পিবিএ, ঢাকা : ফরিদপুরের মানুষের কাছে ৭ জুন রোববারের রাতটা ছিল একেবারে অন্য রকম। রাত ১১টার পর শহরে খবর ছড়িয়ে পড়ে, বরকত ও তাঁর ভাই রুবেল গ্রেপ্তার হয়েছেন। প্রথমে কেউই বিশ্বাস করতে পারেননি। জেলা প্রশাসন আর থানা-পুলিশ যাঁদের কথায় ওঠবস করে, সেই ক্ষমতাধরেরা কেন গ্রেপ্তার হবেন? শহরজুড়ে আতঙ্ক নতুন কেউ দখল নিতে আসছে না তো!
ফরিদপুরের এক আইনজীবী নিজের চেম্বারে বসে এভাবেই দুই সহোদর গ্রেপ্তারের পর শহরের অবস্থার কথা বলছিলেন। এ ঘটনার পর ১ মাস ২০ দিন পেরিয়ে গেছে। ফরিদপুর এখন শান্ত। তবে ‘বোবা’ হয়ে থাকা মানুষগুলো এখন মুখ খুলতে শুরু করেছেন, বেরিয়ে আসছে দুই ভাইয়ের গা শিউরে ওঠা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের তথ্য। ১৯ জুলাই থেকে এই দুই ভাইকে ঢাকায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ করেছ সিআইডি। ২৪ জুলাই তাঁরা ঢাকা মহানগর ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এখন তাঁরা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে।
দুই ভাইয়ের মধ্যে বড় ভাই সাজ্জাদ হোসেন বরকত (৪৭) ফরিদপুর শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। ছোট ভাই ইমতিয়াজ হাসান ওরফে রুবেল তাঁর সহযোগী। তাঁদের বড় পরিচয়, দুজনই সাবেক মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেনের ঘনিষ্ঠ। এই ঘনিষ্ঠতার সুযোগ নিয়ে তাঁরা চাঁদাবাজি, জমি দখল ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করে দুই হাজার কোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়েছেন। শহরের এমন কোনো মহল্লা নেই, যেখানে তাঁদের জমি নেই।
গত পাঁচ-সাত বছরে দুই ভাই কাদের প্রশ্রয়ে শহর দাপিয়ে বেড়িয়েছেন, তা এখন প্রকাশ্যেই বলছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি নূর মোহাম্মদ সাংবাদিকদের বলেন, ফরিদপুরে আওয়ামী লীগ নেই। প্রকৃত আওয়ামী লীগারদের দাবড়িয়ে বের করে দেওয়া হয়েছে। খন্দকার মোশাররফের প্রশ্রয়ে রুবেল-বরকতেরা সম্পদের পাহাড় গড়েছে। প্রশ্রয় না পেলে এই শহরে রুবেল-বরকতের মতো সন্ত্রাসী ও ভূমিদস্যুদের জন্ম হতো না।
ফরিদপুর সদরের সাবেক সাংসদ এবং বিএনপির সাবেক মন্ত্রী চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ সাংবাদিকদের বলেন, ‘বরকত-রুবেলরা ফরিদপুরের মানুষকে এত দিন জিম্মি করে রেখেছিল। তাদের যে এত ক্ষমতা, তার মূলে মোশাররফ হোসেন। তাঁর ছত্রচ্ছায়ায় থেকে চাঁদাবাজি, জমি দখল ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করে শত শত কোটি টাকার সম্পদ গড়েছে তারা।’
এত সম্পদ কোত্থেকে এল !
যাঁদের এত সম্পদ, তাঁদের জীবনযাপন কেমন? তারও একটি হিসাব দেওয়া যেতে পারে। বড় ভাই বরকতের পছন্দ জিপ ধরনের গাড়ি। তাঁর আছে একটি হ্যারিয়ার, একটি নিশান প্যাট্রল ও বিএমডব্লিউ জিপ। ছোট ভাইয়ের আছে একটি বিএমডব্লিউ কার, একটি মাইক্রোবাস ও একটি সিডান কার। আর আছে নিজেদের ব্যবহারের জন্য একটি রেস্টহাউস। পাঁচ তারকা হোটেলের প্রায় সব সুবিধা সেখানে আছে। ফরিদপুরের লোকেরা নাম দিয়েছেন ‘বরকতের হেরেমখানা’।
প্রশ্ন উঠতে পারে, এত কম সময়ে এত বিপুল সম্পদ হলো কী করে। গ্রেপ্তারের পর ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে ১৬৪ ধারার জবানবন্দিতে বরকত নিজেই তার জবাব দিয়েছেন। বলেছেন, ফরিদপুরে সবকিছুই চলত তাঁদের কথামতো। এলজিইডি, জনস্বাস্থ্য, সড়ক ও জনপদ, শিক্ষা প্রকৌশল, পানি উন্নয়ন বোর্ড, বিআইডব্লিউটিসি, গণপূর্ত, বিআরটিএ, বিদ্যুৎ অফিস, বিএডিসি, পাসপোর্ট অফিস ও শহরের ফুটপাত ছিল তাঁদের নিয়ন্ত্রণে। সব ধরনের উন্নয়নকাজের ১৫ শতাংশ তাঁরা পেতেন।
আর বরকতের ভাই রুবেল গ্রেপ্তারের পর পুলিশকে বলেছেন, এসবের পাশাপাশি তাঁদের বড় আয়ের উৎস ছিল জমি দখল ও চাঁদাবাজি। যে জমি পছন্দ হতো, সেটাই দখল করতেন। এই বেআইনি কাজে ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন নেতার পাশাপাশি জেলা প্রশাসন ও পুলিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সহযোগিতার অভিযোগ রয়েছে।
