পিবিএ,ঢাকা: বিশ্বব্যাপী জেঁকে বসা করোনাভাইরাস থেকে শিগগির মানবজাতি মুক্তি পাবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি জানিয়েছেন, বাংলাদেশসহ সারা বিশ্ব এই মহামারির প্রতিষেধক আবিষ্কারের চেষ্টা করছে এবং শিগগির তা আবিষ্কার হবে বলে তিনি আশাবাদী।
রবিবার কোভিড-১৯ মহামারি মোকাবেলায় তার ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিলে দেশের ৫৭টি প্রতিষ্ঠান, সংস্থা এবং ব্যক্তির কাছ থেকে অনুদানের চেক গ্রহণ অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে অনুদানের চেক গ্রহণ করেন। এতে ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হন প্রধানমন্ত্রী।
যারা অনুদান দিয়েছেন সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘পৃথিবীজুড়ে আজকে এমন একটা অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই শুরু হয়েছে যেটা কখনো কেউ ভাবতেই পারে নাই যে এমন একটা যুদ্ধ সবাইকে করতে হবে। মানুষ যুদ্ধ করে শত্রুকে সামনে রেখে। কিন্তু এটা একটা অদৃশ্য শক্তি, একটা ভাইরাস। এর কারণে একদিনে যেমন মানুষ কষ্ট পাচ্ছে। অনেকই মৃতুবরণ করেছে। এটা শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বব্যাপী এই সমস্যাটা রয়েছে। আমার মনে হয়, এই ধরনের ঘটনা আর কখনো সারা পৃথিবীতে ঘটেনি। যুদ্ধ হয়েছে যেখানে সব এলাকার মানুষ কষ্ট পেয়েছে। কিন্তু এটা এমন একটা অদৃশ্য শক্তির সঙ্গে যুদ্ধ, এখানে যতবড় অস্ত্রধারী বা সম্পদশালী হোক না কেন কারো যেন কিছুই করার নাই। সবাই অসহায়। আবার এই অদৃশ্য শক্তির বিরুদ্ধে সকলেই এক হয়ে গেছে। এটাও ঠিক।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আরেকটা বিষয় দেখা যাচ্ছে, প্রকৃতি যেন মুক্তি পেয়েছে যে, আমাদের সভ্যতার বিকাশের ফলে প্রকৃতি যে ধীরে ধীরে ধ্বংসের দিকে যাচ্ছিল, নানাভাষে দূষণ হচ্ছিল সেটা থেকে মুক্তি পেয়েছে। এটা একটা অদ্ভুত পরিবেশ।
এটা এমন একটা সংক্রামণ ব্যাধি মানুষে মানুষে কথা বলা, হাঁচি বা কাশির মাধ্যমেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। যার ওষুধ এখনও বের হয়নি। এটাও একটা অবাক কাণ্ড। যদিও বলা হয় কোভিড-১৯। কোভিড-১৯ যখন পাওয়া গেল তখন থেকে এর রিসার্চ জোরেশোরে করা উচিত ছিল যে এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে। বা মানবজাতিকে রক্ষা করার একটা ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। যদিও এখন গবেষণা চলছে। আমরা আশা করি খুব শিগগির এর প্রতিষেধক বের হবে এবং মানুষ এখান থেকে মুক্তি পাবে।’
‘কৃষিই একমাত্র অবলম্বন’
করোনাভাইরাসে আমাদের অর্থনীতির ওপর বিরাট প্রভাব পড়ছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কারণ দৈনন্দিন জীবনে যারা কাজ করে খেতো তাদের সেই কাজের পথ বন্ধ। লেখাপড়া বন্ধ। অনেক ধরনের আমাদের কর্মসূচি চলতো সেগুলো বন্ধ। জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে আমরা অনেক পদক্ষেপ নিয়েছিলাম যেটা আমরা টেলিভিশন, রেডিওসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে করতে হয়েছে। কিন্তু নানা প্রস্তুতি থাকার পরেও করোনার কারণে আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী করতে পারিনি। মানুষের স্বাস্থ্য ও জীবনের কথা চিন্তা করে আমরা সেই সব কর্মসূচিও স্থগিত করে দিয়েছি। অনেক মানুষ আজকে কর্মহীন হয়ে পড়েছে। তাদের জীবন যাপন করাটাই কষ্টকর। যদিও আমরা তাদের সাধ্যমতো সহযোগিতা করার জন্য চেষ্টা করছি।