মনে হয়, প্রথম রোজাটা হলো রহমত, বরকত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাসের প্রারম্ভিক প্রবেশ পথ বা সদর দরোজা।

কিন্তু, দুঃখজনক হলেও সত্য, বহু লোক রমজানের প্রথম রাতের মাহাত্ম্যের যথার্থতা উপব্ধি করতে না পেরে একে অগ্রাহ্য করে এবং এই প্রথম রাতটির জন্য নিজেদেরকে প্রস্তুত করে না।কিছু রোক বরাবরের মতই দৈনন্দিন কাজে ব্যস্ত থাকে এবং বছরের অন্যান্য রাতের মতই এই রাতটিকেও পার্থিব কাজেই পার করে দেয়; পরম করুণাময়ের রহমতের দৃষ্টির আকক্সক্ষা তাদের মনে স্থানই পায় না। কিছু মানুষ আবার আছে মার্কেটিং, বিনোদন ইত্যাদিতেই ব্যস্ত থাকে এবং মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীনের রহমতের দৃষ্টি লাভে ধন্য ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত ব্যর্থ হয়।

মহান আল্লাহর এমন একটি দান ও করুণ রমজানের যে প্রথম রজনির মধ্যে নিহিত তাকে যথাযথ কদর করার জন্য বিশেষ উদ্যোগ ও যথার্থ মনোযোগ থাকা প্রয়োজন। যথার্থ অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে প্রস্তুতি গ্রহণ প্রয়োজন এবং এজন্য একটি পরিকল্পনা থাকা প্রয়োজন। মনে রাখা প্রয়োজন, এটি এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ রাত যা বছরে মাত্র একবারই আসে। সুতরাং আমাদের এটি মিস করা উচিত নয়।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম এই অনন্য ও পবিত্র সময়টির প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। তিনি বলেছেন, ‘‘যখন রমজানের প্রথম রাত আসে, তখন শয়তান এবং বিদ্রোহী জ্বিনদেরকে শিকল পড়িয়ে রাখা হয় এবং জাহান্নামের দরোজাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়, যার কোনটিই খোলা থাকে না। আর জান্নাতের সবগুলো দরোজা খুলে দেয়া হয়, যার কোনটিই বন্ধ থাকে না। এই মাসে একজন ঘোষক ঘোষণা করতে থাকেন, হে কল্যাণকামীরা, এগিয়ে আসো এবং হে অকল্যাণ প্রত্যাশিরা, বিরত থাকো। এই মাসে আল্লাহ তার বহু বান্দাহকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিবেন। এই ঘোষণা প্রতি রাতেই দেয়া হয়।’’- [আত তিরমিযি]

আমরা যেসব মুসলিম ভাই বা বোন আল্লাহর সেসব নেক বান্দাহদের অন্তর্ভুক্ত হতে চাই, যাঁদের দিকে পরম করুণাময় তাঁর দয়ার দৃষ্টিতে তাকাবেন; তাহলে আমাদেরকে এর জন্য কাজ করা উচিত। আমাদের উচিত প্রথম রাতের পবিত্র সময়কে কাজে লাগিয়ে পরওয়াদিগারের নৈকট্য লাভের চেষ্টা করা, তাঁর নিকট নিজেদেরকে সোপর্দ করা এবং তাঁর অনুগ্রহ, দয়া, ক্ষমা এবং সৌভাগ্য কামনা করা। এ ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত কর্মসূচিগুলো আমাদের জন্য বিশেষ সহায়ক হতে পারে।

১. অন্যায় বা মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকার দৃঢ় সিদ্ধান্ত নেয়া এবং বিগত সময়গুলোতে করে ফেলা অন্যায় কাজ বা গোনাহ’র জন্য আন্তরিকভাবে অনুতপ্ত হওয়া এবং তওবা করা।

২. পুরো রমজান মাসে রোজা রাখার জন্য নিয়ত করা এবং শুধুমাত্র পরম করুণাময় আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ এবং কেবলমাত্র তাঁর কাছ থেকেই পুরষ্কার লাভের প্রত্যাশা করা।

৩. শাবান মাসের শেষ দিনে মাগরিবের নামাজের আগেই আগেই মসজিদে যেয়ে জিকর (আল্লাহ’র স্মরণে) মসগুল হওয়া এবং জামায়াতের সাথে মাগরিবের নামাজ আদায় করে মসজিদেই ইতিকাফের নিয়তে এশা পর্যন্ত অবস্থান করা এবং জিকর ও কোরআন তেলাওয়াতে আত্মমগ্ন থাকা। এরপর খুশুখুজু বা বিনয় ও আন্তরিকতার সাথে জামায়াতে এশা ও তারাবির নামাজ আদায় করা।