গ্রেপ্তারের নেপথ্যে
ফরিদপুরের আওয়ামী লীগ নেতারা জানান, বরকত-রুবেলের সবকিছু এত দিন ভালোই চলছিল। গোল বাধল ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রবীণ রাজনীতিবিদ আইনজীবী সুবল চন্দ্র সাহার বাড়িতে হামলার পর।
হামলার ঘটনা নিয়ে সুবল সাহা কারও নাম উল্লেখ না করে থানায় মামলা করেন। মামলার এজাহারে পুরো ঘটনার বিবরণ দিয়ে বলেন, ১৬ মে সন্ধ্যা সাতটার দিকে হঠাৎ ৫০-৬০ জন লোক সুবল চন্দ্র সাহার বাড়ি ঘেরাও করে। তাঁর অপরাধ, আগের দিন সাবেক মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনের বদরপুরের বাসভবন আফসানা মঞ্জিলে শহর আওয়ামী লীগ যে ইফতারের আয়োজন করে, তিনি সেখানে যাননি। হামলাকারীরা না যাওয়ার কারণ জানতে চেয়ে তাঁকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে এবং তাঁর গাড়িচালককে মারধর করে। হামলাকারীরা চলে যাওয়ার পর সুবল চন্দ্র সাহা এ ঘটনা জানাতে মোশাররফ হোসেনের বাসায় যান। মোশাররফ এ সময় বাসাতেই ছিলেন কিন্তু দেখা করেননি, এমনকি তাঁর ফোনও ধরেননি। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে তিনি বাসায় চলে যান। এক ঘণ্টা পর আবার আসেন স্ত্রী ও পুত্রকে সঙ্গে নিয়ে। এবারও মোশাররফ হোসেন দেখা দেননি। মোশাররফ হোসেনের বাড়িতে থাকার সময় সুবল সাহার বাড়িতে দ্বিতীয় দফা হামলা হয়। দুই শতাধিক লোক এক জোট হয়ে তাঁর বাড়ি ভাঙচুর করে ও আগুন ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। হামলাকারীরা তাঁর প্রাণনাশের হুমকি দেয়।
হঠাৎ কেন এই হামলা, জানতে চাইলে সুবল চন্দ্র সাহা বলেন, ‘আমার যা বলার, তা মামলার এজাহারে বলেছি। নতুন করে আর কিছু বলতে চাই না। সাবেক মন্ত্রী মোশাররফ হোসেন আমার বিপদের সময় দেখা পর্যন্ত দেননি, সেটাও আমি মামলায় উল্লেখ করেছি।’
এ ব্যপারে মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘আমাকে নিয়ে তার যা খুশি বলুক, আমার কিছু আসে-যায় না। আমি কার সঙ্গে কথা বলেছি, আর কার সঙ্গে বলিনি, তাতে কোনোভাবেই প্রমাণিত হয় না যে আমি হামলা করেছি।’
এই হামলার খবর একসময় সরকারের উচ্চ মহল জেনে যায়। এরপর নির্দেশ আসে নিরপেক্ষ তদন্তের। আটঘাট বেঁধে মাঠে নামে পুলিশ।
বেরিয়ে আসছে থলের বিড়াল
তদন্তে নেমে পুলিশ জানতে পারে, জেলা সভাপতির বাড়িতে হামলায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন শহর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক মাহফুজুর রহমান ওরফে মামুন। আর হামলার নির্দেশদাতা দুই ভাই বরকত ও রুবেল। জেলা পুলিশ সুপার আলিমুজ্জামান জানালেন, তথ্যপ্রমাণ হাতে নিয়েই অভিযান শুরু করে পুলিশ।
শহরের প্রবেশমুখ বলে পরিচিত রাজবাড়ী রাস্তার মোড় থেকে ৭ জুন রাত ১১টার দিকে দুই ভাই গ্রেপ্তার হন। ফরিদপুর কোতোয়ালি থানার এসআই কবিরুল হক জানান, এ সময় তাঁদের গাড়ি থেকে পাওয়া যায় আমেরিকায় তৈরি দুটি অবৈধ পিস্তল ও গুলি। পরে তাঁদের বাড়ি ও গেস্টহাউসে অভিযান চালায় পুলিশ। সেখান থেকে পাওয়া যায় আরও চারটি অস্ত্র, ব্যবহৃত গুলির খোসা, অবৈধ গুলি, মাদক, টাকা, বিদেশি মুদ্রা ও ১ হাজার ২০০ বস্তা ত্রাণের চাল।
অভিযানের পরিধি আরও বাড়ানো হয়। একে একে গ্রেপ্তার করা হয় কাউন্সিলর ও শহর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহফুজুর রহমান ওরফে মামুন, পৌরসভার বর্ধিত ২৫ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মনিরুজ্জামান, শহর আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক বন্যা মণ্ডল, কোতোয়ালি স্বেচ্ছাসেবক লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হামিদুর রহমান, ১৬ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি নারায়ণ চক্রবর্তীসহ ১৩ জনকে। দুই ভাইসহ তাঁদের বিরুদ্ধে নয়টি মামলা হয়। সিআইডি একটি মামলা করার পর তাঁদের গাড়ি, বাড়ি, হোটেল, রেস্টহাউস থেকে শুরু করে সব স্থাপনা ও যানবাহন জব্দ করে।
