কামরুল হাসান: বিমানবন্দর থেকে কাস্টমস ইন্সপেক্টর ফিরোজ আহমেদ ফোন করেছেন অফিসের টিঅ্যান্ডটি নম্বরে। জনকণ্ঠের টেলিফোন অপারেটর লিজা আমার এক্সটেনশন নম্বরে ফোনটা ফরোয়ার্ড করে বললেন, ভদ্রলোক নাকি আপনার পরিচিত, খুব বিপদে আছেন।
ফিরোজ আহমেদকে আমি বেশ ভালোভাবেই চিনি। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের ডাকসাইটে ইন্সপেক্টর। বড় বড় অপারেশন করেন। সিরাজগঞ্জে বাড়ি, আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ নাসিমের ঘনিষ্ঠ। ভেবে পেলাম না, তাঁর মত মানুষ কি এমন বিপদে পড়তে পারেন।
ফোন ধরলাম, ফিরোজ সাহেব কথা বলছেন আর হাঁপাচ্ছেন। তাঁর কথা শুনে বুঝলাম তিনি নন, বিপদে পড়েছেন তার এক ঘনিষ্ঠ সহকর্মী।
বিষয়টা কী? প্রশ্ন করতে তিনি সেই কর্মকর্তার নাম ধরে বললেন, তাঁর বন্ধু সেই কাস্টমস অফিসারের অবস্থা খুব খারাপ। এক সন্ত্রাসী দলবল নিয়ে তাঁর বাড়িতে ঢুকে বউ বাচ্চার সামনে মাথায় রিভলবার ঠেকিয়ে বলেছে, বিমানবন্দরে আটকে রাখা তার মালামাল কালকের মধ্যে ছেড়ে না দিলে মাথায় গুলি করবেন। আর কাস্টমস অফিসারের স্ত্রীকে বলেছেন, ‘তোর স্বামীকে বলিস কথা না শুনলে তাকে গুলি করব । তারপর স্বামীর ছবির দিকে তাকিয়ে জীবন পার করিস’ । এই হুমকির পর তাদের এক বাচ্চা অজ্ঞান হয়ে গেছে। ভাবি কাঁদছেন, কাস্টমস কর্মকর্তার বুকে ব্যথা শুরু হয়েছে। তিনি হার্টের ব্যথা কমানোর ট্যাবলেট জিবের নিচে দিয়ে শুয়ে আছেন।
সন্ত্রাসীটা কে? জানতে চাইতেই তিনি বললেন, মুরগি মিলন। চেন নাকি?
আমি বললাম নিউজ করে দেব? ‘কাস্টমস কর্মকর্তার বাসায় ঢুকে প্রাণনাশের হুমকি’ । নাকি এতে বিপদ আরও বাড়বে? ফিরোজ সাহেব একটু চুপ করে থাকলেন। কয়েক মুহূর্ত ভাবলেন। তারপর বললেন-তুমি ভাই একটা বড় নিউজই করে দাও, যা থাকে কপালে।
ফিরোজ সাহেবের ফোন রেখে বিস্তারিত জানতে সেই কর্মকর্তার বাসায় ফোন দিলাম। ধরলেন তাঁর স্ত্রী। ফিরোজ সাহেবের রেফারেন্স দিতেই শুরু করলেন কান্না। বারবার অনুরোধ করলেন-এ খবর যেন ছাপা না হয়। ছাপা হলে তারা সবাই প্রাণে মারা যাবেন। আমি পড়লাম দোটানায়।
জনকণ্ঠের তখন প্রধান প্রতিবেদক ছিলেন প্রয়াত আবদুল খালেক। তাঁকে জানাতেই তিনি বললেন, আগে পুলিশের সঙ্গে কথা বলো। তার আগে বলো এদের গুরু কে? আমি বললাম-এরা লিয়াকতের লোক। আর লিয়াকত চলেন হেমায়েতউল্লাহ আওরঙ্গের সঙ্গে। তিনি বললেন, এত দুরে যাওয়ার দরকার নেই, তুমি লিয়াকতকে ফোন দিয়ে ঘটনাটা বলো, আর মুরগি মিলনের বক্তব্য চাও।
