শিক্ষকদের ফাঁসাতে আবিরকে হত্যা করে সহপাঠীরা

পিবিএ: চুয়াডাঙ্গায় মাদরাসাছাত্র আবির হুসাইনকে বলাৎকার ও মাথা কেটে হত্যার রহস্য অবশেষে উন্মোচিত হয়েছে। এ ঘটনায় মাদ্রাসার পাঁচ ছাত্রকে গ্রেফতারের পর চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় রহস্যের জট খোলে।

মাদরাসার শিক্ষক তামিম বিন ইউসুফ ওরফে তামিম দাড়ির অত্যাচারে ক্ষুব্ধ হয়ে আবিরকে গলাকেটে হত্যার কথা স্বীকার করেছেন ওই মাদরাসারই ছাত্র আনিসুজ্জামান (১৮)। সে সদর উপজেলার হানুরবাড়াদি গ্রামের শহিদুল ইসলামের ছেলে। একই মামলায় টেইপুরের আব্দুল হাই কাতুর ছেলে ছালিমির হোসেন (১৩), আকুন্দবাড়িয়ার আবুল কালামের ছেলে আবু হানিফ রাতুল (১৩), মামুন হোসেনের ছেলে আব্দুর নুর (১২) এবং বলদিয়া গ্রামের বিল্লাল হোসেনের ছেলে মুনায়েম হোসেন (১৬) চুয়াডাঙ্গা আমলি আদালতের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ সাজেদুর রহমানের নিকট ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে। সোমবার বিকেলে কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে তাদের আদালতে হাজির করা হলে সন্ধ্যায় জবানবন্দি রেকর্ড শেষে জেলহাজতে প্রেরণ করা হয়।

জবানবন্দীতে হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী মাদরাসা ছাত্র আনিসুজ্জামান বলে, তামিম হুজুর আমাদের ওপর খুব অত্যাচার করত। কারণে-অকারণে আমাদের বেত দিয়ে মারত, বিদ্যুৎ চলে গেলে হাতপাখা দিয়ে বাতাস করাত। এরই একপর্যায়ে আমি (আনিস), ছালিমির ও রাতুল মিলে পরিকল্পনা করি, তামিম হুজুরকে মেরে ফেলতে হবে। আবিরকে মারার আগে হুজুরকে মারার পরিকল্পনা ছিল। এরপর আমরা মাদরাসা থেকেই একটি ধারালো ছুরি ও একটি রড নিই। সে মোতাবেক আমরা হুজুরকে মারার জন্য বেশ কয়েকবার চেষ্টা করি, কিন্তু মারতে পারিনি।

সে আরো বলে, এরপর ঠিক করি- তামিম হুজুরকে যখন মারা গেলো না, তখন হুজুর যাকে নিয়ে এসেছে, সেই আবিরকে মারব। আমরা ভেবেছিলাম, আবিরকে মারলে ওর বাবা-মা হুজুরকে সন্দেহ করবে এবং তামিম হুজুর ফেঁসে যাবে। এরপর পরিকল্পনা অনুযায়ী গত ২৩ জুলাই মঙ্গলবার মাদরাসার খড়ির গাদায় একটি ধারালো ছুরি ও রড লুকিয়ে রাখি। ওই রাতে সবাই এশার নামাজে গেলে আমি আবিরকে বলি, চল কাঁঠাল খেতে যেতে হবে। আমার কথায় আবির রাজি হয়। তারপর ওকে নিয়ে আমি কাঠালবাগানে যায়। ওখানে আগে থেকে আব্দুর নুর, রাতুল ও ছালিমির অপেক্ষা করছিল, মুনায়েম লজিং খেতে চলে যায়। আবিরকে সঙ্গে করে আমবাগানে নিয়ে যাওয়ার সময় আব্দুর নুর পিছন থেকে পালিয়ে যায়।