১৩ জনের সবাই ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এতে বেরিয়ে আসে ফরিদপুর শহরের রাজনীতির ঘৃণ্য চিত্র। সিআইডির অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক শেখ মো. রেজাউল হায়দার সাংবাদিকদের বলেন, রুবেল-বরকত ঢাকার আদালতে যে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন, তাতে কারা তাঁদের সহায়তা করেছেন, কারা তাঁদের প্রশ্রয় দিয়েছেন এবং কাদের সঙ্গে তাঁরা অপরাধ করেছেন, তার বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া গেছে।
কামালকে ছেড়ে মোশাররফের সঙ্গে
১৯৯৬ ও ২০০১-এর নির্বাচনে ফরিদপুর-৩ আসনের (সদর) আওয়ামী লীগ প্রার্থী হয়ে হেরে যান সাবেক মন্ত্রী মোশাররফ হোসেন। ২০০৮-এর নির্বাচনে বিএনপি জোটের প্রার্থী ছিলেন জামায়াত নেতা আলী আহসান মুজাহিদ। সাবেক মন্ত্রী চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ স্বতন্ত্র নির্বাচন করেন। এতে বিএনপির ভোট ভাগ হয়ে সহজেই জিতে যান মোশাররফ হোসেন। ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে তিনি শ্রমমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন। ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন খন্দকার মোশাররফ। ওই বছরের মার্চে অনুষ্ঠিত সদর উপজেলা চেয়ারম্যান পদে তাঁর ছোট ভাই খন্দকার মোহতেশাম হোসেন বাবরকে পাস করিয়ে আনেন।
জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক কোষাধ্যক্ষ মাহবুবুর রহমান খান জানান, বাবরের হাত ধরে বিএনপি-জামায়াতের লোকজন আওয়ামী লীগে আসতে শুরু করেন। নিজের দল ভারী করার জন্য এসব লোককে টেনে এনে দলের ত্যাগী নেতাদের কোণঠাসা করেন। এই স্রোতে আওয়ামী লীগে ভেসে আসেন বিতর্কিত বরকত-রুবেলরাও। অবশ্য এঁদের দলে টানার ব্যাপারে জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক ত্রাণবিষয়ক সম্পাদক মোকাররম বাবু প্রতিবাদ করেন বলে জানালেন।
মোশাররফ হোসেনের ভাই মোহতেশাম হোসেন ওরফে বাবর বলেছেন, তিনি জেনে-বুঝে বিএনপির কোনো লোককে দলে নেননি। যদি কেউ এসে থাকে, সেটা তাঁর রাজনৈতিক ভুল হতে পারে।
এ বিষয়ে মোশাররফ হোসেনের বক্তব্য, ‘ফরিদপুরে শুধু এই দুজনই বাইরে থেকে এসে আওয়ামী লীগে যোগ দেয়নি। আরও অনেক লোক যোগ দিয়েছিল। তারা যা করবে, তার সব দায় আমার হতে পারে না।’
ফরিদপুরের ব্রাহ্মণকান্দা গ্রামের বিএডিসির স্টোরকিপার আবদুস সালাম মণ্ডলের দুই ছেলের মধ্যে বরকত এসএসসি আর রুবেল এইচএসসি পাস। রুবেল একটি ছোট চাকরি করলেও বরকত ছিলেন বাবু কসাই নামের এক সন্ত্রাসীর ক্যাডার। এলাকায় এঁরা খোকন রাজাকারের ভাগনে হিসেবে পরিচিত। তাঁদের মামা জাহিদুর রহমান ওরফে খোকন একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামি। ফরিদপুরের নগরকান্দায় মামার টিভি শোরুমে কাজ নেন বরকত। পরে হাইওয়েতে বাস থেকে চাঁদা তোলার কাজ পান। ছোট ভাই রুবেল একটি বেসরকারি কোম্পানিতে কম বেতনে চাকরি নেন।
’৯১-এর নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় এলে ফরিদপুর সদরের সাংসদ হন চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ। সে সময় সদর উপজেলা বিএনপির সভাপতি চান খন্দকার ছিলেন বিএনপির সাবেক মন্ত্রী কামাল ইবনে ইউসুফের ঘনিষ্ঠ। আর বরকত ও রুবেল ছিলেন চান খন্দকারের লোক। তাঁরা চান খন্দকারের ফুটফরমাশ খাটতেন। ’৯৪ সালের ১৯ নভেম্বর খুন হন শহর আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক আইনজীবী এ এইচ এম মহিউদ্দিন ওরফে খোকন। এ হত্যা মামলার এক নম্বর আসামি ছিলেন বরকত এবং তিন নম্বর আসামি ছিলেন তাঁর ভাই রুবেল। এ হত্যা মামলা থেকে ওই দুই ভাইকে বাঁচাতে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়াসহ সার্বিক সাহায্য করেন চান খন্দকার। এর আগে ’৯২ সালে তাঁরা কোমরপুরে জাকির হোসেন নামের এক ব্যক্তির বাঁ হাতের কবজি কেটে দেন। তাঁরা ছিলেন সন্ত্রাসী বাবু কসাইয়ের ঘনিষ্ঠ। ২০০৬ সালের দিকে বাবু কসাই ক্রসফায়ারে মারা গেলে দলটি ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। তখন থেকে রুবেল টুকটাক ঠিকাদারি ব্যবসা শুরু করেন।
