রোজার মূল উদ্দেশ্য

ramadanমুহাম্মদ আবুল হুসাইন

প্রতিটি কাজেরই একটি উদ্দেশ্য থাকে।নামাজ, রোজা, হজ্ব, যাকাত এসব মৌলিক ইবাদত সমূহেরও উদ্দেশ্য রয়েছে।আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন উদ্দেশ্য ছাড়া যেমন কোন কিছু সৃষ্টি করেননি, তেমনি কোন বিধানও প্রদান করেননি।রোজার উদ্দেশ্য সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহ তায়া’লা ঘোষণা করেছেন:

‘হে ঈমান্দারগণ, তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর; যাতে তোমারা মুত্তাকী (খোদাভীরু) হতে পারো।’ -[বাকারা : ১৮৩]

‘আল্লাহ’র ভয়’ বা ‘তাক্বওয়া’ ইসলামের একটি মৌলিক পরিভাষা শুধু নয়, কেন্দ্রিয় ভাবধারা। এটি মানুষের সমস্ত কর্মকাণ্ডের নিয়ন্ত্রক এবং ইসলামী নৈতিকতার প্রাণশক্তি। আল্লাহ’র ভয় ছাড়া কোন ব্যক্তির পক্ষেই নিরংকুশভাবে নৈতিকতার আদর্শকে সমুন্নত রাখা সম্ভব নয়। সমাজ ও লোক-চক্ষুর সামনে যে কেউ-ই ভাল মানুষ সাজার চেষ্টা করতে পারে। কিন্তু আল্লাহ’র ভয় না থাকলে এসব লৌকিক পাহারার অনুপস্থিতিতে নৈতিক আদর্শকে বজায় রাখা কারো পক্ষেই সম্ভব হয় না। তখন পদে পদে নফস-প্রবৃত্তির সাথে আপোষ করতে আর কারো দেরি হয় না। এ কারণে আল্লাহ’র ভয় মানুষের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ইসলামের একটি কেন্দ্রিয় বিষয় হওয়ার কারণেই আল্লাহ’র ভয় বা পরহেজগারী সম্পর্কে যথার্থ ধারণা থাকা জরুরী। আল্লাহকে ভয় করতে হবে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে, প্রতিটি কাজে, শুধু মাত্র কোন আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে নয়। আল্লাহ আমাদের ভিতরের-বাইরের, আমাদের মনের প্রতিটি খবরই জানেন। প্রতি মুহূর্তেই আমাদের মনে রাখতে হবে যে, আল্লাহ সর্বজ্ঞ, তিনি আমাদের সবকিছু দেখছেন এবং প্রতিটি কাজের জন্যই আমাদেরকে তাঁর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেছেন :

‘হে নবী! লোকদের সতর্ক করে দাও যে, তোমাদের মনে যা কিছু আছে, তা গোপন করা কিংবা প্রকাশ কর, আল্লাহ তার সব কিছুই জানেন। আসমান ও জমিনের কোন জিনিসই তাঁর জ্ঞানের আওতার বাইরে নয় এবং তাঁর ক্ষমতা-কর্তৃত্ব প্রতিটি বস্তুকেই পরিবেষ্টন করে আছে।’ -[আলে ইমরান : ২৯]

আল্লাহ’র ভয় বা তাক্বওয়ার গুণ অর্জন ছাড়া প্রবৃত্তির দাসত্ব থেকে মুক্ত হয়ে এক আল্লাহ’র দাসত্ব বা গোলামী করা যেমন সম্ভব নয়, তেমনি আল কোরআন থেকে হেদায়াত লাভ বা ইসলামী জিন্দেগী যাপনও সম্ভব হবে না। এ কারণে আল কোরআনের দ্বিতীয় সূরা আল বাকারার শুরুতেই আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নিজেই জানিয়ে দিয়েছেন যে, এই কিতাব মুত্তাক্বীদের জন্য হেদায়াত। অর্থাৎ এই কিতাব থেকে হেদায়াত লাভ করতে হলে আমাদেরকে অবশ্যই মুত্তাকী বা তাক্বওয়ার গুণাবলী অর্জন করতে হবে।

কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আল্লাহ’র আনুগত্যের মতই আল্লাহ’র ভয়কেও আমরা একটি বিশেষ টাইপের মধ্যে সীমিত করে ফেলেছি। আসলে আল্লাহ’র আনুগত্য যেমন শুধুমাত্র উপাসনার চার দেয়ালের মধ্যে সীমিত নয়, বরং জীবনের সর্বক্ষেত্রে; লেনদেন, ব্যবসা-বাণিজ্য, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র সর্বক্ষেত্রে বিস্তৃত; তেমনি আল্লাহ’র আনুগত্যের সাথে আল্লাহ’র ভয়ের প্রশ্নটিও জড়িত। জীবনের সর্বক্ষেত্রে আমরা আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীনকে কতটুকু যথার্থ ভয় করছি তা নির্ভর করবে আমাদের অন্তরে আল্লাহ’র ভয় কতটুকু আছে তার উপর। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হচ্ছে আমাদের সমাজের একটি বিশেষ শ্রেণীর লোক আছেন যারা নিজেদেরকে অত্যন্ত পরহেজগার বলে মনে করেন। অথচ তারা এই পরহেজগারীকে শুধুমাত্র একটি বিশেষ টাইপের পোষাক, নির্দিষ্ট মাপের দাড়ি এবং কিছু আনুষ্ঠানিকতার ফ্রেমে বন্দী করে ফেলেছেন। তারা আমাদের পবিত্র ধর্ম এবং এর মূল স্পিরিটকে একটি বিশেষ টাইপ আর আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে বন্দী করে সমাজ কাঠামো এবং সভ্যতা-সংস্কৃতি-রাজনীতির বৃহত্তর ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত খোদাবিমুখ ফাসেক, স্বেচ্ছাচারী ও ধর্মদ্রোহী তাগুতি শক্তির হাতে তুলে দিয়েছেন এবং সমাজ-সংস্কৃতি-রাজনীতির প্রতিটি ক্ষেত্রে তাদেরই অন্ধ অনুসরণ করে চলেছেন। আসলে ঈমানদারী আর পরহেজগারীর আসল পরীক্ষার মুখোমুখি হই আমরা আমাদের বাস্তব কর্মক্ষেত্রে, আমাদের শিক্ষা-সভ্যতা-সংস্কৃতি-রাজনীতির কঠিন ময়দানে। এই কঠিন ময়দানের পরীক্ষা ক্ষেত্রে এসে তখন অনেক প্রাতিষ্ঠানিক ধার্মিককেই দেখা যায় আল্লাহ’র পরিবর্তে বাতিলকেই বেশি ভয় করতে কিংবা বেশি মহব্বত করতে। আসলে এটাও এক প্রকার সুবিধাবাদ বা নফসিনিয়াত।

রমজান মাস এমন এক মাস, যে মাসে শত কষ্ট সত্বেও আমরা দিনের বেলায় জীবনের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় খাদ্য-পানীয় গ্রহণ এবং শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন থেকে বিরত থাকি। বিগত এগারো মাসে আমরা সাধারণত আত্মিক চাহিদার চেয়ে দৈহিক চাহিদা ও কামনা-বাসনাকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকি। সে সময় আমরা যথাযথভাবে আল¬াহর ইবাদত-বন্দেগী করা বা হুকুম আহকাম পালন করা হয়ে ওঠেনা। সে সময় আমরা প্রবৃত্তির তাড়নায় কিংবা লোভ-লালসার কারণে এমনসব কাজও করে ফেলি যা করা আমাদের মোটেও উচিত ছিল না। বলা যায় আমরা প্রায় সারা বছরই গাফলতির মধ্যে ডুবে থাকি, আমাদের কুপ্রবৃত্তিগুলো প্রবল হয়ে ওঠে এবং আল¬াহর নৈকট্য থেকে অনেক দূরে সরে যাই। কিন্তু এটা কোন ঈমানদারীর বৈশিষ্ট হতে পারে না। ঈমানদারী আর প্রবৃত্তির গোলামী একসাথে চলতে পারে না। বরং একজন মুমিন-মুসলমানের কাজ হল সমস্ত লোভ-লালসা তথা কুপ্রবৃত্তিকে দমন করে সর্বাবস্থায় আল্লাহকে ভয় করে চলা। এটা মুমিনের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। যদিও কুপ্রবৃত্তি ও শয়তানের কুমন্ত্রণা, বৈরী পারিপার্শিকতার কারণে এই চ্যালেঞ্জের যথাযথ মোকাবেলা করতে পারি না। কিন্তু মাহে রমজান হল কুপ্রবৃত্তির উপর সুপ্রবৃত্তিকে বিজয়ী করার মাস, আত্মসংযমের মাস। এ মাসে আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন আমাদের দৈহিক ও জৈবিক চাহিদাকে সীমিত করে দিয়েছেন যাতে আমরা বস্তুগত চাহিদার তুলনায় নৈতিক বা আত্মিক চাহদিাকে প্রাধান্য দিতে পারি। বস্তুত: এটি হল আধ্যাত্মিক উন্নয়নের এক ধারাবাহিক সাধনার মাস, যাতে বছরের বাকি মাসগুলোতে আমরা ঈমানদারীর বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে চলতে পারি।

পিবিএ/এএইচ

আরও পড়ুন...