সে আরো বলে, আমবাগানে পৌঁছে আমি আবিরের গলা ধরে মাটিয়ে শুইয়ে ফেলি। ছালিমির ও রাতুল পা ধরে। তারপর আমি আমার ঘাড়ে থাকা তোয়ালে দিয়ে আবিরের গলায় ফাঁস দিয়ে তাকে মেরে ফেলি। তারপর লাশ টেনে আমরা বাগানের একপাশে নিয়ে যায়। ছালিমির আবিরের গলা কেটে শরীর থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করে। এরপর তোয়ালে দিয়ে মাথাটা বেঁধে পাশের পুকুরের মধ্যে ফেলি। পরে ওই পুকুরেই ফেলে দেয়া হয় হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত ছুরিটিও। আর তোয়ালে আমার কাছে ছিল। তোয়ালেটা ছালিমিরের কাছে রেখে হাতমুখ ধুয়ে আমি ছাত্রদের খেতে দিতে চলে যায়। মুনায়েম লজিং খেয়ে ফিরে এসে ছালিমিরের কাছ থেকে তোয়ালেটা নিয়ে মাদরাসার খড়ির গাদার নিচে লুকিয়ে রাখে।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা জেলা গোয়েন্দা পুলিশের ইন্সপেক্টর আব্দুল খালেক জানান, গোপন তথ্যের ভিত্তিতে গত রোববার রাতে কয়রাডাঙ্গা নূরানি হাফিজিয়া মাদরাসার ছাত্র চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার হানুড়বাড়াদি গ্রামের শহিদুল ইসলামের ছেলে আনিসুজ্জামান, টেইপুর গ্রামের আব্দুল হাই কাতুর ছেলে ছালিমির হোসেন, আকুন্দবাড়িয়া গ্রামের আবুল কালামের ছেলে আবু হানিফ রাতুল, মামুন হোসেনের ছেলে আব্দুর নুর ও বলদিয়া গ্রামের বিল্লাল হোসেনের ছেলে মুনায়েম হোসেনকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের পর তারা জেলা গোয়েন্দা পুলিশের কাছে মাদরাসাছাত্র আবির হুসাইনকে হত্যার কথা স্বীকার করে।

প্রসঙ্গত, গত ২৪ জুলাই বুধবার সকালে আলমডাঙ্গা উপজেলার কয়রাডাঙ্গা গ্রামের নূরানি হাফিজিয়া মাদরাসা ও এতিমখানার পার্শ্ববর্তী একটি আমবাগান থেকে মাদরাসাছাত্র আবির হুসাইনের মাথাবিহীন লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। মাথা উদ্ধারে র‌্যাব হেড কোয়াটার্সের বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দুটি কুকুর দিয়ে ঘটনাস্থল ও তার আশপাশের এলাকায় সুইপিং করানো হয়। ডগ স্কোয়াডের সূত্র ধরেই ধারণা করা হয়, ঘটনাস্থলের ৩৫-৪০ গজ দূরে থাকা বিশালাকার ওই পুকুরটিতে কাটা মাথাটি ছুড়ে ফেলা হতে পারে। এরপর ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ডুবুরি দলের সদস্যরা পরদিন বৃহস্পতিবার সকাল ১০টার দিকে পুকুরটির উত্তর-পূর্ব কোনায় পানিতে ডুবন্ত অবস্থায় মাথাটি খুঁজে পান।

উদ্ধার হওয়া মাথাটি কিনারে তোলা হলে স্থানীয় ব্যক্তি ও মাদরাসার সভাপতি হাজি ইয়ামিন আলী বিশ্বাস এটি মাদরাসাছাত্র আবিরের মাথা বলে শনাক্ত করেন। এ ঘটনায় নিহত আবির হুসাইনের মা গোলাপী বাদী হয়ে আলমডাঙ্গা থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় তিনি অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করেন।

এরপর মাদরাসার সুপার হাফেজ মাওলানা মুফতি মোঃ আবু হানিফ ও শিক্ষক তামিম বিন ইউসুফ ওরফে তামিমে দাড়িকে উক্ত মামলায় আসামি হিসেবে আটক দেখিয়ে আদালতে প্রেরণ করে পুলিশ। পুলিশ হত্যাকাণ্ডের এক সপ্তাহের মাথায় সুপার আবু হানিফ ও শিক্ষক তামিমে দাড়িকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে। এরই একপর্যায়ে মাদরাসার অভিযুক্ত পাঁচ ছাত্রকে আটক করা হয় এবং তাদের জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে হত্যাকাণ্ডের মূল রহস্য বেরিয়ে আসে।

পিবিএ/ইকে

আরও পড়ুন...