শত চেষ্টা করেও রাখতে পারেনি স্থানীয়দের দেয়া শহর রক্ষা বাঁধ!

আবীর আকাশ,লক্ষ্মীপুর: মেঘনার ভাঙ্গন রোধে সরকারী বাধ নির্মানের ধীরগতি দেখে লক্ষ্মীপুর কমলনগরের ঐতিহ্যবাহি নাছিরগঞ্জ বাজার রক্ষায় জঙ্গলা বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ নেয় স্থানীয় একদল যুবক। প্রায় ৮ লক্ষ টাকা ব্যয়ে গাছের খুঁটি, কাঠ ও বাঁশের বেড়া দিয়ে নির্মাণও করা হয় ১ হাজার ফুট জঙ্গলাবাধ। কিন্তু একেরপর এক তীব্র গতিতে জোয়ারের ঢেউয়ে চুর্ণ-বিচুর্ণ এখন জঙ্গলা বাধটি। তাছাড়া বারবার অস্বাভাভিক জোয়ারের পানি ঢুকে প্লাবিত হচ্ছে লক্ষ্মীপুরের চার উপজেলার উপকূলীয় এলাকাগুলো। মেঘনার পাড়ে স্থায়ী বেড়িবাধ না থাকায় পানিবন্দি হয়ে চরম ক্ষতির শিকার হচ্ছে বাসিন্দারা।

আজ বিকেলে উপজেলার চর কালকিনি ইউনিয়নের ঐতিহ্যবাহী নাছিরগঞ্জ বাজার এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, মেঘনার তীব্র জোয়ারের বড় বড় ঢেউ এসে ধাক্কা দিচ্ছে জঙ্গলাবাঁধটিতে। বিভিন্নস্থানে ভেঙ্গে পড়েছে গাছের খুটি, আবার কোথাও চুর্ণ-বিচুর্ণ বাঁশের বেড়া।

জানা যায়, গত ২৬ জুন ঐতিহ্যবাহি নাছিরগঞ্জ বাজার রক্ষায় স্থানীয় যুবকরা স্বেচ্ছাশ্রমে ১ হাজার ফুট এলাকা জঙ্গলাবাধ নির্মাণ করে। পরে যুবকদের জঙ্গলা বাঁধ নির্মাণের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করে লক্ষ্মীপুর-৪ (রামগতি ও কমলনগর) আসনের সংসদ ও বিকল্পধারার মহাসচিব মেজর (অবঃ) আবদুল মান্নান ২ লাখ টাকা সহায়তা করেন। এছাড়াও সাবেক সংসদ সদস্য, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ বিভিন্ন গণ্যমান্য ব্যক্তিরা জঙ্গাবাধ নির্মাণ কাজে সহায়তা করতে এগিয়ে আসেন। তবে মেঘনার ভাঙ্গন ঠেকাতে এ বাধটি যথেষ্ট নয়। তবুও শুধু বাজারটিকে বাঁচাতে স্থানীয় বাসিন্দাদের মনের খোরাক মাত্র।

কিন্তু কয়েকদিন যেতে না যেতেই আবারও মেঘনার বড় বড় ঢেউয় ও স্রোতে বর্তমানে চুর্ণ-বিচুর্ণ স্থানীয় যুবকদের ৮ লক্ষ টাকা ব্যায়ে নির্মিত জঙ্গলাবাধটি। বিভিন্নস্থানে ভেঙ্গে পড়েছে গাছের খুটি, আবার কোথাও বাঁশের বেড়া ভেসে গেছে। এর মধ্যেই জোয়ারের পানি ঢুকে পানিবন্দি হয়ে পড়ছে ওই এলাকার বাসিন্দারা। বর্তমানে ভাঙ্গণের মুখে রয়েছে ঐতিহ্যবাহী নাছিরগঞ্জ বাজার ও চরকালকিনি ইউনিয়ন পরিষদ।

এদিকে অমাবস্যা ও নিম্নচাপের প্রভাবে গত বুধবার (১৯ আগষ্ট) দুপুর থেকে রবিবার (২৩আগস্ট) বিকেল পর্যন্ত জেলার উকূলীয় এলাকার গ্রাম গুলোতে ৪-৫ ফুট উচু দিয়ে পানি প্রবাহিত হতে দেখা যায়। এতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কাঁচা-পাকা বসতঘর, বাজার, রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট, মৎস্য ঘের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। পানিতে ডুবে নষ্ট হচ্ছে ফসলী জমি। মেঘনার উপকূলে বেড়িবাধ না থাকায় এদিকে যেমন মেঘনার ভাঙ্গনে বিলিন হচ্ছে বিস্তৃর্ণ জনপদ, অপর দিকে প্রতিদিন জোয়ারে পানিতে ডুবছে জেলার কমলনগর, রামগতি, রায়পুর ও সদরের দু’লক্ষাধিক মানুষ।

তবে মেঘনার বারবার জোয়ারে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিখার হচ্ছে কমলনগর উপজেলার চল কালকিনি, চর মার্টিন, সাহেবের হাট, চর লরেন্স, চর ফলকন ও পাটোয়ারীর হাট ইউনিয়নের বাসিন্দারা। বৃহস্পতিবারের জোয়ারে এসব ইউনয়নের উপর দিয়ে পানি ৫ ফুট উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে উপজেলার সবচেয় বড় বাজার হাজারহাট এলাকায়ও প্লাবিত হয়েছে।