ধর আর জেলে ভর
২০০৮-এর নির্বাচনে বিএনপির ভরাডুবির কিছুদিন পর চান খন্দকার মারা যান। বরকত-রুবেল আশ্রয় নেন আওয়ামী লীগে। এঁদের সঙ্গে জোট বাঁধেন জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক এ এইচ এম ফুয়াদ। এ ক্ষেত্রে প্রথম বাধা ছিলেন মোশাররফ হোসেনের তৎকালীন এপিএস সত্যজিৎ মুখার্জি ও আওয়ামী লীগ নেতা মোকাররম বাবু। এঁদের দুজনকেই একটার পর একটা মামলা দিয়ে জেলে ঢোকানো হয়।
মোকাররম বাবু বলেন, ২০১৫ সালের ২৩ এপ্রিল ঢাকায় মন্ত্রীর বাসার সামনে থেকে রমনা থানা-পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে। এরপর তাঁর বিরুদ্ধে ধর্ষণ, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অভিযোগে ১১টি মামলা দেওয়া হয়। সেই মামলায় তাঁকে সাড়ে সাত মাস জেলে থাকতে হয়, আর সত্যজিতের বিরুদ্ধে মামলা হয় ২৫টি। তিনি এখনো জেলেই আছেন।
সত্যজিৎ ও মোকাররম বাবু জেলে যাওয়ার পর সবকিছু রুরেল-বরকতের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। বরকত প্রথমে পৌর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক হন, পরে শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হন। এখনো তিনি সে পদেই আছেন।
রাজনীতির এই মারপ্যাঁচ নিয়ে কথা বলেন ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক বিপুল ঘোষ। তিনি বলেন, কিছু পুরোনো এবং বিএনপি থেকে আসা কিছু আওয়ামী লীগ নেতার সাহায্যে বরকত-রুবেলরা দখলবাজি শুরু করেন। কেউ প্রতিবাদ করলে বা বাধা দিলে মারধর করা হতো। একে একে তাঁরা ফরিদপুর শহরের বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠান দখল করেন। প্রথমে দখল করেন ফরিদপুর জেলা বাস মালিক সমিতি। এরপর ডায়াবেটিক সমিতি, ফরিদপুর চেম্বার, জেলা ক্রীড়া সংস্থা, রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, এমনকি ডা. জাহিদ মেমোরিয়াল শিশু হাসপাতালের পরিচালনা কমিটির পদও তাঁরা দখল করেন। থানা-পুলিশের সহযোগিতা নিয়ে দুই ভাই রামরাজত্ব কায়েম করেন। এতে আওয়ামী লীগের অনেক ত্যাগী নেতা শহর ছেড়ে অন্যত্র চলে যান।
শুধু দখল আর দখল
ফরিদপুরের ব্যবসা-বাণিজ্য, ঠিকাদারি কাজ, সরকারি স্থাপনা কীভাবে রাতারাতি দখল করা হয়েছে, তা ফুটে উঠেছে বরকত-রুবেলদের জবানবন্দিতে। ২৮ জুন ফরিদপুরের বিচারিক হাকিম ফারুক হোসাইন তাঁদের এই জবানবন্দি রেকর্ড করেন।
আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বরকত বলেছেন, ২০১২ সাল থেকে তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেন। ২০১৫ সালের দিকে তিনি, তাঁর ভাই রুবেল, মোশাররফ হোসেনের এপিএস যুবলীগ নেতা এ এইচ এম ফুয়াদ, শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি নাজমুল হাসান খন্দকার ওরফে লেবী এবং ফরিদপুর শিল্প ও বণিক সমিতির সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান মিলে গোপন বৈঠক করেন। সেই বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানের সব কাজ তাঁরা ভাগাভাগি করে নেবেন। এর মধ্যে এলজিইডির টেন্ডারের দায়িত্ব আসে তাঁদের ভাগে। তিনি স্বীকার করেন, এলজিইডির সব উন্নয়নকাজে ১৫ শতাংশ কমিশনের বিনিময়ে তাঁরা কাজ পাইয়ে দেন। তাঁদের সম্মতি ছাড়া কেউ কাজ করতে পারতেন না। জেলার বাইরে মন্ত্রণালয়ের কাজে তাঁদের সহায়তা করতেন ঢাকা টাইমস–এর সম্পাদক আরিফুর রহমান ওরফে দোলন। বিনিময়ে তিনি কমিশন নিতেন।
এ বিষয়ে জানতে আরিফুর রহমানের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। তাঁর ব্যক্তিগত কার্যালয়ে যোগাযোগ করা হলে সেখান থেকে বলা হয়, বেশ কিছুদিন ধরে তিনি আসছেন না।