ইস্কাটনে জনকণ্ঠ ভবন থেকে বাংলামোটরের দিকে যেতে হাতের বামে হেলেনা সেন্টার। এখন সেখানে মোটর পার্টসের বড় মার্কেট। সেই মার্কেটের পেছনে একটি ঘর ছিল লিয়াকতের ব্যক্তিগত কার্যালয়। প্রতিদিন বিকেল থেকে লিয়াকত তাঁর লোকজন নিয়ে সেখানে বসে ‘দাদাগিরি’ করতেন। পুলিশ-আমলাসহ অনেকে সেখানে যেতেন। সে তালিকায় কিছু সাংবাদিকও ছিলেন। লিয়াকতের সেই অফিসের ল্যান্ড ফোন নম্বরটি জানা ছিল। তখনই ফোন দিলাম। লিয়াকত নিজেই ফোন ধরলেন। সব শুনে বললেন, ‘দাঁড়ান দেখছি ।’
২০-২৫ মিনিট পর জনকণ্ঠের নিচ তলার অভ্যর্থনা থেকে একের পর এক ফোন । ১০ / ১২ জন লোক এসে হইচই করছে। আমাকে নামতে বলছেন। আমি নেমে দেখি লিয়াকত ও মুরগি মিলন তাদের দলবল নিয়ে এসেছেন।
আমাকে দেখেই লিয়াকত এগিয়ে এলেন, সঙ্গে মুরগি মিলন। লিয়াকত খুব ঠান্ডা, কিন্তু মুরগি মিলন উত্তেজিত। ঘটনার বিস্তারিত শুনলাম। এলিফ্যান্ট রোডে মেয়েদের জুতা-সেন্ডেলের দোকান ছিল মুরগি মিলনের। সেই দোকানের মালামাল এসেছে থাইল্যান্ড থেকে। ভুয়া কাগজপত্রের কারণে চালান আটকে দেন সেই কাস্টমস অফিসার। এতে মুরগি মিলন ক্ষুব্ধ।
আমি বললাম আমি একটা নিউজ করব, আপনার বক্তব্যের জন্য ফোন দিয়েছিলাম। মুরগি মিলন প্রচণ্ড রেগে গেলেন, বললেন আপনি যদি নিউজ করেন আমি এখনই গিয়ে গুলি করে আসব। আমি কিছু না বলে চুপ করে আছি।এবার মুরগি মিলন বললেন, আর যদি নিউজ না করেন, তাহলে এখনই গিয়ে মাফ চেয়ে আসব। বলেন, কোনটা করবেন?
চিফ রিপোর্টারকে বললাম, এই অবস্থা কি করব? তিনি সব শুনে বললেন, নিউজের দরকার নেই ভাই, মাফ চেয়ে আসতে বল। বললাম, ঠিক আছে নিউজ করছি না। মুরগি মিলন বললেন, মাফ চাইতে যাচ্ছি। তবে কথার বরখেলাপ যেন না হয়।
ঘণ্টা দেড়েক পরে আবার ফিরোজ সাহেবের ফোন। আরে মিয়া কি কাণ্ড করছ! এরা তো ১৫-১৬ জন মোটরসাইকেল নিয়ে গেছে মাফ চাইতে। কোনো কথা না বলে দলেবলে বাসায় ঢুকে পড়েছে। সবাই ভয়ে অস্থির। তবে মাফ চেয়েছে, তারপর মিষ্টি খেয়ে বিদায় নিয়েছে। মিষ্টি পছন্দ হওয়ায় সালাম ডেইরি থেকে সবার জন্য এক কেজি করে মিষ্টিও দেওয়া হয়েছে।
এই ঘটনা ১৯৯৮ সালের মাঝামাঝির। তো এই লেখার আগে সেই কাস্টমস কর্মকর্তাকে ফোন দিলাম। তিনি এখন অবসরে। বারবার অনুরোধ করলেন, তার নামটা যেন না লিখি। ছেলে-মেয়েরা বড় হয়েছে, বিয়েও দিয়েছেন। শ্যালক একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান। পাছে তিনিও না আবার বিব্রত হন।
