শামীম আহমেদ:
১৫ বছর পর আমার শরীরে তীব্র জ্বর এসেছে।
শৈশবে এমন জ্বর আসলে বই পড়তে হয়নি। গত দুদিন জ্বর থাকলেও আমি লেখা পড়া বন্ধ করিনি। গত কাল একটি অনলাইন ক্লাসেও যুক্ত ছিলাম। তবে চলমান এই জ্বরের সাথে ঝড় মিলেমিশে একাকার। সাহিত্যিকরাই কেবল এই ঝড়ের গোড়াপত্তন বুঝতে পারবেন। (চট্টগ্রামের মেয়ে) বাংলাদেশের জনপ্রিয় তরুন শিশু সাহিত্যিক, খ্যাতিমান উপন্যাসিকের জন্য ছোট্ট কবিতা ও কিছু কথা:-
বিদেশের ভালোবাসা দিয়ে
যে প্রেয়সী পেতেছে আসন
চিরদিন রাখিবে বাঁধিয়া
কানে কানে তাহারি ভাষণ।
ভাষা যার জানা ছিল নাকো,
আঁখি যার কয়েছিল কথা,
জাগায়ে রাখিবে চিরদিন
সকরুণ তাহারি বারতা।
চট্টগ্রামে বিয়ের নিয়ম ও আমার কিছু স্মৃতি।
২০০৪-৫ শিক্ষাবর্ষ। আমি গিয়েছিলাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ ভির্তি পরীক্ষা দিতে। সেখানে বসবাসরত (আমার দাদুর আপন ভাইয়ের ছেলে) জাকির কাকার বাসায় উঠছিলাম ভর্তি পরীক্ষার আগের দিন। চট্টগ্রামে আমার এক পরিচিত কাকির আমন্ত্রনে তাদের বাসায় গিয়েছিলাম। কাকির দুটো মেয়ে ছিল। বড় মেয়ের নাম ছালমা। মেয়েটিকে আমার সাথে বিয়ে দেয়ার ব্যাপারে কাকির ইচ্ছে ছিল। এর পর আর কোন কথা হয়নি তাই বিষয়টি এ পর্যন্তই। আমার আগ্রহ ছিল না সুতরাং এ নিয়ে আর স্মৃতিও নেই।
সেদিন ছিল শুক্রবার। সকাল ৮টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য রওনা দিয়ে আধাঘন্টা পর বিশ্ববিদ্যালয় পৌছাই। সকাল দশটায় বাণিজ্য অনুষদের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছি। পরীক্ষা শেষে শহীদ আবদুর রব হলের এক আবাসিক শিক্ষার্থীর সাথে আমার পরিচয়। আমি সেখানে নতুন জেনে তিনি ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু এলাকা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখালেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের খুব কাছে তার এক আত্মীয়র নিজস্ব বাড়ি। সেখানে আমার মধ্যাহ্ন ভোজ তার সাথে। আজ সেই শিক্ষার্থীর নাম মনে নেই। কেবল রয়ে গেছে এসব স্মৃতি। চট্টগ্রামের মানুষ অতিথি আপ্যায়নে নিজেদেরকে গর্বিত স্থানে রাখছে। তবে বিয়ের ক্ষেত্রে কাবিনের অংকটা একটু বেশি।
সেদিন গ ইউনিটের পরীক্ষা দিয়ে সেই জাকির কাকার বাসায় ফিরছিলাম। সপ্তাহ খানেক পরে ঘ ইউনিট অর্থাৎ ডি ইউনিটের পরীক্ষা। আমি সেই “ঘ” ইউনিটের পরীক্ষার প্রস্ততি নিয়ে গেলেও পরীক্ষা আর দেয়া হয়নি। কেবল “গ” ইউনিটের পরীক্ষায় অংশ নিয়েই দু’দিনের মধ্যেই অসুস্থ হয়েছি। আমার তখন অনেক জ্বর উঠছিল। চট্টগ্রামের আবহাওয়ার সাথে আমার শরীরের মিল হয়নি। শৈশবে গ্রামীন পরিবেশের সাথে বড় হয়ে কৈশরে কোন শহরে গমন ওটাই আমার জীবনে প্রথম।
অসুস্থতা নিয়ে ফরছিলাম ঢাকায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি জসিম উদ্দিন হলের ৪১৭ নং কক্ষে উঠছিলাম। এখানে রয়েছে আমার চার পাঁচ বছরের স্মৃতি। এই রুমের আশের পাশের রুমে থাকেন তৎকালিৎ ক্ষমতাসীন ছাত্রনেতারা। খালেদাজিয়া তখন রাষ্ট্রপ্রধান। (সেই রাষ্ট্রব্যবস্থাকে আমি তখনই পছন্দ করতাম না। আমি যেতাম ছাত্র লীগের মিটিং মিছিলের আশে পাশে। এ ব্যাপারে মাহাবুব মামা আমায় সতর্ক করে বলছেন- “তুমি যদি ছাত্র লীগের আশে পাশে যাও তবে এই মুহুর্তে তোমায় হলে রাখা আমার জন্য চ্যালেঞ্জ হবে”) জসিম উদ্দিন হলের ছাত্রদের দৃষ্টিতে হলের ভিআইপি ব্লক যেখানে আমি থাকি। হলের কেন্টিনে আমি সেই টেবিলে খেতাম সংরক্ষিত যে টেবিলে হলের প্রেসিডেন্ট সেক্রেটারি খেতেন। সেন্টার্ল প্রেসিডেন্ট এবং সেক্রেটারী আজিজুল বারী হেলাল ও শফিউল বারি বাবু এই ব্লকে গিয়েছেন বেশি কয়েকবার। আমার পাশের রুমে থাকা অনেক শিক্ষার্থী সাংবাদিকতায় যুক্ত ছিলেন। এনটিভিতে রাজনৈতিক প্রতিবেদক আহমেদ পিপুল তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। যেদিন ওই হলে উঠছি তার পরের দিনই আমাকে চিকিৎসা দেয়ার জন্য ভর্তি করানো হল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা কেন্দ্রে। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাশেই এই চিকিৎসা কেন্দ্র। মামা মাহাবুবুর রহমানের ক্ষমতার প্রভাবে আমাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা কেন্দ্র ভর্ভি নেয়। তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষাও দেইনি। সে মতে আমাকে ওখানে চিকিৎসা প্রদান বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি বিধানের বাইরে ছিল। সুফল পাইনি তবুও। পুরোপুরি সুস্থ্যবোধ করিনি। অসুস্থ্যতার তীব্রতা বৃদ্ধি পাওয়ায় সপ্তাহখানেক পর গ্রামের বাড়িতে ফিরে যেতে হয়েছিল। কি এক অজানা অসুস্থতায় আমি সে বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষাও দিতে পারিনি। তার পরের বছর অংশ নিয়েছিলাম ভর্তি পরীক্ষায়। তখন কোন শিক্ষার্থীর পরের বছর অর্থাৎ দুবার ভর্তি পরীক্ষার সুযোগ ছিল। এর পর কেটে গেল জিবন থেকে ১৫ বছর। সেই গল্প তো এতো সংক্ষেপে বলার ভাষা নেই।
১৫ বছর পর ফিরে যেতে মন চায় সেই চট্টগ্রামে:-
সম্প্রতি কালের ঘটনা। চট্টগ্রামের একটি মেয়েকে আমার বেশ পছন্দ হয়েছে। ৩০ আগষ্ট ২০২০ তারিখ আমি তাকে প্রথম দেখছি। সেদিন রাতেই তার সাথে প্রথম কথা হয়েছে। তাকে প্রেম নিবেদন করতে আমি একটু সময় নেইনি। তাকে দেখার পর বন্যার পানির মতো প্রেমের উচ্ছ্বাস আছড়ে পড়ছে আমার মনের দোরগোড়ায়। এই নতুন প্রেমের উচ্ছ্বাস কতটা প্রবল ছিল, তা সেই মেয়েটিকে আমি বোঝাতে সক্ষম হয়েছি। এটা আমার প্রেমের সাফল্য। মেয়েটি প্রেমানুভূতির যেন পূর্ণ প্রকাশ করে যে স্মৃতি রচনা করছে তা আমার হৃদয়পট থেকে কোনদিন হারিয়ে যাবে না।
চট্টগ্রামের সেই মেয়েটি অত্যান্ত মেধাবী উপন্যাসিক ও ভালো লেখক। তবে এসব গুন তার প্রতি আমার আকর্ষনের কারন নয়। তাকে আমার ভালোলাগার একটি বিশেষ কারন আছে। মানুষের অনেক গুন আছে। তারও এমন একটি স্থায়ি গুন আছে যে কারনে তাকে আমি চাই। সে গুনটি গোপন না রাখলে প্রেমের রস শুকিয়ে যাবে। যদি সেই গুনের আংশিক প্রকাশ করি তাহলে বলতে হবে রোমান্টিকদের যে যে বৈশিষ্ট্য থাকে, তার সবই এই মেয়েটির মধ্যে আছে অত্যন্ত প্রকট ভাবে। তীব্র কল্পনাপ্রবণতা, সুদূরের প্রতি আকর্ষণ, সূক্ষ্ম সৌন্দর্যবোধ, প্রকৃতির প্রতি বাঁধভাঙা আকর্ষণ মেয়েটি প্রধানতম বৈশিষ্ট্য। এসব বৈশিষ্ট্য আমার প্রেমানুভূতিকে দারুণভাবে প্রভাবিত করেছে। ফলে প্রেমানুভূতির জন্য আমার কাছে মেয়েটির প্রত্যক্ষ শারীরিক উপস্থিতির প্রয়োজন হয়নি। অনেক সময় শারীরিক উপস্থিতিকে আমি প্রেমের অন্তরায় বলে মনে করি। এমন প্রেমের ব্যাপারে রবী ঠাকুর বলছেন কোন কাঙ্ক্ষিত নারী যখন কল্পনা থেকে বাস্তবের মধ্যে চলে আসে, কল্পনার অসীম থেকে সংসারের সীমার মধ্যে চলে আসে, তখন প্রেম আর থাকে না। কারণ ‘অনন্ত আকাশের ফাঁক না পেলে বাঁশি বাজে না’। এ কারণে একসময় যে নারী ছিল সংসার-সীমার বাইরে কল্পনার মায়াঞ্জন মাখা, সে যখন সংসারের মধ্যে আসে তখন ওই প্রেমের তীব্রতা থাকেনা। নারী পুরুষের প্রেম ফুরিয়ে যাওয়ার ব্যাখ্যা শ্রী বরীন্দ্রনাথ এভাবেই দিয়েছেন। প্রেমের ক্ষেত্রে শরীরকে রবী ঠাকুর বরাবরই গৌণ মনে করতেন। বিষয়টি খুব স্পষ্টভাবে লক্ষ করা যায় তাঁর বিখ্যাত ‘সুরদাসের প্রার্থনা’ কবিতায়। ওই কবিতায় কবি তাঁর প্রেয়সীকে দেবী সম্বোধন করে বলেছেন-
এ আঁখি আমার শরীরে তো নাই,
ফুটেছে মর্মতলে—
নির্বাণহীন অঙ্গারসম নিশিদিন শুধু জ্বলে।
সেথা হতে তারে উপাড়িয়া লও
জ্বালাময় দুটো চোখ।
তবে নারীর শরীরের দিকে তিনি তাকাতেন না তা আমি পুরোপুরি বিশ্বাস করি না। আমি এইচ এস সিতে তার “হৈমন্তী” নামের একটি গল্পে পড়ছি নারীর স্বাদ নিয়ে তিনি সেখানে বলছেন “নরমাংসের স্বাদ পাইলে মানুষের সম্বন্ধে বাঘের যে দশা হয়” নারীর স্বাদ না পেলে এমন উদাহরন দিলেন কি করে !
