আবীর আকাশ: সংবাদ ও সাংবাদিকতা নিয়ে লিখতে হলে যে জ্ঞান ভান্ডার প্রয়োজন তা আমার নিতান্তই গৌণ। যদ্দুর জানি, যে কোন সমাজে সত্য প্রতিষ্ঠার দায়বদ্ধতা নিয়ে প্রতিদিন সকাল থেকেই দায়িত্ব পালন করে যান সাংবাদিকেরা। সংবাদের সাথে সাংবাদিকের, সমাজের, রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা সততার সাথেই দেখিয়ে যেতে হয়। শুধু তাই নয়, একজন সাংবাদিক দায়বদ্ধ থাকেন তার সমাজের কাছে, সমাজে বসবাসকারী মানুষের কাছে, সামাজিক মূল্যবোধের প্রতি, জনসমষ্টির অধিকার ও দায়িত্বের প্রতি তিনি সর্বদাই সত্য সংবাদ লেখনীর মাধ্যমে সকলের নিকট অভিভাবকতুল্য।
সারাদিন খাটাখাটুনি শেষে সন্ধ্যায় সকল দায়িত্ব সমাধান করে যখন তিনি ঘরে ফেরেন, তখন দিনের সকল স্মৃতি-বিস্মৃতির ভান্ডার খুলে বসেন। ডায়েরীতে, কম্পিউটারে ও কাগজে লিখতে থাকেন সব অভিজ্ঞতা। লেখার সব রসদ, নিখাদ, তথ্যনির্ভর এবং বস্তুনিষ্ঠ।
অনুমান, গুজব, শোনাকথা কখনো সংবাদ হয় না বলে একজন সাংবাদিককে কি পরিমান খাটতে হয় তা সাংবাদিক মাত্রই টের পান। এদের মধ্যে মফস্বল হলে তো আর কথাই নেই। সভ্য সমাজ তো আর অনুমান নির্ভর সংবাদ পড়তে চায় না, গ্রহণ করে না। তারা সংবাদের পাশাপাশি এর গুরু তথ্য-প্রমাণসহ জানতে চায়। শুধু স্বীকৃত সত্য নয় এর জবাবদিহিতা রাষ্ট্রের কাছে থাকতে হয়। এটাই করে যেতে হয় সাংবাদিককে সততা, নিষ্ঠা আর দক্ষতা এবং পরিশ্রমের মাধ্যমে। আর এ সত্যকে সংরক্ষণের জন্য প্রায় সর্বত্রই সমাজের সর্বোচ্চ আইনে তার স্বীকৃতিও থাকে।
সুষ্ঠ সমাজ গঠনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মাধ্যম হলো সংবাদপত্র এবং সাংবাদিকতা হলো সুষম গণতান্ত্রিক সমাজ গঠনের কারিগর। যেমন শিক্ষকরা যুগে যুগে চিহ্নিত হচ্ছেন মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে। এই অর্থে সাংবাদিকতা নিছক একটি পেশা মাত্র নয়, যদিও উন্নত পর্যায়ে পেশাদারিত্বই সাংবাদিকদের কার্যক্রমকে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ করে তোলে। প্রকৃত অর্থে বলতে গেলে সাংবাদিকতা হলো এক ধরনের মিশন, একপ্রকার জীবনাদর্শ, ব্যক্তি ও সমষ্টির উন্নত জীবনাচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এক ধরনের মহতী উদ্যোগ। যেসব সমাজে এই লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে সেসব সমাজের সংবাদপত্র যেমন হতে পেরেছে বিশ্বাসযোগ্য তেমনি হয়েছে গ্রহনযোগ্য গণমাধ্যম। এতে সুনীতি ও সুরুচির স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি। অধিকার সংরক্ষণের সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম। তেমনি ভাবে সাংবাদিকরা হয়ে উঠেছেন সত্যিকারের সেলিব্রেটি, লক্ষ জনের শ্রদ্ধেয় কন্ঠ, জাতির বিবেক তুল্য।
বর্তমান সময়ে সংবাদ ও সাংবাদিকতা নিয়ে প্রশ্নের শেষ নেই। দিনকে দিন নিত্যনতুন সংবাদের পাশাপাশি সাংবাদিকতার রূপরেখা যেমন বদলে যাচ্ছে তেমনি সাংবাদিকতার ঘাড়ে চাপানো হচ্ছে আইনের নির্মমতা। কারণ একটাই, এদেশে সংবাদপত্রের সংখ্যা অনেক, রয়েছে অনেক সাংবাদিক। কিন্তু ক’জন সুস্থ সমাজ গঠনের কারিগর? ক’জন গণতান্ত্রিক সমাজ গঠনের লক্ষ্যে কাজ করেন?
