পিবিএ,ডেস্ক: ভারতে চলছে ভোটের মৌসুম। এবারের লোকসভা নির্বাচনের ভোট গ্রহণ হচ্ছে মোট সাত দফায়, ভোট দেবেন প্রায় ৯০ কোটি ভোটার। সব মিলিয়ে এক বিশাল কর্মযজ্ঞ চলছে ভারতজুড়ে। কিন্তু কে আসছেন দিল্লির সরকারে? নরেন্দ্র মোদি নাকি রাহুল গান্ধী? মোদির হিন্দু জাতীয়তাবাদকে কী টেক্কা দিতে পারবে রাহুলের ধর্মনিরপেক্ষ প্রগতিশীল আদর্শ?
ওপরের প্রশ্নগুলোর সরলরৈখিক উত্তর দেওয়া অসম্ভব। কারণ লোকসভা নির্বাচন ঘিরে ভারতের রাজনীতিতে জিলাপির প্যাঁচ খেলছে! এই প্যাঁচ এতটাই প্যাঁচানো যে, যদি-কিন্তুর শর্ত এড়িয়ে নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে আসা যাচ্ছে না। একদিকে ‘শক্তিশালী ভারত’ গড়ার স্বপ্ন দেখিয়ে জনগণের মন জয়ের চেষ্টা করছেন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী নরেন্দ্র মোদি। অন্যদিকে ভারতের ‘আত্মা’র ডাক শোনার আহ্বানে ভোটারদের মন ভোলাতে চাইছেন কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী। তাঁর পাশে আছে ভারতের অন্যান্য প্রগতিশীল ও বিজেপিবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো।
সমালোচকেরা বলছেন, মোদির বিপরীতে একক নেতা হিসেবে এখনো রাহুল গান্ধী ততটা শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেননি। এটি ঠিক যে, বিজেপির ‘মোদি মোদি’ রবের পাল্টা হিসেবে ‘রাহুল রাহুল’ স্লোগান তৈরি হয়নি। এর কারণ হিসেবে বিশ্লেষকেরা দায়ী করছেন বিজেপিবিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলোর এক সুরে কথা বলতে না পারার ব্যর্থতাকে। বিজেপি যেভাবে মোদিকে আবার প্রধানমন্ত্রী বানাতে আটঘাট বেঁধে নেমেছে, বিজেপিবিরোধীরা সেভাবে তা করছে না। কংগ্রেসসহ বিরোধীরা বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকারের নানা দুর্বলতা নিয়ে সরব থাকলেও, নির্বাচনে জিতলে রাহুল গান্ধীই প্রধানমন্ত্রী হবেন কি না, তা নিয়ে নীরব। এ নিয়ে বিজেপিবিরোধী শিবিরে অনৈক্যের বিষয়টি দিনের আলোর মতোই স্পষ্ট। আর এই ফাটলের সুযোগ নিচ্ছে মোদির বিজেপি।
অবশ্য একটি বিষয় পরিষ্কার যে, মোদির বিরুদ্ধে যদি কোনো সর্বভারতীয় নেতার লড়াই করার সামর্থ থাকে, তবে তিনি রাহুলই। ২০১৩ সালে কংগ্রেসের দ্বিতীয় শীর্ষ পদে আসীন হন তিনি। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে খেটেছিলেনও বেশ। কিন্তু সেবার মোদির ক্যারিশমায় ম্লান হয়ে গিয়েছিল সব। লোকসভা নির্বাচনের ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ ফল করেছিল কংগ্রেস। ৫৪৫টি আসনের মধ্যে মাত্র ৪৪টি আসনে জিততে পেরেছিল কংগ্রেস। মোদির বিতর্কিত নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত, করনীতির সংশোধন (জিএসটি) বা দেশের অর্থনীতির খারাপ সূচক রাহুলের হাতে ‘অস্ত্র’ তুলে দেয়। আর তা দিয়েই মোদির বিপক্ষে নিজেকে শক্তিশালী প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করিয়ে ফেলেছেন ‘পাপ্পু’। রাহুলের তূণে আরও যোগ হয়েছে ভারতে বেকারত্বের উচ্চ হার ও রাফাল যুদ্ধবিমান কেনা–সংক্রান্ত বিতর্কিত চুক্তি। লোকসভা নির্বাচন উপলক্ষে এখন ভারত চষে বেড়াচ্ছেন ৪৮ বছর বয়সী রাহুল, প্রতিদিন গড়ে পাঁচটি করে জনসভায় অংশ নিচ্ছেন তিনি।