কিন্তু সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের প্রেম সম্পর্কিত আবেগ আর ধারণার পরিবর্তন হয়। আমাদের এই বাংলাদেশের মতো ক্ষুদ্র ভূ-খন্ডের একটি রাষ্ট্রে কোন আঞ্চলিক প্রেমে আমি যেন আজ ডুবে গেলাম।
চট্টগ্রামের আঞ্চলিক প্রেম-বিয়ে ও আমার কৈফিয়াত:-
গল্পের গোড়ার দিকেই বলছি চট্টগ্রামে গিয়ে আমার জ্বর হয়েছিল ১৫ বছর আগে। ১৫ বছর পর আজ সেই চট্টগ্রাম অঞ্চলের একটি মেয়ের প্রেমে পরে জ্বর হয়েছে। তখনকার জ্বর ছিল কেবল শরীরে এখন জ্বর এসেছে শরীরে এবং ঝড় এসেছে মনে। শক্তিশালী কি জ্বর নাকি ঝড় ? গত রাতে তার সাথে কথা বলে সারা রাত ঘুমহয়নি। সকালে কিছু সময় ঘুমালেও দুপুরে ঘুম ভাঙার পর টের পাই শরিরে জ্বর উঠছে।
৪ সেপ্টেম্বর ২০২০ রাতের কথার আংশিক:-
সমুদ্রের দুকুল ছাপিয়ে যাওয়ার মত সেই কথার ঢেউ আমার এই শরীর জ্বর ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। কথা চলা কালেই আমার জ্বর একবার তীব্র হয়ে উঠছিল। কারন, মেয়েটি জোকঁস করে আমায় বলছে চট্টগ্রামের বিয়েতে মেয়েকে কমপক্ষে দশ ভরি স্বর্ণালঙ্কার ও ২০ লক্ষ টাকার কাবিন করতে হয়। মেয়েটির বক্তব্যে আমাকে বুঝানো হয়েছে এটা সিম্পল ম্যাটার। তবে এই বিধি বিধানে মেয়েটিরও আপত্তি। সে বলছে আঞ্চলিক এমন রীতি ভেঙে যাচ্ছে দিনে দিনে। চট্টগ্রামের অনেক মেয়েদের অন্য জেলায় বিয়ে হয় কম। আগের তুলনায় এখন অনেক বেশি। এই নিয়ন নীতি নিয়ে তখন আমারও কিছু আপত্তির কথা তাকে জানাই। সে বলছে আমার সাথে তার বিয়েতে এমন রীতি রহিত করা হবে। এই কথা শুনেই আমার জ্বর শেষ। হিহিহি কোনদিন বিয়ে করিনিতো তাই বিয়েতে এতো টাকা ব্যায় করার কথা শুনে আমার জ্বর তীব্র হয়েছিল। এক পর্যায়ে পরষ্পর সেক্রিফাইজ ও শিথিল হয়ে আমাদের মধ্যে কিছু সন্ধি হয়েছে। এর পরের আলোচনা এতোই মধুর ছিল তাতে তার ঐশ্বরিক শক্তির প্রকাশ পায়। সে বললো কিসের জ্বর ? জ্বর থাকবেইনা। সত্যিই জ্বর নাই। গত রাতে কথা বলে মেয়েটি আমার জ্বর একেবারে সারিয়ে তুলছে। আমার সাথে তার তিন ঘন্টা কথা বলা যেন অষুধ প্রয়োগ করা মতোই ছিল।
শ্রী বরীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলছেন নারীর হৃদয়ের রহস্য জানিবার মতো অভিজ্ঞতা আমার হইল না। নিতান্তই উপর হইতে, বাহির হইতে, যেটুকু দেখিলাম তাহাতে আমার এই বিশ্বাস জন্মিয়াছে যে, যেখানে মেয়েরা দুঃখ পাইবে সেইখানেই তারা হৃদয় দিতে প্রস্তুত। এমন পশুর জন্য তারা আপনার বরণমালা গাঁথে যে লোক সেই মালা কামনার পাঁকে দলিয়া বীভৎস করিতে পারে। আর তা যদি না হইল তবে এমন কারো দিকে তারা লক্ষ্য করে যার কণ্ঠে তাদের মালা পৌঁছায় না, যে মানুষ ভাবের সূক্ষ্মতায় এমনি মিলাইয়াছে যেন নাই বলিলেই হয়। মেয়েরা স্বয়ম্বরা হইবার বেলায় তাদেরই বর্জন করে যারা আমাদের মতো মাঝারি মানুষ, যারা স্থূলে সূক্ষ্মে মিশাইয়া তৈরি—নারীকে যারা নারী বলিয়াই জানে, অর্থাৎ, এটুকু জানে যে, তারা কাদায় তৈরী খেলার পুতুল নয়, আবার সুরে তৈরি বীণার ঝংকারমাত্রও নহে। মেয়েরা আমাদের ত্যাগ করে, কেননা আমাদের মধ্যে না আছে লুব্ধ লালসার দুর্দান্ত মোহ, না আছে বিভোর ভাবুকতার রঙিন মায়া। আমরা প্রবৃত্তির কঠিন পীড়নে তাদের ভাঙিয়া ফেলিতেও পারি না, আবার ভাবের তাপে গলাইয়া আপন কল্পনার ছাঁচে গড়িয়া তুলিতেও জানি না; তারা যা, আমরা তাদের ঠিক তাই বলিয়াই জানি—এইজন্য তারা যদি-বা আমাদের পছন্দ করে, ভালোবাসিতে পারে না। আমরাই তাদের সত্যকার আশ্রয়, আমাদেরই নিষ্ঠার উপর তারা নির্ভর করিতে পারে, আমাদের আত্মোৎসর্গ এতই সহজ যে তার কোনো দাম আছে সে কথা তারা ভুলিয়াই যায়। আমরা তাদের কাছে এইটুকুমাত্র বকশিশ পাই যে, তারা দরকার পড়িলেই নিজের ব্যবহারে আমাদের লাগায়, এবং হয়তো-বা আমাদের শ্রদ্ধাও করে।
