নতুন জংগি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফীল হিন্দাল শারক্বীয়া’র শূরা সদস্য ও অর্থ শাখার প্রধান মোশারফ হোসেন ওরফে রাকিবসহ ৩ সদস্য’কে বিদেশী আগ্নেয়াস্ত্র ও বিপুল পরিমাণ অর্থসহ গাজীপুরের রাজেন্দ্রপুর এলাকা থেকে গ্রেফতার করেছে র্যাব।
গত ২০২২ সালের ২৩ আগস্ট কুমিল্লা সদর এলাকা থেকে ৮ জন তরুণের নিখোঁজের ঘটনা ঘটে। উক্ত নিখোঁজের ঘটনায় নিখোঁজ তরুণদের পরিবার কুমিল্লার কোতয়ালি থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন। গণমাধ্যমসমূহে বহুলভাবে আলোচিত নিখোঁজের এই ঘটনা দেশব্যাপী চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। এর প্রেক্ষিতে র্যাব ফোর্সেস নিখোঁজদের উদ্ধারে গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে। নিখোঁজ তরুণদের উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে র্যাব “জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া” নামক একটি নতুন জঙ্গি সংগঠনের সক্রিয় থাকার তথ্য পায় এবং র্যাব জানতে পারে যে, এই সংগঠনের সদস্যরা পার্বত্য চট্টগ্রামের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ‘কেএনএফ’ এর সহায়তায় সশস্ত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছে।
পরবর্তীতে অক্টোবর ২০২২ থেকে অদ্যাবধি দেশের বিভিন্ন স্থানে ও পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ী এলাকায় অভিযান চালিয়ে ইতোমধ্যে নতুন এই জঙ্গি সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাসহ সর্বমোট ৭২ জন এবং পাহাড়ে অবস্থান, প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য কার্যক্রমে জঙ্গিদের সহায়তার জন্য পাহাড়ী বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ‘কেএনএফ’ এর ১৭ জন নেতা ও সদস্যকে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে সক্ষম হয়। উদ্ধার করা হয় বিপুল পরিমান দেশি-বিদেশী অস্ত্র, গোলাবারুদ ও উগ্রবাদী বই। এছাড়াও উদ্ধার করা হয় সংগঠন সস্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ ভিডিও কন্টেন্ট। বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতারকৃতদের নিকট থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায় যে, এই সংগঠনের আমীর আনিসুর রহমান ওরফে মাহমুদ, সংগঠনের উপদেষ্টা শামীম মাহফুজ, অর্থ ও গণমাধ্যম শাখার প্রধান গ্রেফতারকৃত রাকিব। ইতিপূর্বে র্যাব কর্তৃক বিভিন্ন সময়ে সংগঠনের দাওয়াতী কার্যক্রমের প্রধান আব্দুল্লাহ মায়মুন, সামরিক শাখার প্রধান রনবীর ও উপপ্রধান মানিক, অর্থ বিষয়ক প্রধান সমন্বয়ক মুনতাছির, দাওয়াতী ও অন্যতম অর্থসরবরাহকারী হাবিবুল্লাহ, বোমা বিশেষজ্ঞ বাশার ও পার্বত্য অঞ্চলের প্রশিক্ষণ কমান্ডার দিদার হোসেন ওরফে চম্পাইকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে আরও জানা যায়, সংগঠনের আমীর আনিসুর রহমান ওরফে মাহমুদ এর সাথে কেএনএফ এর প্রধান নাথাম বমের সুসম্পর্ক থাকায় কেএনএফ এর সাথে তাদের অর্থের বিনিময়ে চুক্তি হয় এবং কেএনএফ ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র জঙ্গিদের পাহাড়ে আশ্রয়, অস্ত্র ও রশদ সরবরাহ এবং সশস্ত্র প্রশিক্ষণ প্রদান করতো। পরবর্তীতে র্যাবের অব্যাহত অভিযানের ফলে পাহাড়কে নিরাপদ না মনে করায় আমীরের নির্দেশে জঙ্গিরা পাহাড় হতে পলায়ন করে সমতলের বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপনে যায় এবং পুনরায় সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে।