অন্যদিকে নরেন্দ্র মোদির হাতে নতুন ও মোক্ষম অস্ত্র হচ্ছে পাকিস্তান বিরোধিতা। সাম্প্রতিক সময়ে ভারত–নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে হওয়া সন্ত্রাসী হামলার বদলা নিতে পাকিস্তানের সীমান্তের ভেতরে বিমান হামলা চালায় মোদির সরকার। আপাতত এ দিয়েই হিন্দু জাতীয়তাবাদের ধুয়া নতুন করে তুলেছে বিজেপি। মোদি বিভিন্ন জনসভায় বলছেন, নিরাপদে থাকতে হলে ভারতীয়দের তাঁকে ভোট দেওয়ার বিকল্প নেই। সন্ত্রাসবাদের ‘আতঙ্ক’ ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে বিজেপি। একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, বিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে একা মোদি প্রবল প্রতাপে দাঁড়িয়ে গেছেন। এ যেন তাঁর ‘ওয়ান ম্যান শো’!
এই মোদি ক্যারিশমার কারণেই বেকারত্বের উচ্চ হারের সমস্যাটিকে পাত্তা না দেওয়ার সাহস দেখাতে পারছে বিজেপি। এবারের লোকসভা নির্বাচনে জিতলে আরও পাঁচ বছর দেশ শাসনের ম্যান্ডেট পাবে বিজেপি। কিন্তু ইশতেহারে শুধু আগামী পাঁচ বছর নিয়ে ভাবছে না দলটি। বরং ২০৪৭ সালে ভারতে কী হবে—তা নিয়েও স্বপ্ন দেখাচ্ছেন নরেন্দ্র মোদি। ভোটের মুখে দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থার বাইরে থাকা মানুষের জন্য তিনি চালু করেছেন ‘জন ধন যোজনা’। কৃষকদের ব্যাংক হিসাবে আর্থিক সহায়তা পৌঁছে দিতে চালু করা হয়েছে নতুন স্কিম। দেশজুড়ে বিজেপির নেতৃত্বাধীন সরকারের গুণগান ছড়িয়ে দিতে চলছে ব্যাপক প্রচার, বিভিন্ন হিন্দিভাষী টিভি চ্যানেলে দেখা যাচ্ছে চটকদার সব বিজ্ঞাপন। পুরো দেশের মানুষকে একটি ‘শক্তিশালী’ ভারত উপহার দেওয়ার প্রলোভন দেখাচ্ছেন মোদি। বেকারত্বের সমস্যাকে বিজেপি বড় করে দেখতে না চাইলেও, সাধারণ মানুষের কাছে এটিই সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয়। ভারতের জনপ্রিয় সাপ্তাহিক পত্রিকা ইন্ডিয়া টুডের চালানো সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে, ভোটারেরা বেকারত্বের সমস্যাকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। এরপর আসছে গ্রামীণ ও কৃষি উন্নয়নের বিষয়। আর সবার শেষে আসছে জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন। অথচ বিজেপি এই জাতীয় নিরাপত্তার ইস্যুটিকেই গুরুত্ব দিচ্ছে বেশি।
মোদির আমলে ভারতে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে ‘গোহত্যা মহাপাপ’ এই বিষয়টি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলেছে। ফার্স্টপোস্টের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, এ নিয়ে ধর্মীয় উসকানি দেওয়ার চেষ্টাও হয়েছে। ফলে মুসলমানসহ অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে হিন্দুদের এক ধরনের বিভেদ ও দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। এ নিয়ে নানা সংঘাতে মোদির সরকার এক অর্থে নিশ্চুপ ছিল। অর্থাৎ বিভেদ ও ঘৃণার রাজনীতি দিয়েই ভারতে এক ধরনের ‘নিরাপত্তাহীনতার’ বোধ তৈরি করতে চেয়েছে মোদির বিজেপি। এখন তা দিয়েই ভোটের রাজনীতিতে জনগণের ম্যান্ডেট পেতে চাইছে দলটি।