এ-সব খুব সম্ভব ক্ষোভের কথা, খুব সম্ভব এ-সমস্ত সত্য নয়। চট্টগ্রামের মেয়েটি অসম্ভব ভালো একজন মানুষ। ভাল একজন মানুষ হওয়া প্রেমের প্রথম শর্ত। আমি যদি এই মেয়েটিকে বাস্তবে না পাই। তাহলে ধরে নেব খুব সম্ভব আমরা যে কিছুই পাই না সেইখানেই আমাদের জিত। অন্তত, সেই কথা বলিয়া নিজেকে সান্ত্বনা দিতে পারবো। না পাওয়া বা হারানোর কথা শুনলেই সেই মেয়েটি আমার সাথে অভিমান দেখায়। এবং এখন থেকে সে আমার দিকে করা নজরদারি অব্যহত রাখছে। বিশেষ করে ফেসবুকে। আমি তো গত রাতেই বন্ধি হওয়ার সন্ধি করেছি। স্ত্রীলোক পুরুষকে ভুলাইয়া নিজের শক্তিতে ভালোবাসা আদায় করিয়া লইতে চায় , স্বামী যদি ভালোমানুষ হইয়া সে অবসরটুকু না দেয় তবে স্বামীর অদৃষ্ট মন্দ এবং স্ত্রীরও ততোধিক। সে আমাকে সতর্ক করে বলছে যেনে রাখুন চট্টগ্রামের মেয়েরা কিন্তু স্বামীকে শাসনকরে মাইর দিয়ে। আপনাকে যদি ঠিক শাসন করার কথা ভাবি তাহলে চোখ হাত পা বেধে চট্টগ্রাম বা পার্ত্যঞ্চলের পাহারে রেখে আসবো। হিহিহি সত্যিকারের স্ত্রীরা হয়ত এমন করেই শাসন করে। তাই ভয় পাইনি। আসলে যাহার যা প্রবৃত্তি এবং ক্ষমতা সেটার চর্চা না করিলে সে সুখী হয় না। শিঙে শান দিবার জন্য হরিণ শক্ত গাছের গুঁড়ি খোঁজে, কলা গাছে তাহার শিং ঘষিবার সুখ হয় না। যে স্বামী আপনি বশ হইয়া থাকে তাহার স্ত্রী-বেচারা একেবারেই বেকার। আমার স্ত্রীকে আমি বেকার রাখবো কেন? সে আমাকে পাহাড়ে নিয়ে যাক। কজনার স্ত্রী স্বামীকে পাহাড়ে নিয়ে যায়? মরুভূমির বালি ফুটফুটে সাদা বলিয়াই কি তাহাতে বীজ বুনিয়া কোন সুখ আছে! ফসল ফিরিয়া পাইলে কালো জমিতেও বীজ বোনা যায়? সে জন্যই এই ষ্টাইলে সতর্ক করার পরেই আমি তার প্রেমে ডুবে আছি। আমি জানি সাধারনত স্ত্রীজাতি কাঁচা আম, ঝাল লঙ্কা, এবং কড়া স্বামীই ভালোবাসে। যে দুর্ভাগ্য পুরুষ নিজের স্ত্রীর ভালোবাসা হইতে বঞ্চিত সে-যে কুশ্রী অথবা নির্ধন তাহা নয়। সে নিতান্ত নিরীহ। আমার মতো নিরীহ মানুষের প্রেমে রাগ বা অনুরাগের কোনো বালাই নাই। পৃথিবীর মধ্যে এই অতি সামান্য ঘটনাটা প্রেম আবার অসান্য ঘটনাও প্রেম। সে ক্ষেত্রে আমি আলবার্ট আইনস্টাইনের প্রেমকে এখানে বর্ননা করবো।
আইনস্টাইনের দেশত্যাগ ও প্রথম প্রেম:-
আইনস্টাইনের বয়স যখন ১৫ তখন তার বাবা প্রতিনিয়ত ব্যবসায় ক্ষতির শিকার হতে থাকেন। এ সময় তার কোম্পানি মিউনিখ শহরের বিরাট অংশকে বিদ্যুতায়িত করার মত একটি লাভজনক চুক্তি স্থাপনে ব্যর্থ হয়। অগত্যা হেরমান সপরিবারে ইতালির মিলানে পাড়ি জমান। সেখানে এক আত্মীয়ের সাথে কাজ শুরু করেন। মিলানের পর কয়েক মাস তারা পাভিয়া-তে থাকেন। সে সময়েই আইনস্টাইন জীবনের প্রথম বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র লিখেন যার নাম “চৌম্বক ক্ষেত্রে ইথারের অবস্থা সংক্রান্ত অনুসন্ধান” (The Investigation of the State of Aether in Magnetic Fields)। বাবা তাকে মিউনিখের একটি বোর্ডিং হাউজে রেখে গিয়েছিলেন পড়াশোনা শেষ করার জন্য। একা একা তার জীবন দুঃসহ হয়ে উঠে। একে স্কুলের একঘেয়ে পড়াশোনা তার উপর ১৬ বছর বয়স হয়ে যাওয়ায় সামরিক দায়িত্ব পালনের চাপ তাকে হাপিয়ে তোলে। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার মাত্র ৬ মাস পরেই তাই মিউনিখ ছেড়ে পাভিয়াতে তার বাবা-মার কাছে চলে যান। হঠাৎ একদিন দরজায় আলবার্ট উপস্থিত দেখে তারা বেশ বিস্মিত হয়েছিলেন। তার উপর স্কুলের চাপের বিষয়টি বাবা-মা বুঝতে পারেন। ইতালিতে তাকে কোন স্কুলে ভর্তি করাননি তারা। তাই মুক্ত জীবন কাটাতে থাকেন আইনস্টাইন। তার যোগ্যতা খুব একটা আশাব্যঞ্জক বলে কারও মনে হয়নি। ডাক্তারের চিকিৎসাপত্রের অজুহাত দেখিয়ে তিনি স্কুল থেকে চলে এসেছিলেন।