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এখন যখন প্রায় সমস্ত কাজই বন্ধ। তখন আমাদের কৃষিই হচ্ছে একমাত্র..। সেই কৃষিকে বাঁচিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। আমি আহ্বান জানানোর পরে আমি আমাদের দল ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরাসহ সাধারণ মানুষ কৃষকের জমিতে ধান কাটার জন্য নেমে পড়ে। এর জন্য আমি সকলকে ধন্যবাদ জানাই। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে করোনাভাইরাসের কারণে সারা বিশ্বব্যাপী যে দুর্ভিক্ষের আলামত দেখা যাচ্ছে, যে মহামারির কথা বলা হচ্ছে তাতে যেন আমাদের দেশের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। অন্তত তাদের খাদ্য নিরাপত্তা যাতে নিশ্চিত হয়। আমরা সেই দিকে দৃষ্টি দিয়েছি। এবার ব্যাপক ধান উৎপাদন হয়েছে। আমাদের খাদ্যের কোনো অভাব নাই। আমরা ব্যাপকভাবে ত্রাণ বিতরণও করে যাচ্ছি।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা সরকারি ও দলীয়ভাবে ত্রাণ বিতরণ করছি। অনেকই নিজেরা ব্যক্তিগতভাবে করছে। সাধারণ মানুষ যেভাবে পারছে সাহায্য করছে। এটাই হচ্ছে আমাদের দেশের মানুষের বিরাট আন্তরিকতা। সকলেই সকলের তরে সহযোগিতা করে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে আমি বলেছি এক ইঞ্চি জমিও যাতে অনাবাদি না থাকে। যে পারেন তা ফসল লাগান। যে পারবে উৎপাদন করবে, যাতে আগামীতে খাদ্যের অভাব না হয়। ইতিমধ্যে আমি কৃষিমন্ত্রীকে বলেছি ধানকাটার পরে কোন কোন এলাকায় কী কী ফসল ফলাতে পারবে সেই উৎপাদন যাতে অব্যাহত থাকে। অন্তত খাদ্য নিরাপত্তাটা যাতে নিশ্চিত থাকে। দুর্ভিক্ষ বা মহামারি বাংলাদেশে না আসতে পারে। প্রয়োজনে আমরা যাতে অন্যদের সহযোগিতা করতে পারি।’
‘করোনাকালে শিশুদের কষ্টটা সবচেয়ে বেশি’
টেলিভিশন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মাধ্যমে শিক্ষার পরিবেশ সৃষ্টি করার সংশ্লিষ্টদের ধন্যবাদ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ক্লাসগুলো প্রচার হচ্ছে, তাতে অন্তত শিক্ষার্থীরা লেখাপড়ায় মনোযোগী হচ্ছে। কারণ ঘরে বসে থেকে এই ছোট শিশুরা কী করবে? তাদের কষ্টটা আজকে সবচেয়ে বেশি। অনেকই আজকে ফ্ল্যাটে থাকেন। যারা গ্রামে থাকেন তারাতো খোলামেলা জায়গায় থাকেন। কিন্তু শহরে যারা থাকেন তাদের জন্য খুবই কষ্টকর। আমাদের সংসদ টেলিভিশনের মাধ্যমে ক্লাসগুলো নেয়া হচ্ছে, তা মনোযোগ দিয়ে শোনার জন্য শিক্ষার্থীদের আহ্বান জানাবো। কারণ তাতে অন্তত তারা তাদের সিলেবাস সম্পর্কে জানতে পারবে। আর এরকম অবস্থা থাকবে না, পরিবর্তন আসবেই। আমরা কিছু কিছু উন্মুক্ত করার চেষ্টা করছি। কিছু জীবন জীবিকার ব্যবস্থা যাতে মানুষ করতে পারে, সেই ব্যবস্থা আমরা করছি।’
‘বাধা দূর করে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ’
