সন্তানহীন নারীদের সমাজ এখনো বাঁকা চোখে দেখে কেন?

পিবিএ: আমি একজন সন্তানহীন নারী। তাই বলে কি আমি আমাদের সমাজের ভবিষ্যত নিয়ে কোনো মতামত দেওয়ার জন্য যথেষ্ট যোগ্যতা রাখি না? সন্তানহীন হওয়ার কারণে একজন মায়ের মতো করে আমি সব কিছু বুঝতে সক্ষম নই, এমন ধারণার কারণে কি আমি প্রতিদিনের আবেগগতভাবে জটিল ইস্যুগুলো নিয়ে মাথা ঘামাতে পারবো না?

এ নিয়ে আমি প্রশ্ন করছি কারণ আন্দ্রেয়া লিডসন, যিনি গতকাল পর্যন্তও আমাদের সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তাঁকে অপরের প্রতি আমার সংবেদনশীলতা নিয়ে উদ্বিগ্ন মনে হচ্ছিল। তবে অপর প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী থেরেসা মে তার কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দিয়েছেন।

আন্দ্রেয়া লিডসনের মতে, তিনি আমাদের দেশের ভবিষ্যতের সঙ্গে আমার চেয়েও অনেক বেশি সরাসরিভাবে সংশ্লিষ্ট কারণ তিনি সন্তান জন্ম দিয়েছেন। লিডসামের মন্তব্যের শেকড় রাজনীতির স্বাভাভিক গণ্ডি ছাড়িয়েও অনেক দূর পর্যন্ত প্রোথিত। এ থেকেই সন্তানহীন নারীদের এখনো কীকরে সমাজে বাঁকা চোখে দেখা হয় সেটাই প্রমাণিত হয়।

অথচ একটি বাস্তব সত্য হলো ৪০ বছরের বেশি বয়সী নারীরা এখন তাদের বাবা-মায়েদের প্রজন্মের একই বয়সী নারীদের তুলনায় সংখ্যায় দ্বিগুন। ১৯৬৯ সালে জন্ম নেওয়া নারীদের প্রতি পাঁচজনের একজন এখন সন্তানহীন। তুলনায় ১৯৪২ সালে জন্ম নেওয়া নারীদের প্রতি ৯ জনের মাত্র একজন সন্তানহীন। কিন্তু সমাজে এখনো এই ট্যাবু ও বিশ্বাস প্রচলিত আছে যে, সন্তানহীন নারীরা অস্বাভাবিক প্রকৃতির এবং তারা তাদের শারীরিক নিয়তি পুরণে সক্ষম নয়।

আর এই বিষয়টিই বা কীভাবে ব্যাখ্যা করব, যখন কেউ প্রথম সাক্ষাতেই আমাকে সন্তান আছে কিনা জিজ্ঞেস করে। উত্তরে যখন আমি বিব্রত হয়ে বলি না, নেই। তখন তারা খুবই চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করে, “কিন্তু কেন?” “সমস্যাটা কী?” যখনই আমি লিডসামের ওই মন্তব্যের মতো কোনো মন্তব্য শুনি আমার গা জ্বালা করতে থাকে।

কিন্তু আমার সন্তান না থাকার কারণ সন্তান ধারণে আমার চেষ্টার ঘাটতি নয়। বরং আমি দু দুবার আইভিএফ পদ্ধতি ব্যবহার করে কৃত্রিমভাবে সন্তান ধারণের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হই। এরপর আমি স্বাভাবিকভাবেই গর্ভধারণ করি। কিন্তু তাতেও ব্যর্থ হই এবং আমার গর্ভপাত ঘটে।

তাহলে দেখা যাচ্ছে যেসব নারী সন্তানহীন থাকেন তারা বিভিন্ন কারণেই সন্তানহীন থাকতে পারেন। আর বেশিরভাগ সময়েই কোনো নারী ইচ্ছাকৃতভাবে সন্তানহীন থাকেন না। আমি এখনো সন্তান চাই। তবে আমি ভাগ্যবতী যে আমার জীবনে এখন অসংখ্য সন্তান আছে। আমার একটি আদরের ভাতিজি আছে; আটটি ধর্মসন্তান আছে।