ফরিদপুরের এক ঠিকাদার বলেন, দরপত্রের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর শিডিউল কিনতে পারলেও সেই দরপত্র কে জমা দেবে, সেটা বরকত-রুবেল ঠিক করে দিতেন। কথা না শুনলে সন্ত্রাসী পাঠিয়ে বাড়িতে হামলা করে দরপত্রের ক্রেতাকে তুলে নিয়ে আনা হতো। ফরিদপুরের সব ঠিকাদারি কাজ হতো সরকারনির্ধারিত দরের চেয়ে কমপক্ষে ১০ শতাংশ অতিরিক্ত দরে। ওই ঠিকাদার বলেন, ফরিদপুর জেলা এলজিইডি অফিসটি ছিল শহরের আদালতপাড়ার কাছে। ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ করতে বরকত-রুবেলরা এলজিইডি কার্যালয়টি বদরপুরে তাঁদের বাড়ির পাশে নিয়ে যান।
এলজিইডি কার্যালয় স্থানান্তর হয়েছে কার আগ্রহে, জানতে চাইলে ফরিদপুর এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী ফারুক হোসেন বলেছেন, তিনি আসার আগেই এটা ঘটেছে। দরপত্র নিয়ে অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কোনো অনিয়ম হয়েছে কি না, সেটা ভেতর থেকে বোঝা যেত না। তবে এমনও দেখা গেছে, দরপত্র আহ্বান করার পর অনেক শিডিউল বিক্রি হলেও জমা পড়ত খুব কম। এতে অনিয়মের বিষয়টি বোঝা যেত, কিন্তু কারও কিছু করার ছিল না।
তবে ওই কার্যালয়ের সূত্রে জানা গেছে, দুই ভাইয়ের প্রতিষ্ঠান গত পাঁচ বছরে ৬৬৭ কোটি টাকার ৪২০টি উন্নয়নকাজের কার্যাদেশ পেয়েছে।
স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বরকত বলেছেন, এলজিইডির কাজের কমিশন আদায়ের ক্ষেত্রে তাঁদের হয়ে কাজ করতেন বরকত গ্রুপের নির্বাহী কর্মকর্তা রেজোয়ান আহমেদ ও অ্যাকাউন্ট্যান্ট হায়দার আলী। ফরিদপুর শিল্প ও বণিক সমিতির সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান নিয়ন্ত্রণ করেন গণপূর্ত, সড়ক ও জনপথ, শিক্ষা প্রকৌশল, জনস্বাস্থ্য বিভাগের কাজ। সিদ্দিকুর রহমান অবশ্য তাঁর বিরুদ্ধে আসা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
ফরিদপুর সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী কে এম নকিবুল বারীর দাবি, সড়ক ও জনপথের সব কাজ ইজিপির মাধ্যমে হওয়ায় সেটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। বরকত-রুবেলরা ঠিকাদারদের হাত করে ১৯ কোটি টাকার দুটি কাজ বাগিয়ে নিয়েছিলেন।
জবানবন্দিতে বরকত আরও বলেন, মোশাররফ হোসেনের এপিএস ফুয়াদের নির্দেশে স্বেচ্ছাসেবক লীগের ফাহাদ বিন ওয়াজেদ বিএডিসি, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও বিদ্যুৎ অফিসের কাজ নিয়ন্ত্রণ করে। ফুয়াদের একটি সন্ত্রাসী বাহিনীও আছে। সেটি হেলমেট বাহিনী নামে পরিচিত। এরা মোটরসাইকেলে করে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করে বেড়ায়।
স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলা হয়, ফরিদপুরের পাসপোর্ট অফিস, পৌরসভা, বিআরটিএ এবং ফুটপাত নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে ছিলেন শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি নাজমুল হাসান খন্দকার লেবী। তাঁর পক্ষ নিয়ে চাঁদা তুলতেন শহর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক তরিকুল ইসলাম নাসিম।
শুধু সরকারি প্রতিষ্ঠান দখলই নয়, কোন খাতে কে চাঁদাবাজি করবে, সেটাও নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। বরকতের মতে, বাস কাউন্টারের চাঁদা আদায় করতেন জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম এবং এস এম কামাল জামাল। এ টাকার ভাগ পেতেন কবিরপুরের সোহাগ শেখ, সহিদুল মোল্লা ও আবদুস সাত্তার মোল্লা। বিআইডব্লিউটিসির সিঅ্যান্ডবি ঘাট নিয়ন্ত্রণ করতেন ডিক্রির চর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন আবু মেম্বার ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. খায়রুজ্জামান। ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ এলাকা নিয়ন্ত্রণ করেন অস্ত্রধারী আলীয়াবাদ ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক সদস্য মোবারক খলিফা, শহর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক মিনার হাসান চৌধুরী, সোহাগ শেখ ও আজমল হোসেন ওরফে ছোট আজম।
