পবিত্র শবে মি‘রাজের তাৎপর্য ও শিক্ষা

মসজিদে নববী

মুহাম্মদ মিরাজ শরীফ

মুসলিম জীবনের তিনটি পবিত্র রজনীর মধ্যে লাইলাতুল মিরাজ বা মিরাজের রাত অন্যতম। অন্য দুটো লাইলাতুল কদর এবং লাইলাতুল বরাত। লাইলাতুল কদর ও লাইলাতুল মিরাজ এর কথা পবিত্র কোরআনে উল্লেখ আছে। পবিত্র কোরআন শরীফের সূরা আন-নজমে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে-এবং তিনি (রাসূলুল্লাহ) আকাশের সর্বোচ্চ স্থানে পৌঁছালেন তারপর আল্লাহর নিকটবর্তী হলেন। তিনি ছিলেন দুই ধনুর জ্যা পরিমান অথবা তার চেয়েও বেশী নিকটবর্তী এবং তিনি (আল্লাহ) তাঁর বান্দাহ (রাসূলুল্লাহ) এর কাছে যা প্রকাশ করার ছিল প্রকাশ করলেন, যা তিনি দেখেছিলেন সে সম্পর্কে তাঁর হৃদয় ভূল করেনি, তিনি যা দেখেছিলেন সে সম্পর্কে তোমরা কি অবিশ্বাস করবে?

হিজরতের কিছুদিন পূর্বে মিরাজের এই সুমহান ঘটনাটি ঘটে নবী জীবনে। তারপই মদীনার ভাবী ইসলামী রাষ্ট্রের গুরু দায়িত্ব যাঁর স্কন্ধে, নওমুসলিম জাতি সত্তার যিনি নেতৃত্ব দিবেন তাঁকে তার উপযোগী করে গড়ে তোলার জন্যই মহান শ্রষ্ঠা তাঁকে কাছে টেনে নিয়েছিলেন। একটি সৃজিত জাতির জাগতিক ও পারলৌকিক মঙ্গলের যাবতীয় কর্মকান্ডের তৎসহ মহান আল্লাহ পাকের আনুগত্য ও দাসত্ব করার বাস্তব প্রশিক্ষণ দানই ছিল এ মহা মিলণের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। ইসলামের মৌলিক অনুষ্ঠানাদি নামাজ রোজা প্রভৃতি অবশ্য পালনীয় বিষয় সমূহ নবী মোস্তফাকে এই মিরাজ রজনীতে অবহিত করা হয়। বস্তুত মিরাজই হলো ইসলামী গতিধারার মূল উৎস। তাই মুসলিম জাতি সত্তার জন্য নবী জীবনের মিরাজ এক তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায়।

মিজ্ঞরাজ শব্দের অর্থ সিড়ি বা ধাপ, যার মাধ্যমে উপরে উঠা যায়। বোরাক, বেহেশত, তখত, রফরফ প্রভৃতিতে আরোহণ করে আল্লাহ পাকের সান্নিধ্যে হাযির হওয়াকেই মিজ্ঞরাজ বলে। যে রাতে তা সংঘটিত হয়েছিল তাকে বলা হয় লাইলাতুল মিরাজ বা মিরাজ রজনী। মিরাজের দুটি অংশ রয়েছে । ইসরা ও মিরাজ।

ইসরা ঃ মসজিদে হারাম বা কাবা শরীফ থেকে বাইতুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত ভ্রমণকে ইসরা বলে। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ পাক ইরশাদ করেছেন-পবিত্র তিনি, যিনি তাঁর বান্দাকে মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত ভ্রমণ করিয়েছেন। যার চারিদিকে আমি বরকতময় করেছিলাম যাতে করে আমি তাঁকে আমার কুদরতের নিদর্শন দেখাই। নিশ্চয়ই তিনি সর্বদ্রষ্টা (সূরাঃ বনি ইসরাঈল, আয়াত-১)

মিরাজ ঃ মসজিদে আকসা থেকে সপ্ত আসমান পর্যন্ত ভ্রমণকে মিরাজ বলা হয়। এপ্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক ইরশাদ করেছেন-নিশ্চয় তিনি (মুহাম্মদ) তাকে (জিব্রাইল আঃ কে) আরেকবার দেখেছিলেন সিদরাতুল মুনতাহার নিকটে যার কাছে অবস্থিত বসবাসের জান্নাত। যখন বৃক্ষটি দ্বারা আচ্ছন্ন হওয়ার তদ্বারা আচ্ছন্ন ছিল। তাঁর দৃষ্টি বিভ্রম হয়নি এবং সীমালংঘন করেনি। নিশ্চয় সে তাঁর পালনকর্তার মহান নিদর্শনাবলী অবলোকন করেছেন। (সূরা ঃ নজম, আয়াতঃ১৪-১৭)।