জার্মানির সেই বিখ্যাত ব্যবসায়ি দম্পতি অনেক চেষ্টা করেও সঙ্গে থাকা নিজেদের কিশোরপুত্র আইনস্টানকে ইতালিয়ান ভাষা শেখাতে পারেননি। সুতরাং বাধ্য হয়ে ছেলেকে জার্মানিতে রেখেই অন্য সন্তানদের নিয়ে ইতালিতে ব্যবসার জন্য বসবাস শুরু করলেন বাবা-মা।
সুইজারল্যান্ডের ফেডারেল ইনস্টিটিউট অব জুরিখ অর্থাৎ জুরিখ পলিটেকনিক্যাল কলেজ। বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার জন্য ইউরোপের সেরা কলেজ। কিন্তু সেখানে ভর্তি হতে হলে স্কুলপাস হতে হয়। আইনস্টাইন সেই পাট তখনো চুকিয়ে উঠতে পারেননি। তাই বাধ্য হয়ে ষোলো বছরের আইনস্টাইন ভর্তি হয়েছিল সুইজারল্যান্ডের আরাউ স্কুলে। আর তখনই আইনস্টাইনের সামনে প্রথমবারের মতো খুলে গেল অবাধ প্রেমের দুয়ার।
আরাউ স্কুলে কিশোর আইনস্টাইন ভর্তি তো হলেন, কিন্তু থাকবেন কোথায়? সুইজারল্যান্ডে তো আইনস্টাইনের কেউ নেই! সে ব্যবস্থাও হলো। সেই স্কুলেরই শিক্ষক ইয়োস্ট উইন্টেলারের বাড়িতে বন্দোবস্ত হলো থাকা-খাওয়ার। ইয়োস্টের সংসার কিন্তু ছোট নয়। চার ছেলেমেয়ে ও স্ত্রী পলিন উয়েন্টেলার। এখানেও পলিন! মায়ের সঙ্গে নামের মিল আছে, তাই আলবার্ট আইনস্টাইন তাঁকে মা বলে ডাকা শুরু করলেন। তা ছাড়া মিসেস উইন্টেলার আলবার্টকে ভীষণ স্নেহ করেন। রীতিমতো পুত্রস্নেহে নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিলেন আইনস্টাইনকে।
উইন্টেলার দম্পতির রূপসী কন্যা মেরি উইন্টেলার। ১৮ বছরের তরুণী! বয়সে আইনস্টাইনের দুই বছরের বড়। তাতে কী! প্রেম কবে স্থান-বয়স-পাত্র মেনে চলেছে। চোখধাঁধানো সুন্দরী, সঙ্গে অসাধারণ পিয়ানো বাজানোর হাত। আইনস্টাইন শিগগিরই ঘায়েল হলেন তরুণীর রূপে-গুণে। কিন্তু এক হাতে তো তালি বাজে না। মেরিও আইনস্টাইনকে প্রথম প্রথম স্নেহের দৃষ্টিতেই দেখতে চেয়েছিলেন। বয়সে ছোট বলেই হয়তো। কিন্তু খুব শিগগিরই মনে প্রেমের গুঞ্জরণ শুনে বুঝতে পারেন বসন্ত এসে গেছে।
আইনস্টাইন মেধাবী, বেহালা বাজাতে জানেন বেশ ভালো। পিয়ানো আর বেহালার ঐকতান কেন নয়? দুজন খুব কাছাকাছি এসে পড়লেন। স্নেহ, বন্ধুত্ব, ভালো লাগা, অবশেষে রূপ নিল ভালোবাসায়।
ভালোবাসার মানুষটার কথা সবাইকে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে। বন্ধু, আপনজন, সবাইকে। আইনস্টাইনের ভাবখানাও তেমন, মেরিকে ভালো লাগার কথা জানিয়ে চিঠি লিখলেন মাকে। তবে সেটা ঠিক ভালোবাসার কথা ছিল কি না নিশ্চিত করে বলার উপায় এখন নেই, তবে মেরির সেবা–যত্নের কথা লিখেছিলেন, সেটা নিশ্চিত। মা কি অবুঝ! ছেলের চিঠিতে মেরির প্রতি তাঁর মুগ্ধতার কথা ছিল, হয়তো গোপন ভালোবাসার ইঙ্গিতটা তিনি ধরে ফেলেছিলেন। পলিন আইনস্টাইন ধন্যবাদ দিয়ে চিঠি লিখেছিলেন মেরিকে। মেরির মনেও বসন্ত, ভালোবাসার মানুষটার মায়ের কাছ থেকে এমন চিঠি যে দুষ্প্রাপ্য! তখন আর তাঁকে পায় কে! উদ্দাম ভালোবাসার জোয়ারে ভেসে যায় দুটি প্রেমিক অন্তর।