সম্প্রতি র্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা জানতে পারে, এই নতুন জঙ্গি সংগঠনের অন্যতম শুরা সদস্য ও অর্থ শাখার প্রধান মোশারফ হোসেন ওরফে রাকিব সংগঠনের কয়েকজন সদস্যসহ গাজীপুর হয়ে টাঙ্গাইলের মধুপুরের দিকে যাচ্ছে। উক্ত তথ্যের ভিত্তিতে গত রাতে র্যাব-১ ও ৭ এর আভিযানিক দল গাজীপুরের রাজেন্দ্রপুর এলাকায় চেকপোস্ট স্থাপন করে একটি সিএনজি হতে সংগঠনের শুরা সদস্য ও অর্থ শাখার প্রধান ১। মোঃ মোশারফ হোসেন ওরফে রাকিব(৩৪), ২। জাকারিয়া হোসাইন (২৯), ৩। মোঃ আহাদুল ইসলাম মজুমদার ওরফে সিফাত ওরফে মামিদ (২২)-কে গ্রেফতার করা হয় এবং অভিযান চলাকালীন সময় কিছু সদস্য পালিয়ে যায়। উদ্ধার করা হয় ১টি বিদেশি পিস্তল ও নগদ ১২ লক্ষ ৪০ হাজার টাকাসহ বিভিন্ন উগ্রবাদী লিফলেট।
গ্রেফতারকৃত মোশারফ হোসেন ওরফে রাকিব “জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র” অন্যতম শূরা সদস্য ও অর্থ শাখার প্রধান। সে ২০১৫ সালে মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে অবস্থানকালীন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আনসার আল ইসলামের শীর্ষ এক জঙ্গির মাধ্যমে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়। পরবর্তীতে ২০১৬ সালে দেশে ফিরে আনসার আল ইসলামে যোগদান করে এবং পাশাপাশি গার্মেন্টস পণ্যের ব্যবসা শুরু করে। “জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র” প্রতিষ্ঠাকালীন সময় হতে সে সংগঠনের অর্থ সংগ্রহ ও সরবরাহ সংক্রান্ত কার্যক্রম এবং সমতলের যাবতীয় সাংগঠনিক কার্যক্রম তত্ত্বাবধান করত এবং আনসার আল ইসলাম থেকে প্রায় ১৫ লক্ষ টাকা প্রাপ্তিপূর্বক তার নিকট জমা ছিল। সে রাজধানীর মুগদা এলাকায় থাকাকালীন হিজামা সেন্টারের আড়ালে সাংগঠনিক বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিল এবং ঢাকাস্থ সকল শূরা কমিটির মিটিং তার তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হত। ইতোপূর্বে গ্রেফতারকৃত সংগঠনের শুরা সদস্য মায়মুনসহ অন্যান্যরা দেশ ও দেশের বাহির হতে সংগঠনের জন্য অর্থ সংগ্রহ করে তার নিকট জমা রাখত। সে সংগঠনের অর্থায়নে মুন্সিগঞ্জে গবাদি পশুর খামার স্থাপন করে এবং তথাকথিত হিজরতকৃত অধিকাংশ সদস্য তার খামারে বিভিন্ন সময়ে অবস্থান করত এবং তাদের শারীরিক কসরত ও তাত্তিক জ্ঞান প্রদান করা হত বলে জানা যায়। সে সংগঠনের আমীর মাহমুদ এর নির্দেশনায় প্রশিক্ষণ কার্যক্রম, অস্ত্র ও রসদ ক্রয়সহ সংগঠনের অন্যান্য কার্যক্রমের জন্য অর্থ সরবরাহ করত এবং শুকনা খাবারসহ পাহাড়ে টিকে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী ক্রয় করে পার্বত্য প্রশিক্ষণ শিবিরে প্রেরণ করত। এছাড়াও স্বেচ্ছায় নিরুদ্ধেশ সদস্যদের পাহাড়ে প্রেরণের সামগ্রিক কার্যক্রম সে তত্ত্বাবধান করত। সে বিভিন্ন সময় প্রশিক্ষণ পরিচালনা ও সাংগঠনিক কাজে পার্বত্য অঞ্চলে প্রশিক্ষণ শিবিরে গমন করেছে বলে জানা যায়। পাহাড়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান শুরু হলে সংগঠনের আমীর মাহমুদের নির্দেশনায় সে সমতলের বিভিন্ন এলাকায় আত্মগোপনে ছিল। আত্মগোপনে থেকে সে সংগঠনের অন্যান্য আত্মগোপনকৃত সদস্যদের সাথে যোগাযোগ রেখে সংগঠনের সদস্যদের সংগঠিত করার চেষ্টা করতে থাকে। সে ইতোপূর্বে আনসার আল ইসলাম এর সদস্য থাকায় উক্ত সংগঠনের সাথে যোগাযোগ ও সমন্বয় রাখত। সে আনসার আল ইসলামের সাথে সমন্বয়ের