এত দিন পর ঘটনাটি বললাম আমার এক সহকর্মীকে। তিনি জানতে চাইলেন, পুলিশ তখন কোন অ্যাকশনে গেল না কেন? সে কথাও জানালাম তাকে।
রিপোর্ট না করলেও চিফ রিপোর্টারের সঙ্গে কথা বলে ফোন করেছিলাম রমনা থানার ওসিকে। তিনি সব শুনে বললেন, এ ঘটনা আমার এলাকায় হয়নি। এখানে আমার কিছু করার নেই। আপনি বরং ডিবিকে বলেন। ডিবিতে তখন সর্বোচ্চ কর্মকর্তা ছিলেন ডিসি পদের। সেই পদে তখন ছিলেন সৈয়দ বজলুল করিম। তাঁকে বলতেই তিনি সিলেটী উচ্চারণে বলেন, ‘আরে মিয়া, তুমরা তুমরা মিলাইয়া লও ।’ আমাকেও তিনি সন্ত্রাসীর সারিতে ফেলে দিলেন ।
ভোরের কাগজের তখনকার ক্রাইম রিপোর্টার ও আমার বন্ধু পারভেজ খান (এখন ইন্ডিপেনডেন্ট টিভিতে)। একদিন রাতে ফোন করে বললেন, লিয়াকতের নেতৃত্বে হান্নান, মুরগি মিলন, জয়, টিক্কা, মোল্লা মাসুদসহ আন্ডারওয়ার্ল্ডের সাত সন্ত্রাসী জোট করেছে। আগের দিন রাতে তারা নাকি কোনো একটা চাইনিজ রেস্টুরেন্টে বসেছিল। বিষয়টা কনফার্ম হতে আমি আরেকজনকে ফোন দিলাম। জানালেন-তিনিও নাকি এটা শুনেছেন। পারভেজ খান বললেন, এদের একটা নাম দে-‘সেভেন স্টার বাহিনী ।’
আমি আরও কয়েকজনের বক্তব্য নিয়ে একটি নিউজ করে দিলাম-‘আন্ডারওয়ার্ল্ডে সন্ত্রাসীদের নতুন জোট সেভেন স্টার ।’ দুদিন পর পুলিশ প্রেস রিলিজ দিয়ে বলল-‘সেভেন স্টার বাহিনীর দুই সদস্য গ্রেপ্তার হয়েছে ।’ চালু হয়ে গেল ‘সেভেন স্টার’ । পরে অবশ্য এ দলটা ভেঙে যায়। তখন এদের নাম হয় ‘ফাইভ স্টার’ ।
৯০ দশকের শুরুতে যেসব সন্ত্রাসীরা ঢাকা শহর কাঁপাতেন তাদের অনেকেই ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর নিজেদের যুবলীগ-ছাত্রলীগের পরিচয় দিতে শুরু করেন। আর যাদের রাজনৈতিক পরিচয় ছিল না, বাহিনী তৈরি করে তারাও রীতিমতো এলাকা দখলে মেতে ওঠেন। বিএনপিপন্থী বলে পরিচিত সন্ত্রাসীরাও তখন দলবদল করে রাতারাতি যুবলীগ হয়ে যায়।
এই সময়েই ঢাকা শহরে যেসব সন্ত্রাসীর উত্থান হয় তার মধ্যে ছিল, রাজাবাজারের সুইডেন আসলাম, পাইকপাড়ার বিকাশ ও তার ভাই প্রকাশ, মগবাজারের ত্রিমাতি সুব্রত বাইন, মোল্লা মাসুদ, টিক্কা, মোহাম্মদপুরের যোশেফ–হারিস, এলিফ্যান্ট রোডের মুরগি মিলন, নিউ ইস্কাটনের লিয়াকত,পুরান ঢাকার আগা শামিম, সায়েদাবাদের নাজিম, মুন্না, বিএনপি বস্তির ঝুলু, রূপনগরের আল আমিন শিকদার, যুবদলের টোকাই সাগর, জয়, কালা জাহাঙ্গির, ধানমন্ডির ইমনসহ বেশ কয়েকজন। তবে এদের কারও কারও রাজনৈতিক পরিচয় থাকলেও কোনো সামাজিক স্বীকৃতি ছিল না। সেই তালিকার একজন হলেন মুরগি মিলন।