মি‘রাজের সংক্ষিপ্ত বিবরণ : ২৭ শে রজব সোমবার রাতের শেষার্ধে তাঁর দুধ বোন উম্মে হানী বিনতে আবি তালিব এর গৃহে (বর্তমানে কাবা সংলগ্ন হাতিম-এ) বিশ্রাম করছিলেন। এমনি সময় আল্লাহর হুকুমে হযরত জিবরাইল (আঃ) একদল ফিরিশতা ও বোরাক (বিদ্যুৎগতি সম্পন্ন বাহন) নিয়ে এসে মহানবী (সাঃ) এর সীনাচাক করে হাউজে কাওসারের পানি দ্বারা গোসল দিলেন, জান্নাতি পোশাকে প্রিয় নবীজীকে সুসজ্জিত করে আল্লাহর দীদারের কথা জানালে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) প্রিয় মিলণের জন্য স্বতঃস্ফুর্ত চিত্তে বোরাকে আরোহন করেন। বোরাক যোগে মক্কা মোকাররমা থেকে বায়তুল মুকাদ্দাসের দ্বারে উপনীত হন। বায়তুল মুকাদ্দাসে আল্লাহর প্রেরীত পূর্ববতী অসংখ্য নবী-রাসূল ও ফেরেশতা প্রিয় রাসূলকে অভিবাদন ও সম্ভাষণ জানানোর জন্য অপেক্ষমান ছিলেন। লাখ লাখ নবী-রাসূল ও ফেরেশতা ইমামুল আম্বিয়ার পেছনে নামাজ আদায় করে মুক্তাদি হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করলেন।

অতঃপর একটি সিঁড়ি (Acsalator) আনা হল, যাতে নিচ হতে উপরে উঠার ধাপ বানানো ছিল। তিনি সিঁড়ির সাহায্যে সপ্ত আকাশ সমুহ ভ্রমণ করেন। প্রত্যেক আকাশে অবস্থানরত ফেরেশতারা তাঁকে অভ্যার্থনা জানান এবং প্রথম আসমানে হযরত আদম (আঃ), দ্বিতীয় আসমানে হযরত ইয়াহিয়া (আঃ), তৃতীয় আসমানে হযরত ইউসুফ (আঃ), চতুর্থ আসমানে হযরত ইদ্রিস (আঃ), পঞ্চম আসমানে হযরত হারুন (আঃ), ষষ্ঠ আসমানে হযরত মূসা (আঃ) এবং সপ্তম আসমানে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর সাক্ষাৎ পর্ব শেষ করে করে এক ময়দানে পৌঁছেন, যেখানে ভাগ্যলিপি লেখার শব্দ শুনা যাচ্ছিল। তিনি সিদরাতুল মুনতাহায় (কুলবৃক্ষ) পৌঁছেন। এখানেই রাসুলল্লাহ (সাঃ) হযরত জিব্রাঈলকে তার স্বরূপে দেখেন। তাঁর ছয় শত পাখা ছিল। সেখানে একটি দিগন্ত বেষ্ঠিত সবুজ রংয়ের রফরফ (গদিবিশিষ্ট আসন) আসে। তিনি রফরফে আরোহণ করে সত্তর হাজার নূরের পর্দা পার হয়ে আরশে আযীমে উপস্তিত হন। সেখানে উপস্তিত হয়ে আল্লাহ পাককে সেজদা করেন এবং তাঁর তাহিয়্যা পেশ করেন। সেখানেই সরাসরি আল্লাহর সাথে কথা হয়। অতঃপর তিনি বায়তুল মুকাদ্দাসে ফিরে আসেন

শবে মি‘রাজের তাৎপর্য :