এবং আরো অনেক সন্তান আছে। সূতরাং আমারও সমাজের ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলার মতো বিনিয়োগ রয়েছে। সন্তান জন্ম দিতে চেয়েও ব্যর্থ হলে আপনার মাঝেও অন্যদের জীবন নিয়ে গভীর সহমর্মিতা ও দূরদর্শীতার সৃষ্টি হবে। কিন্তু এই সহমর্মিতাটুকুই আমাদের আধুনিক যুগের রাজনীতিতে নেই।

আমি মনে করি এ এমন এক গুন যা যে কোনো প্রধানমন্ত্রীর জন্যই কাজে লাগবে। কিন্তু সন্তান না থাকার কারণে আমাকে বারবার কটু কথা শুনতে হয়েছে। একবার এক বিয়ে অনুষ্ঠানে একজন মা সন্তান জন্মদানের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে আমাকে বলেন, সন্তান জন্মদান করলে কীভাবে জীবনে জাদুময়ী রুপান্তরের অভিজ্ঞতা হয়।

কারণ তখন আর শুধু নিজের জন্যই বেঁচে থাকা হয় না; অন্য কারো জন্যও বেঁচে থাকতে হয়। যে অভিজ্ঞতা সন্তান জন্মদান না করলে অর্জন করা সম্ভব নয়। তবে আমার এমন কিছু মেধাবী, যোগ্য এবং সফল বন্ধুও রয়েছেন যারা সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও সন্তান জন্ম দেননি।

এদের কেউ কেউ আবার এমনকি কখনোই মাতৃত্বের আকুতিও অনুভব করেন নি। আমি এবং ওই স্বেচ্ছায় সন্তানহীন নারীরা সমাজের জন্য তেমন গুরুত্বপূর্ন নন বা পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গণ্য হওয়ার ক্ষেত্রে এদের মাঝে ঘাটতি আছে বলাটা খুবই অপমানজনক। তবে এও সত্যি যে, সন্তান জন্মদান ও লালন-পালন জীবনের একটি বড় ঘটনা।

তেমনি বিয়ে বিচ্ছেদ, ঘনিষ্ঠ কোনো বন্ধুর মৃত্যু, ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই প্রভৃতিও জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। আমাদের সকলেই জীবনের বিভিন্ন ধরণের ঘটনা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পরিবর্তিত হই। কিন্তু জীবনের অভিজ্ঞতাগুলোর মধ্যে কোনোটিকে ছোট আর কোনোটিকে বড় বলা সম্ভব নয়।

আর সন্তান জন্মদানকারী নারীদের সকলেরই অভিজ্ঞতা এবং দক্ষতা যে সমান তাও ভাবা ঠিক নয়। এমন অনেক মাকেই আমি চিনি যারা অনেক যোগ্যতা সম্পন্ন এবং চিন্তা করতেও সক্ষম। আবার এমন অনেক মাকেও আমি চিনি যারা বাইরে দেখতে খুবই ফিটফাট কিন্তু ভেতরে ফাঁকা।

তেমনি আমি এমন অনেক নিঃসন্তান মাকে দেখেছি যারা খুবই আত্মকেন্দ্রিক। আবার অনেক নিঃসন্তান মা আছেন যারা নিজের প্রয়োজনের চেয়ে অন্যের প্রয়োজনকেই বেশি প্রাধান্য দেন। কিন্তু সন্তানহীন বাবাদের ব্যাপারে সমাজ কেন নিশ্চুপ? তাদের সন্তানহীনতাকে কেন রাষ্ট্রের উচ্চ পদে আসীন হওয়ার ক্ষেত্রে বাধা হিসেবে গণ্য করা হয়না?

এলিজাবেথ ডে, ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ

পিবিএ/ইকে

আরও পড়ুন...