পানিবন্দি এলাকার বাসিন্দারা জানান, প্রতিদিন মেঘনার জোয়ারে তাদের বাড়িঘর ডুবে যায়। রান্না ঘরের চুলা ডুবে থাকায় রান্নার কাজও বন্ধ রয়েছে। ভিজে গেছে জালালির শুকনো লাকড়ি। তিন দিন ধরে রান্না করা খবার মুখে ঝুটেনি। পানিতে ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে মানবিক বিপর্যয়ে রয়েছে তারা। এমন জোয়ার তারা আর কখনো দেখেনি। বেড়ি বাধ না থাকার কারণে প্রতিদিনই তাদেরে পানিতে থাকতে হচ্ছে। সহায়াত হিসেবে কিছু শুকনো খাবার ও ১০ কেজি চাল দেয়াচ্ছে। কিন্তু রক্ষাবাধ নির্মাণের কোন উদ্যোগ নেই। তারা ত্রাণ চায় না, উপকূলের যানমাল রক্ষায় দ্রুত মেঘনার পাড়ে রক্ষাবাধ নির্মাণের দাবী জানান।

এদিকে চর কালকিনি এলাকার বয়বৃদ্ধ আহসান আলী ও নবীগঞ্জ এলাকার সবুজ মিয়া বলেন, ৬০ বছর জীবনে কখনো দেখিনি এমন জোয়ার। তান্ডবে সব লন্ডভন্ড করে দিয়েছে। ঘরে পানি উঠলেই পরিবার ও হাঁস, মুরগি ও গরু নিয়ে উচু জায়গায় থাকতে হয়। ক্ষেতের ফসলও পানিতে ডুবে নষ্ট হয়ে গেছে। তাদের পাশে দাড়ানো কেউ নেই। নির্বাচনের সময় এমপি এ এলাকার রক্ষার জন্য বেড়িবাধ নির্মান করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু এমপি মান্নানের কোন খবর নেই। তিনি আমাদের কোন কাজেই আসেন না।

ব্যবসায়ীরা জানান, বার বার জোয়ারে বাজারঘাট ডুবে থাকে। পানিতে নষ্ট হয় দোকানের মালামাল। এতে ব্যবসায়ীক ভাবে কোটি কোটি টাকার ক্ষতির সম্মুখিন হতে হচ্ছে তাদের। পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেন তারা।

জঙ্গলাবাধ নির্মাণের সমন্বয়ক ও উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক আহ্বায়ক মো. রাকিব হোসেন সোহেল জানান, নাছিরগঞ্জ বাজারটিকে বাচাঁতেই জঙ্গলাবাধ নির্মানের উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু মেঘনার ঢেউয়ে তা এখন ভেঙ্গে যাচ্ছে। বাজারটিকে মনে হয় আর বাচাঁনো গেলো না। তবে একের পর এক জোয়ারে উপকূলের মানুষদের নিঃশ্ব করে দিচ্ছে। এখন তারা খাবার পর্যন্ত পাচ্ছে না। আমরা স্বেচ্ছায় শুকনো খাবার সরবরাহের চেষ্টা করছি।

কমলনগর উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মো. ওমর ফারুক সাগর জানান, গত ৫ আগষ্ট মেঘনার জোয়ারে সব ভাসিয়ে নিয়েছে। সেই ঘা না শুকাতেই ১৫ দিনের ব্যবধানে গত তিনদিন ধরে জোয়ারের পানি হু হু করে গ্রামগুলোতে ডুকে পড়েছ। এতে ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে বাসিন্দারা। তার নিজের বাড়িও পানি বন্দি হয়ে পড়েছে। বেড়ি বাধ না থাকায় এমনটি সৃষ্টি হচ্ছে। তাই দ্রুত বেড়ি বাধ নির্মাণ জরুরি বলে জানান তিনি।

এদিকে মেঘনার জোয়ারে প্লাবিত চার উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তাগন জানান, জোয়ারের পানিতে ক্ষতিগ্রস্থদের সহায়তার জন্য জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে লিখিত ভাবে জানানো হয়েছে। তবে ওইসব এলাকায় শুকনো খাবার বিতরণ করা হচ্ছে।

লক্ষ্মীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকোশলী ফারুক আহমেদ জানান, কমলনগর উপজেলা ও রামগতি উপজেলার প্রায় ৩১ কিলোমিটার এলাকায় মেঘনার ভাঙ্গন। এসব এলাকায় বাধ না থাকায় জোয়ারের পানি ডুকে প্লাবিত হচ্ছে বিভিন্ন গ্রাম। স্থায়ী রক্ষাবাধ নির্মানের জন্য এরইমধ্যে ৩ হাজার ২শ কোটি টাকার একটি প্রকল্পের জন্য প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। একনেক সভা থেকে অনুমোদন পেলে দ্রুত ব্লক পেলে রক্ষাবাদ নির্মাণ কাজ শুরু হবে। তবে বর্ষায় আপতকালিন ব্যবস্থা হিসেবে মিনি স্পার নির্মাণ করে ভাঙ্গন রোধ করার চেষ্টা চলছে বলে জানান তিনি।

পিবিএ/এসডি

আরও পড়ুন...