ইসলামের ইতিহাসে মিরাজ অত্যান্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এমন এক দুঃসময়ে আল্লাহ তাঁর হাবীব (সাঃ) কে নিকট সান্নিধ্য লাভের সুযোগ দিয়েছিলেন, যখন সকল দিক থেকে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মারাত্বক সংকট ও শোকের সম্মুখীন হয়েছিলেন। পার্থিব জীবনের প্রধান অভিভাবক চাচা আবু তালিবের মৃত্যু, প্রিয়তম সহধর্মিনী উম্মুল মুমেনীন হজরত খাদিজা (রাঃ) এর ইন্তেকাল, তায়েফের হৃদয়বিদারক ঘটনা, মক্কার কাফেরদের অমানবিক আচরন ও সর্বাত্মক নির্যাতনসহ বিভিন্ন কারণে এ সময় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর জীবন বিপন্ন ও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। সংকটময় ঐ দুঃসময়ে আল্লাহ তায়ালার সান্নিধ্য রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর সকল দুঃখ বেদনা ও ক্লান্তির অবসান ঘটায়েছিল। মিরাজের মাধ্যমে তাঁকে জানিয়ে দেয়া হয়েছিল যে, শুভদিন তথা ইসলামের বিজয় সমাগত, যার জন্য তিনি সংগ্রাম করছিলেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সেই সাথে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে পরম পুর্ণতালাভের চুড়ান্ত সবকও দান করেছিলেন। আল্লাহ তাঁকে আলমে বরজাখ, জান্নাত, জাহান্নাম, লওহে কলম, আরশ-কুরসি ও অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যত্যের সবকিছু প্রত্যাক্ষ করান এবং অনন্ত রহস্যের ভান্ডার তাঁর সামনে উন্মুক্ত করে দেন।

ইসলামের দাওয়াত যখন মক্কায় বিরাট বাধার সম্মুখীন হয় তখন মদীনার শক্তিশালী আউস ও খাজরাজ গোত্রের বিপুল সংখক লোক হুজুর (সাঃ) এর সমর্থনে এগিয়ে আসেন। তখন তাঁর মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করে মদীনায় এসে বিক্ষিপ্ত নও মুসলিমদের একস্থানে করে ইসলামের মূলনীতি সমূহের ভিত্তিতে একটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সময় ঘনিয়ে এসেছিল। রাসূল (সাঃ) যাতে তাঁর দায়িত্ব সুচারুরূপে সম্পন্ন করতে পারেন সে জন্য দরকার ছিল আল্লাহর সৃষ্টি জগতের নিগুঢ় রহস্য তাঁ কাছে তুলে ধরা এবং একান্ত কাছে নিয়ে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদান করা। আর তাই মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্রের নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্যতা দানের জন্যই মহান আল্লাহ তাঁকে কাছে টেনে নিয়েছিলেন। মদীনায় ইসলামী প্রতিষ্ঠার মাত্র এক বছর পূর্বে আরববাসীদের সামনে মিরাজের মাধ্যমে ইসলামী রাষ্ট্রের নীল নকশা পেশ করা হয়। মিরাজ থেকে এসে রাসুল (সাঃ) প্রথমে স্বীয় মাতৃভুমীতে এবং পরে সমগ্র বিশ্বের সামনে সেই নীল নকশা তুলে ধরেন।

শবে মিরাজের শিক্ষা:

রাসূল (সাঃ) মিরাজ থেকে আসার পর সুরাঃ বনি ইসরাঈলের মাধ্যমে ১৪ টি দফা জনগনের সামনে পেশ করেন- যথা

*আল্লাহর সাথে কাউকে মাবুদ বানিও না,তাহলে তুমি নিন্দিত ও অসহায় হয়ে পড়বে। তোমার পালনকর্তা আদেশ করেছেন যে, তোমরা অন্য কারও এবাদত করোনা একমাত্র তারই বন্দেগী কর।

*পিতা-মাতার সাথে ভাল ব্যবহার করো। যদি তোমাদের কাছে তাঁদের কোন একজন বা উভয়ে বৃদ্ধ অবস্থায় থাকে তাহলে তাদেরকে উহ পর্যন্ত বলো না এবং তাদেরকে ধমকের সুরে জবাব দিও না বরং তাদের সাথে মর্যাদা সহকারে কথা বলো। আর দয়া ও কোমলতা সহকারে তাদের সামনে বিনত থেকো এবং দোয়া করতে থাক এই বলে-হে আমার প্রতিপালক তাঁদের প্রতি দয়া কর যেমন তাঁরা দয়া মায়া মমতা দিয়ে শৈশবে আমাকে প্রতিপালন করেছিলেন।

*আত্মিয়কে তার অধিকার দাও এবং মিসকিন ও মোসাফিরকেও তাদের অধিকার দাও।

*কিছুতেই অপব্যায় করো না নিশ্চয় অপচয়কারীরা শয়তানের ভাই, শয়তান স্বীয় পালনকর্তার প্রতি অকৃতজ্ঞ।