তখনকার এক গ্রীষ্মে ছুটি কাটাতে ইতালিতে যান আইনস্টাইন। প্রতিদিন ভালোবাসায় টইটম্বুর ভাষায় চিঠি লেখেন মেরিকে। আইনস্টাইন পরিবারও নিশ্চিতভাবে জেনে গেছে আলবার্ট আর মেরির মন দেওয়া-নেওয়ার কথা। খুশিমনেই মেনে নিয়েছিল সে সম্পর্ক। মেরির পরিবার থেকেও আপত্তি ছিল না। সুতরাং এমন একটি সম্পর্ক পরিণতি না পাওয়ার কোনো কারণই ছিল না।
পরের বছর আরাউ স্কুলের সার্টিফিকেট অর্জন করেন আইনস্টাইন। এবার আর ফেডারেল ইনস্টিটিউট অব জুরিখের ভর্তি হতে বেগ পেতে হলো না তাঁকে। সুতরাং বাজল বিদায়ের রাগিণী। আইনস্টাইন পাড়ি দিলেন জুরিখে।
ফেডারেল ইনস্টিটিউট অব জুরিখে ভর্তি হলেন আলবার্ট আইনস্টাইন। সেখানে অনেক বন্ধু ছিল তার। কিন্তু আইনস্টাইন চুপচাপ মানুষ। বন্ধুদের সঙ্গ তাঁর ভালো লাগে না। তা ছাড়া তিনি মেধার চর্চা করেন। গণিত-ফিজিকস নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা দিতে পারলেই তাঁর ভালো লাগত। অন্য বন্ধুদের মতো চটুল-স্থূল আড্ডা তাঁর পছন্দ নয়। তাই বলে যে সব বন্ধুই এক রকম, তা তো হতেই পারে না। কেউ না কেউ তো থাকবেই। তেমনই এক বন্ধু মার্সেল গ্রসম্যান, যাঁর অবদান আইনস্টাইনের জীবনে ভোলার নয়। আরেকজন মিলেভা মেরিক। রূপসী নন, হাঁটেন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। সেই মিলেভাকেই ভালো লেগে গেল আইনস্টাইনের। সুন্দরী না হোক, ভীষণ মেধাবী আর চুপচাপ। তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হলেন আইনস্টাইন। ভুলতে বসলেন প্রথম প্রেমিকা মেরিকে। চোখের আড়াল হলে মনের আড়াল হওয়ার প্রবাদটা তো আর মিথ্যে নয়। অবশ্য মিলেভার কথা প্রথমেই জানাননি মেরিকে। তবে নিয়মিত চিঠি লেখা বন্ধ হয়েছে, মেরির চিঠির জবাবও আসে না। কু ডাকে মেরির মনে। কিন্তু আইনস্টাইন খোলাসা করে কিছু জানান না। অথচ আরাউ স্কুল ছেড়ে আসার সময় মেরিকে কত স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন আইনস্টাইন। কীভাবে ভবিষ্যৎ গড়বেন, তাঁদের সোনার সংসার হবে, সেসব স্বপ্ন এখন ধূসর অতীত। নিরুপায় মেরি চিঠি লেখন আইনস্টাইনের মাকে। তিনি জানান, তাঁর ছেলের নাকি চিঠি লেখায় অলসতা আছে! সত্যিটা হলো, আইনস্টাইন মিলেভের প্রেমে হাবুডুবু খেতে খেতে ভুলে গেছে মেরির কাছে চিঠি লেখার কথা। শেষমেশ সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেন আলবার্ট—মেরিকে আর দোলাচলে রাখবেন না। কিন্তু সরাসরি মেরিকে জানানোর মতো সাহসও তাঁর ছিল না। তাই মেরির মাকে জানালেন, মেরির সঙ্গে সম্পর্ক রাখা আর সম্ভব নয় তাঁর পক্ষে।
এরপরই যবনিকা পড়ে আলবার্ট আইনস্টাইনের প্রথম ভালোবাসার।
সুন্দরী সাহিত্যিক ও লেখক ভিক্টোরিয়ার সাথে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রেম:-
আমি চিনি গো চিনি তোমারে, ওগো বিদেশিনী” – এ গান লেখার ত্রিশ বছর পরে দক্ষিণ আমেরিকার দেশ আর্জেন্টিনায় রবীন্দ্রনাথ খুঁজে পান তার সেই চেনা, শারদপ্রাতে কিংবা কোনো মায়াময়ী মাধবী রাতে দেখা বিদেশিনীকে, নাম তার ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো। ভিক্টোরিয়া শব্দটিকে বাংলায় অনুবাদ করে রবীন্দ্রনাথ আমাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন ‘বিজয়া’ নামে। বিজয়া বা ভিক্টোরিয়া- যা-ই বলুন না কেন, রবীন্দ্রনাথের সাথে ছিল তার এক গভীর প্লেটোনিক প্রেমের সম্পর্ক। কিন্তু প্রেমিক রবীন্দ্রনাথের বহু প্রেমের গল্প ছাপিয়ে কেন বিজয়া এত জনপ্রিয়? সাত সমুদ্দুর তের নদীর ওপারের বিদেশিনীর সাথে কী করে রহস্যময় প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল রবীন্দ্রনাথের?
ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো একজন আর্জেন্টাইন নারীবাদী লেখিকা, একজন পুরোদস্তুর সাহিত্যিক। ‘সুর’ নামের একটি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন তিনি। রবীন্দ্রনাথের সাথে তার পরিচয় হয় সাহিত্যের হাত ধরেই। তবে ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথকে চেনার আগে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যের সাথে পরিচয় ঘটে ভিক্টোরিয়ার। রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরষ্কার পাওয়ার পর পৃথিবীর নানা ভাষায় অনূদিত হতে থাকে ‘গীতাঞ্জলী’। ভিক্টোরিয়ার হাতে এসে পড়ে গীতাঞ্জলীর ইংরেজি, স্প্যানিশ ও ফরাসি অনুবাদ। এর মধ্যে আঁদ্রে জিদের ফরাসি ভাষায় করা গীতাঞ্জলীর অনুবাদ ছিল তার প্রিয়। গীতাঞ্জলী পড়ে রবীন্দ্রনাথের একজন ভক্ত হয়ে ওঠেন তিনি। রবীন্দ্রনাথের লেখা তাকে এতটাই ছুঁয়ে গিয়েছিল যে, তিনি সেসময়ে ‘রবীন্দ্রনাথ পড়ার আনন্দ’ নামে একটি লেখাও লিখে ফেলেন।
১৯২৪ সালে পেরুর স্বাধীনতা সংগ্রামের শতবর্ষপূর্তির অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পেরুর উদ্দেশ্যে সমুদ্রযাত্রা শুরু করেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু মাঝপথে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি, ফলে বাধ্য হয়ে তাকে আর্জেন্টিনায় অবস্থানের সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তখন কে জানতো যে এই অসুস্থতা, এই যাত্রাবিরতিই রবীন্দ্রনাথকে খুঁজে দেবে তার আরাধ্য বিদেশিনীকে। আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েন্স আয়ার্সের হোটেল প্লাসাতে সহযাত্রী ও সেক্রেটারি লেনার্ড এলমহার্স্টের সাথে অবস্থান করেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের লেখার ভক্ত ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো কোনোভাবেই এ সুযোগ হাতছাড়া করে চাননি। ১৯২৪ সালের নভেম্বরের শুরুতে এক দিন রবীন্দ্রনাথের সাথে দেখা করা জন্য হোটেল প্লাসাতে চলে আসেন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো৷ ভিক্টোরিয়ার সাথে কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলার পর এলমহার্স্ট তাকে রবীন্দ্রনাথের সাথে দেখা করার সুযোগ করে দেন। আদরের উপবাস বইয়ে রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষায়, চৌত্রিশ বছর বয়স্ক ভিক্টোরিয়া তেষট্টি বছরের রবীন্দ্রনাথকে দেখে মুগ্ধতা নিয়ে লিখেছিলেন,
“প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তিনি এলেন; নীরব, সুদূর, তুলনাহীন বিনীত। ঘরে এসে দাঁড়ালেন, আবার এও সত্যি যে ঘরে যেন তিনি নেই। … তেষট্টি বছর, প্রায় আমার বাবার বয়সী, অথচ কপালে একটি রেখাও নেই, যেন কোন দায়িত্বভারই নষ্ট করতে পারে না তাঁর সোনালী শরীরের স্নিগ্ধতা। সুগোল সমর্থ গ্রীবা পর্যন্ত নেমে এসেছে উছলে-ওঠা ঢেউতোলা সাদা চুলের রাশি। শ্মশ্রুমণ্ডলে মুখের নিচের দিকটা আড়াল, আর তারই ফলে উপরের অংশ হয়ে উঠেছে আরো দীপ্যমান। মসৃণ ত্বকের অন্তরালে তার সমগ্র মুখায়ববের গড়ন এক অবিশ্বাস্য সৌন্দর্য রচনা করেছে, তেমনি সুন্দর তাঁর কালো চোখ, নিখুঁত টানা ভারী পল্লব। শুভ্র কেশদাম আর স্নিগ্ধ শ্মশ্রু, এর বৈপরীত্যে জ্বলে উঠছে তাঁর চোখের সজীবতা।”
অসুস্থ রবীন্দ্রনাথকে হোটেল থেকে নিয়ে গেলেন তার এক আত্মীয়ের বাসা ‘মিলারিওতে’। বাড়ির উত্তর দিক দিয়ে বয়ে চলেছে প্লাতা নদী। প্লাতা নদীর ধারের সে বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ কাটিয়েছিলেন প্রায় দুই মাস। রবীন্দ্রনাথ যেদিন মিলারিওতে পৌঁছান, সেদিনই তিনি ‘বিদেশী ফুল’ কবিতাটি লিখেন –
হে বিদেশী ফুল, যবে আমি পুছিলাম—
‘কী তোমার নাম’,
হাসিয়া দুলালে মাথা, বুঝিলাম তবে
নামেতে কী হবে।
আর কিছু নয়,
হাসিতে তোমার পরিচয়।
হে বিদেশী ফুল, যবে তোমারে বুকের কাছে ধরে
শুধালেম ‘বলো বলো মোরে
কোথা তুমি থাকো
হাসিয়া দুলালে মাথা, কহিলে ‘জানি না, জানি নাকো’।
বুঝিলাম তবে
শুনিয়া কী হবে
থাকো কোন দেশে
যে তোমারে বোঝে ভালোবেসে
তাহার হৃদয়ে তব ঠাঁই,
আর কোথা নাই।
সেই বছরের ১২ নভেম্বরে ‘বিদেশী ফুল’ লেখার পরে, কবি ১৫ নভেম্বরে ‘অন্তর্হিতা’, ১৭ তারিখে ‘আশঙ্কা’ আর ২১ তারিখে ‘শেষ বসন্ত’ লিখলেন। এসব কবিতায় প্রেমের প্রকাশ এতটাই তীব্র ছিল যে রবীন্দ্রনাথ এলমহার্স্টকে কবিতাগুলো দেশে তার পুত্র ও পুত্রবধূদের কাছে পাঠাতে নিষেধ করেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রথমে সাত দিন থাকার কথা ছিল আর্জেন্টিনায়। তারপর সেটা বাড়তে বাড়তে এসে দাঁড়ায় বায়ান্ন দিনে। সান ইসিদ্রোর সেই বাড়ি মিলারিওর বারান্দায় বসে বসে রবীন্দ্রনাথ এবং ভিক্টোরিয়া একসাথে নদী দেখতেন। কখনো বা বাড়ি সংলগ্ন তিপা গাছের নিচে বসে অবিশ্রান্ত আড্ডা দিতেন। রবীন্দ্রনাথ বাংলা কবিতা আবৃত্তি করে শোনাতেন বিজয়াকে, বিজয়াও শোনাতেন শার্ল বোদলেয়ারের কবিতা। সে সময়টাকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উপভোগ করেছেন প্রাণভরে। সুদূর সান ইসিদ্রোর সেই বাড়ির স্মৃতি রোমন্থন করেছেন শান্তিনিকেতনে বসেও।