এর বিপরীতে ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শ ছড়িয়ে দিয়ে ভোটারদের আকৃষ্ট করতে চাইছে রাহুল গান্ধীর কংগ্রেস ও অন্যান্য বিজেপিবিরোধী রাজনৈতিক দল। এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, কংগ্রেসের চিরায়ত কৌশল থেকে এবার অনেকটাই সরে এসেছেন রাহুল গান্ধী। ঐতিহ্যগতভাবেই কংগ্রেসকে পছন্দ করে ভারতের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জনগণ। সেই ভোটব্যাংক ধরে রাখার পাশাপাশি বিভিন্ন মন্দিরেও যাচ্ছেন রাহুল। লক্ষ্য হলো—উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের ভোট ছিনিয়ে নেওয়া। অথচ রাহুলের আগে কংগ্রেস নেতৃত্ব এই কাজে খুব একটা আগ্রহী ছিল না। এর সঙ্গে ভোট উপলক্ষে নতুন নতুন প্রতিশ্রুতি দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে কংগ্রেস। এ ছাড়া বিভিন্ন সরকারি নীতির কৌশলগত দিক নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন রাহুল। চার-পাঁচ বছর আগেও এসব নিয়ে জনসভায় খুব বেশি উচ্চকণ্ঠ ছিলেন না রাহুল। কিন্তু এখন নিজেকে পুরোপুরি বদলে ফেলেছেন তিনি। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পর থেকে রাহুল গান্ধীর নেতৃত্ব কৌশলে আমূল পরিবর্তন এসেছে। বিশেষ করে রাফাল চুক্তিতে দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে মোদিকে আদতেই বিপাকে ফেলতে পেরেছেন রাহুল। আরতি বলেন, ‘রাহুল নিজেকে অনেকটাই পরিবর্তন করেছেন। তিনি এখন আত্মবিশ্বাসী এবং এটি তাঁর বক্তব্যেই স্পষ্ট। নিজের পরিশ্রমেই এই দক্ষতা অর্জন করেছেন রাহুল গান্ধী।’
তবে নিন্দুকদের অভিযোগ, এ বছরের লোকসভা নির্বাচনে আদাজল খেয়ে লাগছে না রাহুলের কংগ্রেস। এ কারণেই বিভিন্ন রাজ্যের আঞ্চলিক দলগুলোর সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করার ব্যাপারে কংগ্রেসের আগ্রহ কিছুটা কম। বরং বিজেপিবিরোধী শক্তিগুলোর সঙ্গে সদ্ভাব বজায় রেখে ভোটের মাঠে নিজেদের শক্তি পরীক্ষার দিকে রাহুলের দলের মনোযোগ বেশি।
কংগ্রেসের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের বরাত দিয়ে বিবিসি বলছে, ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনকেই ‘পাখির চোখ’ করতে চাইছে এই দল। কংগ্রেসের হাইকমান্ড থেকে তৃণমূলের কর্মীদের কাছেও নাকি তেমনই ইঙ্গিত দেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ মোদি যেমন সুদূরে চোখ রাখছেন, রাহুলও তেমনি!
নির্বাচনী দৌড়ে তাই এখনই রাহুল গান্ধী ছিটকে পড়ছেন না। কারণ ভারতের জটিল ও দীর্ঘ নির্বাচন প্রক্রিয়ায় ফলাফল নিয়ে আগাম ঘোষণা দেওয়া খুব কঠিন। যেকোনো সময়েই উল্টে যেতে পারে তা।
পিবিএ/হাতা