মাধ্যমে পুনরায় সংগঠিত হওয়ার পরিকল্পনা করছিল বলে জানা যায়। পাহাড় থেকে পলায়নের সময় তার নিকট সংগঠনের প্রায় ২০ লক্ষাধিক টাকা জমা ছিল যার মধ্য হতে সংগঠনের বিভিন্ন কাজে ইতোমধ্যে প্রায় ৭ লক্ষাধিক টাকা খরচ করেছে বলে জানা যায়। সে গ্রেফতারকৃত ০২ সদস্যকে নিয়ে গাজীপুর হয়ে টাঙ্গাইলের মধুপুরের জঙ্গল এলাকায় অবস্থান করে সংগঠনের আত্মগোপনকৃত অন্যান্য সদস্যদের একত্রিত করে আমীরের নেতৃত্বে পুনরায় সংগঠিত হওয়ার পরিকল্পনা করছিল বলে জানা যায়।
গ্রেফতারকৃত জাকারিয়া ২০০৮ সালে স্থানীয় একটি মাদ্রাসা হতে হিফজ সম্পন্ন করে ফরিদপুরে একটি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করত বলে জানা যায়। সে ২০২১ সালে সংগঠনের শুরা সদস্য ও অর্থ শাখার প্রধান রাকিবের মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ হয়ে সংগঠনে যোগদান করে। তার পরিবারকে মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে যাওয়ার কথা বলে সে বাড়ি থেকে বের হয়। পরবর্তীতে ২০২২ সালের প্রথম দিকে সে রাকিবের মাধ্যমে বান্দরবানের থানচি ও বাকলাইপাড়া হয়ে কেটিসিতে গমন করে। সে পাহাড়ে গমনের পর বিভিন্ন অস্ত্র চালনাসহ বিভিন্ন ধরণের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। পরবর্তীতে, পাহাড়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান শুরু হলে সে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প ত্যাগ করে সমতলে আসে এবং সমতলের বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপন করে। পরবর্তীতে সংগঠনের আমীরের নির্দেশে রাকিবের সাথে সংগঠনের বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপনকৃত সদস্যদের একত্রিত করার জন্য টাঙ্গাইলের মধুপুরের জঙ্গল এলাকায় গমনের সময় গাজীপুরের রাজেন্দ্রপুর এলাকা হতে র্যাব কর্তৃক গ্রেফতার হয়।
গ্রেফতারকৃত আহাদুল কুমিল্লার একটি কলেজে অনার্স ৪র্থ সেমিস্টারে অধ্যয়নরত। সে ২০১৮ সালে তার এক আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে গিয়ে সংগঠনের আমীর মাহমুদ এর সাথে তার পরিচয় হয়। পরবর্তীতে সংগঠনের আমীর মাহমুদ এর মাধ্যমে উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে সংগঠনে যোগদান করে। উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে সে ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে তথাকথিত হিজরতের উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হয়। প্রথমে সে প্রায় দুই মাস আমীর মাহমুদের বাসায় অবস্থান করে এবং আমীরের ব্যক্তিগত সহযোগী ছিল। পরবর্তীতে মাহমুদের মাধ্যমে বান্দরবানের থানচি হয়ে কেটিসিতে গমন করে। পাহাড়ে গমনের পর বিভিন্ন অস্ত্র চালনা, বোমা তৈরিসহ বিভিন্ন সশস্ত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। পরবর্তীতে, পাহাড়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান শুরু হলে সে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প ত্যাগ করে সমতলে আসে এবং সমতলের বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপন করে। পরবর্তীতে সংগঠনের আমীরের নির্দেশে রাকিবের সাথে সংগঠনের বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপনকৃত সদস্যদের একত্রিত করার জন্য টাঙ্গাইলের মধুপুরের জঙ্গল এলাকায় গমনের সময় গাজীপুরের রাজেন্দ্রপুর এলাকা হতে র্যাব কর্তৃক গ্রেফতার হয়।
গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।