সরকারপ্রধান বলেন, ‘আমরা জানি মানুষের খুবই কষ্ট। তারপরও আমরা সাধ্যমতো ঘরে ঘরে খাবার পৌঁছে দিতে চেষ্টা করে যাচ্ছি। যেহেতু ধান উঠে গেছে, তাই মানুষের খাবারের কষ্টটা থাকার কথা না। যে বেশি ধান পেয়েছেন, তিনি যাদের কিছু নাই তাদের সাহায্য করবেন। আর আমরা সরকার ও দলের পক্ষ থেকেও ব্যাপকভাবে ত্রাণ বিতরণ করে যাচ্ছি। এবং অন্যান্য সকলেই করে যাচ্ছে। মানুষ মানুষের জন্য। এই কথাটা চিন্তা করে সবাইকে করতে হবে।’
‘আমরা দেশটাকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলাম। এই করোনাভাইরাস আমাদের সেই যাত্রা অনেকটাই ব্যাহত করেছে। কিন্তু তারপরও আমাদের থেমে থাকলে চলবে না। আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। জাতির পিতা দেশকে স্বাধীন করেছেন, তিনি চেয়েছিলেন ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত সোনার বাংলাদেশ গড়তে। আমরা দরিদ্রতা মুক্তির অনেক পদক্ষেপ নিয়েছিলাম। সফলতাও পেয়েছিলাম। আমাদের আশা ছিল খুব শিগগির বাংলাদেশ দারিদ্রমুক্ত হবে। মুজিব বর্ষ থেকে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে (২০২০-২০২১ সাল) দারিদ্র মুক্ত হতে পারবো। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে সেখানে বিরাট ধাক্কা লেগেছে, বাধা এসেছে। তবে আশা করি এই বাধা দূর করে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে, বিশ্বব্যাপী যে সমস্যা সেই সমস্যাটাও দূর হবে।
‘ভীত হয়ে অমানবিক আচরণ নয়’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘তবে আমি মনে করি অসুখ-বিসুখ হলে মানুষকে মনে সাহস রাখতে হবে। কারণ শুধু ডাক্তার বা ওষুধ দিয়ে ভালো হবে না। মনের জোর এবং আত্মবিশ্বাস থেকেও অনেকটা সুস্থ হওয়া যায়। আর সেই সাথে সাথে আমাদের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে যে সকল নির্দেশনা দেয়া হয়েছে তা সকলকে মেনে চলতে হবে। সংক্রামিত যাতে না হয় সেই দিকে দৃষ্টি দিতে হবে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘মানুষ মনে হয় অনেক সময় এত ভীত হয়ে যায়, অনেক সময় সে অমানবিক আচরণ করে। কারণ একজন পরিবারের সদস্য যখন অসুস্থ হয়ে পড়ে, তার কী অসুখ হয়েছে তা না জেনেই। তাকে ধুর ধুর করা বা তাকে ধুরে ঠেলে দেয়া এটা কিন্তু ঠিক না। নিজেকে সুরক্ষিত রাখা, গ্লাভস ও মাস্ক পরে পরিবারে সদস্যদের সহযোগিতা করলে খুব একটা ক্ষতি হবে বলে আমি মনে করি না। কিন্তু সন্তান হয়ে পিতাকে দূর করে দেয়া বা স্ত্রী হয়ে স্বামীকে দূর করে দেয়া কিংবা স্বামী ও সন্তান হয়ে স্ত্রী ও মাকে দূর করে দেয়া কল্যাণকর নয়।’
সরকারপ্রধান বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনী রোগী টানা থেকে শুরু করে লাশ দাফনসহ সবধরনের কাজ করে যাচ্ছে। তাতের সঙ্গে আমাদের ছাত্রলীগের কর্মীদেরও দেখেছি যে অনেক ক্ষেত্রে লাশ দাফন করার কেউ নেই, তখন তারা নিজেরা গিয়ে সেখানে লাশ দাফন করে দিচ্ছে। এই যে মানবিক গুণ হলো মনুষত্ব। এটাই আমাদের বাঙালির সবচেয়ে বড় চরিত্র। এই চরিত্রটা সকলের থাকা দরকার বলে আমি মনে করি। কাজেই এখানে নিজেকে সুরক্ষিত রেখে আন্তরিকতার সাথে কাজ করতে হবে। আর স্বাস্থ্য সম্মতভাবে চলতে হবে।’
পিবিএ/এমআর