এসব তথ্য পাওয়া গেছে আসামিদের জবানবন্দি থেকে। পুলিশ সুপার আলিমুজ্জামান জানালেন, তথ্যগুলো পুলিশ খতিয়ে দেখছে।
মনে হলেই জমি দখল
ফরিদপুরের গোয়ালচামট ওয়্যারলেস সড়কের বাসিন্দা মিজানুর রহমান চৌধুরী ফজরের নামাজ পড়ে মসজিদ থেকে বাড়ি ফিরছিলেন। এক পুলিশ কনস্টেবল তাঁকে বলেন, ওসি সাহেব ডাকছেন, এখনই যেতে হবে। তিনি থানায় যাওয়ার পর তাঁকে হাজতে ঢুকিয়ে দেন কোতোয়ালি থানার তৎকালীন ওসি মহসিন হোসেন।
মিজানুর রহমান চৌধুরী বলেন, ‘সারা দিন হাজতে রাখার পর রাতে আমার ভাইকে ডেকে ওসি বললেন, বরকত-রুবেলদের সঙ্গে সমঝোতা না করলে ক্রসফায়ারে দেওয়া হবে। তিনি বরকত-রুবেলের সঙ্গে বসতে রাজি হওয়ার পর ছেড়ে দেওয়া হয়।
ওসি মহসিন পদোন্নতি পেয়ে এএসপি হয়েছেন। এখন তিনি গণভবনের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা এসপিবিএনে কর্মরত। ওই ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অত দিন আগের কথা আমার মনে নেই।’
মিজানুর রহমান চৌধুরী আরেকটি ঘটনার কথা জানালেন। ইসলামী ব্যাংকের বন্ধকি ৮ একর জমি তাঁরা কয়েকজন মিলে নিলামে কেনেন। হঠাৎ বরকত দাবি করে বসেন, সেই জমির অর্ধেক তাঁকে দিতে হবে। উপায়ান্তর না পেয়ে শেষ পর্যন্ত ১ একর ৬০ শতাংশ জমি তিনি বরকতকে লিখে দেন।
মিজানুর একা নন, আরও অনেকে এভাবে বরকতকে জমি লিখে দিতে বাধ্য হয়েছেন। জমি হারানো ব্যক্তিদের মধ্যে আছেন শামীম হাসান, সাগর মোল্লা, জিল্লুর রহমান, রফিকুল ইসলাম। বরকত-রুবেলরা এমনই বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলেন যে কোনো জমি পছন্দ হলেই দখল করে নিতেন। এ কাজে কখনো পুলিশ আবার কখনো জেলা প্রশাসন সাহায্য করেছে।
ফরিদপুর আদালতের আইনজীবী অশোক কুমার দাসের ২৫ শতাংশ জমির বাজারমূল্য ছিল চার কোটি টাকা। সেই জমি মাত্র ৮০ লাখ টাকায় বিক্রি করতে বাধ্য করা হয়। জমি রেজিস্ট্রির কিছুদিন পর ২০১৯ সালের ৬ এপ্রিল সন্ধ্যায় হঠাৎ করে তিনি মারা যান। অশোক কুমার দাসের এই মৃত্যুকে অনেকে রহস্যজনক বলে জানিয়েছেন।
ফরিদপুর শহরের নুর মিয়া সড়কে প্রায় ১০ একর জমি পিলার বসিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ নিয়ে এলাকার মানুষ শঙ্কিত। বরকত-রুবেলরা এ জমি দখল করতে চান।
শহরের বাইপাস সড়ক সম্প্রসারণের আগে আশপাশের জমি কম দামে কিনে নিয়েছিলেন বরকত। ২০১৮ সালে অধিগ্রহণ করার সময় সেই জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে বেশি দাম দেখান। এ কাজে তৎকালীন জেলা প্রশাসক তাঁকে সহায়তা করেন বলে অভিযোগ আছে। এই জেলা প্রশাসক এখন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে আছেন, যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে চাননি।
এই চক্র যে শুধু ব্যক্তির জমি দখল করছে তাই নয়, তারা সরকারি খাস খতিয়ানের জমিও দখলে নিয়েছে। চরভদ্রাসন রেজিস্ট্রি অফিসে বরকতের নামে পাঁচটি দলিলে খাস খতিয়ানের সাত একর জমি রেজিস্ট্রি হওয়ার পর মিউটেশনের জন্য সহকারী কমিশনার (ভূমি) কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছিল। ওই সময় চরভদ্রাসনের দায়িত্বে ছিলেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কামরুন নাহার। তিনি এ জমির খারিজ বন্ধ করে দেন। এখনো সেটা এই অবস্থায় আছে। তবে এসব কিছু তোয়াক্কা না করে বরকত-রুবেলরা নর্থ চ্যানেল ও ডিক্রির চর ইউনিয়নে ১০০ একর ও ৭০০ একর জমি দখল করে ইটের রাস্তা ও স্থাপনা তৈরি করে। সেখানে বরকত অ্যাগ্রো প্রাইভেট লিমিটেড ও হাইব্রিড নারকেলবাগানের সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। চরে বরকতের স্ত্রী আফরোজা পারভিনের নামে জমি আছে ১৬ একর ৬১ শতাংশ।
ফরিদপুর আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা বলেছেন, এভাবে ভয় দেখিয়ে, দখল করে বরকত ও রুবেল ফরিদপুর শহর এবং এর আশপাশে বিপুল পরিমাণ সম্পত্তির মালিক হয়েছেন। ফরিদপুর শহরের গোয়ালচামটে একটি, মাঝকান্দিতে একটি ও ধুলন্দি রেলগেটে একটি পেট্রলপাম্প স্থাপন করেছেন। শহরের নতুন বাসস্ট্যান্ডের কাছে ‘হোম স্টাইল’ নামের একটি চারতলা আবাসিক হোটেল করেছেন। ঝিলটুলীতে রয়েছে ১০ তলা ভবন। চণ্ডীপুরে বিবিএস নামে তাঁদের একটি ইটভাটাও রয়েছে।