একইভাবে বোনেরাও মসজিদে যদি মেয়েদের জন্য পৃথক জায়গার ব্যবস্থা থাকে তাহলে তারাও অনুরূপভাবে ইবাদত বন্দেগি করতে পারেন। তবে মেয়েদের জন্য বাড়ীতেই নিরিবিলি পরিবেশে জিকর, কোরআন তেলাওয়াত এবং মাগরিব, এশা ও তারাবির নামাজে আত্মমগ্ন থেকে ধ্যান, সাধনা এবং প্রার্থনার মাধ্যমে স্রষ্টার নৈকট্য লাভের চেষ্টা করা বেশি উত্তম।

৪. যখন আপনার কোন মুসলিম ভাই, বন্ধু, সহকর্মী, প্রতিবেশির সাথে দেখা হবে, তখন তাদেরকে মাহে রমজানের শুভেচ্ছা জানান এবং হাসিমুখে কথা বলুন।

৫. ঘুমানোর আগে কিছু নেক আমল বা ভাল কাজ করার চেষ্টা করুন, যেমন- দান/সদকা করা, কোরআন তেলাওয়াত, যিকর, অসুস্থ রোগীকে সাহায্য করা ইত্যাদি।

৬. তারাবীর নামাজের পর যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি ঘুমাতে যান এবং সেহরির আগে যতটা সম্ভব সময় হাতে রেখে ঘুম থেকে উঠুন যাতে এই পবিত্র রাতে সেহরি গ্রহণের আগে বেশি করে তাহাজ্জুদ নামাজ, কোরআন তেলাওয়াত করতে পারেন। সেহরির পর ফজরের ওয়াক্ত হয়ে গেলে মসজিদে যাওয়ার প্রস্তুতি নিন এবংফজরের সুন্নত নামাজ বাসা থেকেই পড়ে যাওয়ার চেষ্টা করুন। তবে বোনেরা ফজরের ফরজ নামাজ নিজেদের ঘরেই পড়তে পারেন।

৭. রাত্রিজাগরণ করে নফল নামাজের সময় সিজদায় যেয়ে পরম করুণাময় আল্লাহর কাছে আহাজারি করে কান্নাকাটি করে বিগত অপরাধের জন্য আন্তরিক ক্ষমা ভিক্ষা করুন এবং তাঁর রহমত ও করুণার দৃষ্টি কামনা করুন।

৮. মসজিদে প্রবেশ করে সময় থাকলে দু রাকায়াত দুখুলুল মসজিদ নামায পড়ে নিন। জামায়াত শুরু হওয়ার আগে সময় থাকলে কোরআন তেলাওয়াত (অর্থসহ), যিকর, দোয়া বা তাসবীহ পাঠ করতে পারেন।

৯. ফজরের নামাজের পর মসজিদেই অবস্থান করুন সূর্যাস্তের পর সালাতুল ইশরাক পড়ার আগ পর্যন্ত এস্তেগফার, তাসবীহ পাঠ, যিকর, আয়াতুল কুরশি, সূরা বাক্বারার শেষ রুকু, সূরা হাশরের শেষ রুকু সহ অর্থসহ কোরআন তেলাওয়াত বা দরস পড়তে থাকুন।

১০. ব্যক্তিগত ও আনুষ্ঠানিক সব ইবাদত-উপাসনা এবং নেক আমল করুন সহীহ নিয়তে, শুধুমাত্র আল্লাহকে ভালোবেসে, তাঁকে স্মরণ করে, তাঁকে হাজির-নাযির জ্ঞান করে এবং তাঁর কাছেই ফিরে যাওয়ার অনুভূতি নিয়ে।

১১. পরিবারের সদস্য, দুস্থ আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশি, বন্ধু-বান্ধবসহ নিজ দেশ ও বিশে^র সকল দুস্থ, মজলুম ও নির্যাতি মুসলিম ভাই-বোন ও শিশুদের কল্যাণ কামনা করে আল্লাহর কাছে অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে মিনতি সহকারে দোয়া করুন।

১২. রমজানের প্রথম রাতে আল্লাহর রহমতের দৃষ্টি লাভের জন্য আপনার পরিবার, আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদেরকেও উৎসাহিত করুন।

আল্লাহ আমাদেরকে তার সকল রহমত, বরকত, মাগফিরাত ও অনুগ্রহের দৃষ্টি লাভ করার তৌফিক দান করুন। পৃথিবীতে যা কিছু কল্যাণ তা লাভ করার এবং যা কিছু অকল্যাণ তা থেকে হেফাযত করুন। আমীন।

পিবিএ/এএইচ

আরও পড়ুন...