*তোমরা যদি তাদের (অর্থাৎ অভাবগ্রস্থ আত্মীয়-স্বজন, মিসকিন ও সম্বলহীন পথিক) থেকে পাশ কাটাতে চাও এই কারণে যে, তোমরা খোদার যে রহমত পাওয়ার আকাঙ্খী তা (অর্থাৎ রিয্‌ক) এখন তালাশ করছ তবে তাদেরকে বিনয়সূচক জবাব দাও।

*যিনার ধারে কাছেও যেওনা, ইহা অত্যান্ত খারাপ কাজ; আর অতীব নিকৃষ্ট পথ।

*আর এতিমের মালের কাছেও যেও না, কিন্তু অতি উত্তম পন্থায় (অর্থাৎ কল্যাণ কামনা ছাড়া), যতদিন না সে তার যৌবন লাভ করে।

*নিজের হাত গলায় বেধে রেখ না আবার তাকে একেবারে খোলাও ছেড়ে দিয়ো না, তা হলে তুমি নিন্দিত ও অক্ষম হয়ে যাবে, তোমার রব যার জন্য ইচ্ছা তার রিয্‌ক প্রশস্ত করেন এবং যার জন্য ইচ্ছা তা সীমিত করেন। তিনি তাঁর বান্দাদের সম্পর্কে জানেন এবং তিনি সর্বদ্রষ্টা।

*দারিদ্রের আশংকায় স্বীয় সন্তানদের হত্যা করো না, আমরা তাদেরকেও রিয্‌ক দিব এবং তোমাদেরকেও। নিশ্চয় তাদেরকে হত্যা করা মারাত্বক ভূল (মহাপাপ)।

*প্রাণ হত্যার অপরাধ করো না- যাকে আল্লাহ হারাম করেছেন কিন্তু ন্যায়ভাবে। যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে নিহত হয় আমি তার উত্তরাধিকারীকে (কেসাসের) অধিকার দিয়েছি। অতএব সে যেন হত্যার (ব্যাপারে) বাড়াবাড়ি না করে। নিশ্চয় সে সাহায্য প্রাপ্ত।

*প্রতিশ্রুতি পালন কর। নিশ্চয় প্রতিশ্রুতি পালনের ব্যাপারে অবশ্য তোমাদের জবাব দিহি করতে হবে।

*মেপে দেবার সময় পরিমাপ পাত্র ঠিক রেখ এবং সঠিক দাড়ি পাল্লায় ওজন করবে, পরিনামের দৃষ্টিতে উহা অতি উত্তম।

*যে বিষয়ে তোমার কোন জ্ঞান নাই তার পিছনে দৌড়িও না, নিশ্চয় কান চক্ষু ও অন্তকরণ এদের প্রত্যেকটিই জিজ্ঞাসিত হবে।

*পৃথিবীতে দম্ভভরে পদচারনা করো না, নিশ্চয় তুমি জমিনকে বিদীর্ন করতে পারবে না এবং পর্বতের ন্যায় উচ্চতাও লাভ করতে পারবে না।

এ নৈতিক ধারাগুলো শুধু ধর্মীয় বিশ্বাসই ছিল না, বরঞ্চ যে রাজনৈতিক ব্যবস্থা নবী (সাঃ) মদীনায় গিয়ে কায়েম করেছিলেন এগুলো তার বুনিয়াদী মূলনীতি। পরবর্তীকালে এই দফাগুলো ইসলামী রাষ্ট্রের আইনে পরিনত হয় এবং প্রশাসনিক ক্ষেত্রে উহাকে বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় বিধি ব্যবস্থা মহানবী (সাঃ) নির্ধারণ করেন। ইসলামী হুকুমাত প্রতিষ্ঠার পর মানুষের জীবন ধারা সুন্দর ও শান্তিময় হয়ে উঠে। পবিত্র জীবন ধারার এক সভ্যতার বিস্তৃতি লাভ করে। আসুন মিরাজের মূল শিক্ষার আলোকে ব্যক্তি, সমাজ ও দেশকে গড়ে তুলি। সকল প্রকার অশান্তি, পাশবিকতা ও মানব বিপর্যয় থেকে মুক্তির এটাই একমাত্র পথ। হে রব আপনি আমাদেরকে সঠিক পথে পরিচালিত করুন। আমীন!

পিবিএ/এএইচ

আরও পড়ুন...