কেন এমন প্রশ্ন জাগে সাংবাদিক হয়ে আমার মনে? দেখছি চারদিকে সাংবাদিকদের কেউ কেউ বিক্রি হয়ে যেতে, কঠিন সত্য জেনেও সত্যকে সত্য বলতে পারছেনা, সুবিধা নিয়ে চুপ থেকে যায়। স্কচ টেপ দিয়ে মুখ, আটা দিয়ে চোখ জোড়া বন্ধ করে রাখে। হায়! কত আশা বুকে নিয়ে জাতি চেয়ে আছে, ভরসা করে আছে, নির্ভর করে আছে সাংবাদিকের উপর, রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ এর উপর। আদতে কি তার বাস্তবায়ন হচ্ছে?
মফস্বলে সাংবাদিকতা করতে গিয়ে দেখেছি কত সহজে সংবাদ সাংবাদিকতাকে পুঁজি করে একশ্রেণীর সাংবাদিক নামধারী বাড়ী গাড়ি করছেন, আমরা তাদের হলুদ সাংবাদিক বললেও তারা ভান ধরে থাকেন। এরা আবার বড় হাউজের গণমাধ্যমগুলো কব্জা করে রেখেছেন। সেখানেও অস্বচ্ছতা রয়েছে বলে মফস্বলে যারা বড় গণমাধ্যমগুলোর পরিচয়পত্র বহন করে তারা স্বশিক্ষিত বটে তবে শিক্ষিত নয়।
গণমাধ্যমগুলোর বার্তা ও মফস্বল সম্পাদকদের কেউ কেউ সাময়িক সুবিধা গ্রহণ করে অশিক্ষিতদের প্রতিনিধি বানায়। তারা জেলা-উপজেলায় সত্যকে না খোঁজ করে অর্থের খোঁজ করে বেড়ায়।
এ বিষয়ে মনে পড়ছে রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত সেই লাইন- ‘আমাদের আজন্ম কালের প্রতিনিয়ত অভ্যাস দৃষ্টান্তে আমাদিগকে অন্ধ বাধ্যতার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত করিয়া রাখে। তাহাতে আমরা অধীনস্থ লোকের প্রতি অত্যাচারী, সমকক্ষ লোকের প্রতি ঈর্ষান্বিত এবং উপরিস্থ লোকের নিকট ক্রীতদাস হইতে শিক্ষা গ্রহণ করি।’ এ বাক্যগুলি বর্তমান সময়ে দারুণভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে।
সাংবাদিকরা সত্য উদঘাটনের সময় বিবেচনা করেন -`এই সত্য প্রভুরা গ্রহণ করবেন তো? এই সত্যে প্রভুদের দল বা গ্রুপ খুশি হবেন তো! পাশাপাশি যারা ছড়ি ঘুরিয়ে চলেছেন তারা লাভবান হবেন তো? ফলে প্রভুর প্রতি বিশ্বস্ততার জন্য জাতীয় পর্যায়ের বৃহৎ কোন অর্জনের প্রতি তাদের উদাসীনতা বৃদ্ধি পেতে পেতে একপর্যায়ে স্থবিরতায় আক্রান্ত হয়ে পড়েন আমাদের দেশের কিছু কিছু সাংবাদিক এবং কিছু কিছু সংবাদপত্র। এই জন্য আমরা উদ্যোগ ও হতাশায় নিমজ্জিত হই, যাদের কাছে সবচেয়ে বেশি প্রত্যাশা করি তাদের নিকট থেকে লাভ করি এর চেয়ে বেশি হতাশা।