পুলিশের কর্মকর্তারা বলেছেন, জিজ্ঞাসাবাদে দুই ভাই ৫৭৩ বিঘা জমি থাকার কথা স্বীকার করেছেন। জমিগুলো আছে ধুলন্দি, গোয়ালচামট, বদরপুর, কৈজুরি, কবিরপুর, শিবরামপুর, বোয়ালমারী, রঘুনন্দপুর, ডিক্রির চর, রাজবাড়ীর খানখানাপুর, মাচচর, চর সালিশপুর, মুনশি বাজার, বাইপাস, ব্রাহ্মণকান্দা, চণ্ডীপুর, নর্থ চ্যানেল এবং রাজবাড়ী মোড়ে।
গত ১৮ জুন ফরিদপুরে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বরকত বলেছেন, দখল করা জমি দেখাশোনার জন্য আফজল হোসেন ওরফে শিপলু নামের তাঁর একজন ক্যাডার রয়েছে। এই শিপলু সব সময় অবৈধ অস্ত্র নিয়ে ঘোরাফেরা করে।
প্রেসক্লাব দখল, সাংবাদিকদের মারধর
ফরিদপুর শহর থেকে ২০১৬ সালে ভোরের প্রত্যাশা নামে রাতারাতি একটি পত্রিকার ডিক্লারেশন হয়ে যায়। সেই পত্রিকার প্রকাশক বরকত আর সম্পাদক ইমতিয়াজ হাসান ওরফে রুবেল। সম্পাদক হওয়ার যোগ্যতা রুবেলের ছিল না। সম্পাদক হওয়ার পর দলবল নিয়ে ফরিদপুর প্রেসক্লাব দখল করেন। সাধারণ সাংবাদিকেরা হাঁ করে সেই দৃশ্য দেখেন। তবে বরকত-রুবেল গ্রেপ্তারের পরদিন পত্রিকাটির প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়।
গত ১৮ জুন ফরিদপুর আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে রুবেল বলেন, সম্পাদক হয়ে প্রেসক্লাব দখলের এই পরামর্শ দিয়েছিলেন ঢাকা টাইমস’এর সম্পাদক আরিফুর রহমান ওরফে দোলন। তাঁর পরামর্শে ২০১৬ সালে তিনি প্রেসক্লাব দখল করেন। দখলে নিয়েই তিন ছয়বারের সভাপতি হাবিবুর রহমানকে বহিষ্কার ও সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল হক ওরফে পিকলুকে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে হেনস্তা করেন। প্রথম আলোর ফরিদপুর প্রতিনিধিকে তাঁর দলের লোকেরা একাধিকবার শারীরিক নির্যাতন করেন।
দুই ভাই পুলিশের কাছে স্বীকার করেছেন, রুবেলের নির্দেশে ফরিদপুরের সাংবাদিক কবিরুলকে কুপিয়ে জখম করা হয়। স্থানীয় আরও কয়েকজন সাংবাদিককে তাঁর নির্দেশে লাঞ্ছিত ও মারধর করা হয়।
হাতুড়ি ও হেলমেট বাহিনীর তাণ্ডব
ফরিদপুর শহর দাপিয়ে বেড়ানো একটি বাহিনীর নাম ‘হেলমেট বাহিনী’। এরা রাস্তায় বের হলেই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এক সারিতে ১০-১২টি মোটরসাইকেল, প্রতিটিতে তিনজন করে বসা। সবার মাথা হেলমেটে ঢাকা। এই বাহিনী চলে মোশাররফ হোসেনের এপিএস ফুয়াদের নির্দেশে। ফরিদপুরে অভিযানের পর ফুয়াদ আর প্রকাশ্যে আসছেন না।
আরও একটি বাহিনী আছে। তারাও চলে মোটরসাইকেলে। এদের সবার হাতে থাকে একটি করে হাতুড়ি। তাই এদের নাম ‘হাতুড়ি বাহিনী’। এই বাহিনী চালাতেন বরকত নিজে। দুই ভাই গ্রেপ্তারের খবর এই বাহিনীর সবাই গা ঢাকা দেয়।
ফরিদপুরের পুলিশ ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বরকত-রুবেলদের দখল, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, হামলা, ভয়ভীতি দেখানো থেকে শুরু করে সব ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করত এই দুই বাহিনী। দুই ভাই জবানবন্দিতে এসব অপকর্মের কথা স্বীকারও করেন।
ফরিদপুরের সরকারি রাজেন্দ্র কলেজের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক তপন দেবনাথের বাড়িতে ২০১৯ সালের ১৫ মে হামলা করে হেলমেট বাহিনী। তারা পরিবারের সবাইকে বাড়ি থেকে বের করে দরজায় তালা ঝুলিয়ে দেয়। তপন দেবনাথের অপরাধ, তিনি ফরিদপুরের সাংবাদিক প্রবীর শিকদারের ভগ্নিপতি। প্রবীর শিকদার এই বাহিনীর বিরুদ্ধে অনলাইনে লেখালেখি করেন। হেলমেট বাহিনী এ ঘটনার এক সপ্তাহ আগে প্রবীর শিকদারের ভাই সুবীর শিকদারের বাড়িতেও হামলা করে। অনেক দিন তপন দেবনাথ নিজের বাড়িতে উঠতে পারেননি। পুলিশ সুপার ও জেলা প্রশাসক তাঁদের বাড়িতে তুলে দিতে ব্যর্থ হন। পরে ১ মাস ৯ দিন পর পুলিশ মহাপরিদর্শকের নির্দেশে তপন দেবনাথ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে নিজের বাড়িতে ওঠেন। তপন দেবনাথ বলেন, ‘আমার অপরাধ কী, সেটা আমি এখনো জানি না।’