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থটি উৎসর্গ করেছিলেন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোকে । তিনি কেবল দুটো শব্দ লিখেছিলেন- ‘বিজয়ার করকমলে’। এই বিজয়া যে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোই তা বলা বাহুল্য! তিনি যে তার একটি বই ভিক্টোরিয়াকে উৎসর্গ করেছেন সেটি আর্জেন্টিনায় চিঠি লিখেও জানিয়েছিলেন। আক্ষেপ করে বলেছিলেন, “বইখানা তোমায় উৎসর্গ করা, যদিও এর ভিতরে কী রয়েছে তা তুমি জানতে পারবে না।” ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো কিন্তু ১৯২৫ সালের ২৮ ডিসেম্বরের চিঠিতে লিখেছিলেন, “বইটাতে কী আছে তা জানার জন্য আমি পাগল হয়ে আছি।” প্রেমের প্রকাশে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোই বা পিছিয়ে থাকবেন কেন! রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তিনি পুরো একটি বই-ই লিখে ফেললেন । ১৯৬১ সালে প্রকাশিত হয় ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর বই ‘Tagore en las barrancas de San Isidro’, বাংলায় বলা যায় ‘সান ইসিদ্রোর উপত্যকায় ঠাকুর’ বা ‘সান ইসিদ্রোর উপত্যকায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বায়োপিক ‘থিঙ্কিং অব হিম’ সিনেমায় উঠে এসেছে বিজয়ার সাথে তার এই প্রেমের গল্প ।
ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর সাথে রবীন্দ্রনাথের দেখা হয় মাত্র দু’বার। ১৯২৪ সালে আর্জেন্টিনায় দেখা হওয়ার পর আবার দেখা হয় প্যারিসে, ১৯৩০ সালে। সেবার প্যারিসের বিখ্যাত পিগাল গ্যালারিতে রবীন্দ্রনাথের আঁকা ছবিগুলোর প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করে দেন ভিক্টোরিয়া। তাদের লেখা চিঠিগুলোতে দেখা যায়, একজন আরেকজনকে বিভিন্ন দেশে এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ করছেন। রবীন্দ্রনাথ ভিক্টোরিয়াকে বারবার শান্তিনিকেতনে আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। যদিও আর্জেন্টিনা ও প্যারিস ছাড়া আর কোথাও দেখা হয়নি দুজনের। দেখা না হলেও যোগাযোগ কিন্তু বন্ধ ছিল না। প্রায় নিয়মিতই একজন আরেকজনকে চিঠি লিখতেন, টেলিগ্রামে বার্তা আদান-প্রদান হতো।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর একেবারে শেষ চিঠিতে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোকে লিখেছিলেন-
“এতোদিন পরে তোমার আমাকে মনে পড়ল – কী যে ভালো লাগছে! পৃথিবীর সব রঙ ফিকে হয়ে আসছে যখন, বিমর্ষ মন কেবল তাদের নৈকট্যই কামনা করে যাদের স্মৃতি সুখময় দিনগুলোর সাথে জড়িয়ে আছে। যতো দিন যায়, সেই স্মৃতিগুলো যেন গাঢ় হতে থাকে।”
এভাবেই তিনি ভিক্টোরিয়াকে তার সেসময়ের অনুভূতির কথা জানিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ যখন অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন, সেসময়েও তার পরিবারের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ করেছেন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো, খোঁজখবর নিয়েছেন রবীন্দ্রনাথের। রবীন্দ্রনাথের ঠাকুরের মৃত্যুসংবাদ ভিক্টোরিয়া পান তাঁর গাড়িতে বসে, রেডিওর সংবাদে। নিজ স্মৃতিকথায় ভিক্টোরিয়া লিখেছিলেন-
“রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মারা গেছেন, তাঁর ভারতবর্ষে। খবর পেলাম পথে, রেডিও থেকে, বুয়েন্স আয়ার্স আর মার দেল প্লাতার মাঝামাঝি জায়গায়। নির্জন রাজপথে ছুটে চলেছে গাড়িটা। চতুর্দিকে বিস্তীর্ণ সমতলভূমিকে ঢেকে আছে শীতের ধূসর আকাশ…।”
মৃত্যুর চার মাস আগে ভিক্টোরিয়াকে ভেবে লেখা রবীন্দ্রনাথের কবিতাটি তার পুত্র রথীন্দ্রনাথ পৌঁছে দিয়েছিলেন গন্তব্যে। যে কবিতাটি ছিল অনেকটা এরকম-
“বিদেশের ভালোবাসা দিয়ে
যে প্রেয়সী পেতেছে আসন
চিরদিন রাখিবে বাঁধিয়া
কানে কানে তাহারি ভাষণ।
ভাষা যার জানা ছিল নাকো,
আঁখি যার কয়েছিল কথা,
জাগায়ে রাখিবে চিরদিন
সকরুণ তাহারি বারতা।”
কী বলা যায় এ প্রেমকে? নিষ্কাম প্লেটোনিক প্রেম? যা-ই বলা হোক না কেন, দূরত্ব আর বয়সের বাঁধা ছাপিয়ে এ প্রেম ছিল বাধাহীন, ছিল স্মৃতিময়, আর ছিল পৃথিবীর এক ঐতিহাসিক সম্পর্কের সাক্ষী।
আমার সেই ভালোলাগা কবির কবিতা দিয়েই শেষ করছি।
ও আমার মন যখন জাগলি না রে
তোর মনের মানুষ এল দ্বারে।
তার চলে যাবার শব্দ শুনে
ভাঙল রে ঘুম–
ও তোর ভাঙল রে ঘুম অন্ধকারে।
মাটির ‘পরে আঁচল পাতি’
একলা কাটে নিশীথ রাতি,
তার বাঁশি বাজে আঁধার-মাঝে
দেখি না যে চক্ষে তারে।
লেখক: শামীম আহমেদ
রাজনীতিক বিশ্লেষক ও গবেষক
পিবিএ/এসডি