জীবন জীবিকার জন্য প্রয়োজন একটা পেশা, একটা কর্ম। এটাকে পুঁজি করে অনেক কিছু করার প্রয়োজন তা অনস্বীকার্য। কিন্তু ব্যক্তি হিসেবে আমরা যে বিশাল সমাজ দেহের অংশ তা ভূলে স্বার্থকেন্দ্রিক আচরণে মগ্ন হয়ে পড়ি।
এই সময়ে সংবাদ ও সাংবাদিকতা হয়ে উঠেছে ঘায়েল করা, সুবিধা নেয়ার সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা। বিভিন্ন অফিস,কর্তাব্যক্তি, রাজনৈতিক প্রভু বা গোষ্ঠীর তোষামোদ করে সুবিধা নেয়া, মফস্বল সাংবাদিকতাকে হত্যা করছেন কিছু নামধারী সংবাদপত্র ও তাদের প্রতিনিধিগণ। স্থানীয় পত্রিকার সম্পাদকেরাও ত্রাহিত্রাহি অর্থের মালিক ও বিশাল বিশাল চরের মালিক হয়ে উঠেন। এরা স্থানীয় প্রশাসন ম্যানেজ করে চলে।
কিন্তু সংবাদ, সাংবাদিকতা ও সংবাদপত্রের ভূমিকা, রীতি, নীতি, আদর্শ, দায়িত্ববোধ -এর কোনটাই পরিলক্ষিত হচ্ছে না, মানছে না বা পারছে না এই কারণে- মফস্বলে একটা মটরবাইক থাকলেই, শহর থেকে নামে-বেনামে পত্রিকার কার্ড সংগ্রহ শেষে মাঠ দাপিয়ে বেড়ায়, যত্রতত্র হয়রানী ছাড়া কিছুই করতে পারছে না এসব হলুদ ও ভূয়া সাংবাদিকেরা।
তাদের না আছে শিক্ষা, যোগ্যতা, দক্ষতা, ব্যবহার, মাধুর্যতা, নম্রতা ও ভদ্রতা কোনটাই এদের মধ্যে পাবেন না। সাংবাদিকতারও নেই প্রাথমিক ধারণা, নেই প্রশিক্ষণ, সংবাদ লিখতে -পড়তে জানে না। তবে এদের আছে গেটআপ মেকআপ বেশ ভূষণ আর মানুষকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে যা তা বলার কৌশল।এরা কপি করে সংবাদ পাঠায় গণমাধ্যমে।
মফস্বল সাংবাদিক নিয়োগ ক্ষেত্রে সংবাদপত্র ও তৎসংশ্লিষ্ট কর্তারা এই সত্য যত শিগগির অনুধাবন করবেন ততই মঙ্গল।
দল,মত, গোত্র, ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা গ্রুপকে তোষামোদি করা, তেল মারা বা হাওয়া মারা সাংবাদিকতা পরিহার করতে হবে,চাটুকারিতা বর্জন করে উপঢৌকন ত্যাগ দিয়ে আসল সত্য সুন্দরের চর্চা করলে দুর্নীতি, অনিয়ম, পরিহার করে সংবাদ সাংবাদিকতা ও সংবাদপত্র সমাজ, সমাজের জনগোষ্ঠী তথা বৃহত্তর কল্যাণে ব্যবহৃত হবে এই সময়ের সংবাদ ও সাংবাদিকতার কাছে এটাই প্রত্যাশা করছি।
লেখক: কবি কলামলেখক ও সাংবাদিক
পিবিএ/বিএইচ