কোতোয়ালি থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুল আলম চৌধুরী একজন ব্যবসায়ী। তাঁর অভিযোগ, রুবেল ও বরকত তাঁর কাছে ৫০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন। চাঁদা দিতে না চাইলে গত বছরের ২২ ডিসেম্বর রাতে বরকত-রুবেলের নেতৃত্বে হাতুড়ি বাহিনীর ১৫-২০ জন সন্ত্রাসী তাঁর প্রতিষ্ঠানে হামলা করে। সন্ত্রাসীরা তাঁকে, তাঁর ছেলেকে এবং গাড়িচালককে মারধর করে সোয়া পাঁচ লাখ টাকা নিয়ে যায়। ঘটনার প্রায় এক বছর পর গত ১২ জুন তিনি এ ঘটনায় মামলা করেন।
পুলিশ জানিয়েছে, শামসুল আলমের প্রতিষ্ঠানে হামলার কথা দুই ভাই স্বীকার করেছেন। তাঁরা বলেছেন, ছাত্রলীগের সাইফুল ইসলাম, বিল গজারিয়ার হেলাল, সাদিপুরের ভাগনে সোহেল, বটতলার মহিউদ্দিন, কমলপুরের মকবুলসহ ১৫-২০ জন এই হামলায় অংশ নেন। হেলমেট বাহিনীর প্রধান ফুয়াদও তখন দলবল নিয়ে উপস্থিত ছিলেন।
শহীদ সুফি সড়কের মজুমদার ড্রাগ হাউসের ব্যবস্থাপক মানিক চক্রবর্তী কাছে অভিযোগ করেন, ৮০ লাখ টাকা চাঁদার দাবিতে হাতুড়ি ও হেলমেট বাহিনী গত ৬ ফেব্রুয়ারি তাঁদের প্রতিষ্ঠানে হামলা চালিয়ে মালিক দীপক মজুমদারকে আহত করেন।
ফরিদপুরে বিআরটিসি বাসস্ট্যান্ড পরিচালনার দায়িত্বে থাকা দুলাল লস্কর অভিযোগ করেন, ২০১৮ সালের ২৬ আগস্ট বরকত-রুবেলরা তাঁর কাউন্টারে হামলা করে সেটা দখল করে নেন। এরপর তিনি আর সেখানে যেতে পারেননি।
পুলিশ জানায়, পরিবহনে চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে ২০১৬ সালে রাজবাড়ী রাস্তার মোড়ে ছোটন বিশ্বাস নামের এক খ্রিষ্টান যুবক খুন হয়। এই খুনের নির্দেশদাতা ছিলেন বরকত-রুবেল। কিন্তু অদৃশ্য কারণে মামলার অভিযোগপত্র থেকে তাঁদের নাম বাদ দেওয়া হয়।
বরকত-রুবেলের অনুমতি না নিয়ে টুঙ্গিপাড়ায় যাওয়ার অভিযোগে আইনজীবী ও আওয়ামী লীগ নেতা বদিউজ্জামান বাবুলকে তাঁরা কুপিয়ে জখম করেন। একইভাবে জেলা আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক দীপক কুমার মজুমদারকে তাঁরা পিটিয়ে আহত করেন। এঁদের হাত থেকে রেহাই পাননি পূজা উদ্যাপন কমিটির সাধারণ সম্পাদক অলক সেন, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালতের পিপি স্বপন পাল, কোতোয়ালি থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অমিতাভ বোসসহ অনেক নেতা-কর্মী।
দীপক কুমারকে পেটানোর কথা স্বীকার করে রুবেল জবানবন্দিতে বলেন, জমিজমা নিয়ে তাঁদের বিরুদ্ধে দীপক থানায় অভিযোগ করেছিলেন। হামলা কারণ সেটাই।
বরকত জবানবন্দিতে বলেন, ২০১৫ সালে কৈজুরিতে গণপিটুনিতে দুই যুবক খুন হন। এই খুনে জড়িত ছিলেন তাঁদের দলের আইয়ুব আলী, পারভেজ মোল্লা ও বিশ্বজিৎ গোস্বামী।
দুই ভাই গ্রেপ্তারের পর শহর এখন শান্ত। জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক কোষাধ্যক্ষ মাহবুবুর রহমান খান জানালেন, দুই বাহিনীর কোনো সদস্য এখন শহরে নেই। শহরের মানুষগুলো এত দিন বোবা-কানা হয়ে ছিল।
ফরিদপুর শহরের সাধারণ বাসিন্দারা বলছেন, এই শহরে প্রশাসন, পুলিশ, আইন, আদালত সবই ছিল। তাহলে এত দিন কেন রাজনৈতিক সন্ত্রাসী আর গডফাদাররা শহর শাসন করল? কেন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি?
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক ও সরকারদলীয় বর্তমান সাংসদ নূর মোহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, রাজনৈতিক নেতারা মানুষের জন্য তদবির করতেই পারেন, এটা তাঁদের জনসেবার অংশ। কিন্তু পুলিশ বা প্রশাসনের কাজ হলো তদবিরটা যদি বেআইনি হয়, তাহলে সেটা না শোনা। বেআইনি তদবির তাঁরাই শোনেন, যাঁরা নিজেরা দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত এবং এ থেকে সুবিধা নিতে চান। এ জন্য যাঁরা বেআইনি কাজের সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া উচিত।
পিবিএ/এমএ সূত্র : প্রথম আলো