স্বাধীনতার পর যুবলীগের সক্রিয় কর্মী হিসেবে মুরগি মিলন প্রভাবশালী নেতা মোস্তফা মহসিন মন্টু ও হেমায়েত উল্লাহ আওরঙ্গের ঘনিষ্ঠ হন। ৭৫ এ বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার পর তিনি দেশ ছেড়ে ভারতের চলে যান। ১৯৭৮ সালে ফিরে এসে ব্যবসা শুরু করেন। প্রথম ব্যবসা ছিল এলিফ্যান্ট রোডে জুতার দোকান। পরে তিনি মার্কেট ও গার্মেন্টস কারখানা করেন। একবার মুরগি মিলন আমাকে বলেছিলেন, ১৯৭৫ সাল ২৩ এপ্রিল চোরাচালানের মামলায় তিনি প্রথম গ্রেপ্তার হয়েছিলেন।
মুরগি মিলনের জন্ম মুন্সিগঞ্জে হলেও তারা থাকতেন ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে। দুই ভাই, বাবা তাজুল ইসলাম হাতিরপুলে মুরগির ব্যবসা করতেন। ১৮ বছর পর্যন্ত মিলন সেই ব্যবসা দেখাশোনা করেন। সে কারণে বড় হয়েও তার নামের সঙ্গে ‘মুরগি’ শব্দটি লেপ্টে থাকে । তবে মিলন এ জন্য ভোরের কাগজের ক্রাইম রিপোর্টার পারভেজ খানকে দায়ী করতেন। একদিন আমাকে বললেন, পারভেজ খান একটি নিউজের জন্য তার সঙ্গে অনেকক্ষণ ধরে কথা বলেছিলেন। এর কিছুদিন পর জায়েদুল আহসান পিন্টুর (এখন ডিবিসির সম্পাদক) নামে একটি নিউজ ছাপা হয় ভোরের কাগজে। এটা ১৯৯৬ সালের ঘটনা। সেই নিউজে তার নাম মুরগি মিলন বলে উল্লেখ করা হয়। এরপর থেকে সবাই তাকে এই নামেই ডাকতে শুরু করেন।
পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চি উচ্চতার মুরগি মিলনের মুখে ছিল গুটি বসন্তের দাগ, এ কারণে খুব সহজে তাকে চেনা যেত। একবার মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় তাঁর ডান হাত ভেঙে যায়। সেই হাতের হাড় আর ঠিকমতো জোড়া লাগেনি। হাঁটার সময় হাত বাঁকা করে হাঁটতেন।
মুরগি মিলনের স্ত্রী নাসরিন কবির ডলির বাবা ছিলেন সাবেক জেলা জজ। তো জজ সাহেব তাঁর মেয়েটা এমন সুপাত্রের হাতে তুলে দেবেন না। তিনি মেয়েকে অন্যত্র বিয়ে দেওয়ার আয়োজন করলেন। খবর পেয়ে মুরগি মিলন ডলিকে বাড়ি থেকে তুলে এনে বিয়ে করেন।
মুরগি মিলন মোট কতবার গ্রেপ্তার হয়েছিলেন তা মনে নেই, তবে প্রতি বছর তিনি দু-তিন বার করে গ্রেপ্তার হয়ে জেলে যেতেন। এরপর জামিনে বেরিয়ে এসে ঘুরে বেড়াতেন। তবে কখনো একা চলাফেরা করতেন না। তার বিরুদ্ধে সে সময় ১৬-১৭টি মামলা ছিল, যার প্রায় সবই চোরাচালানের। পুলিশ কর্মকর্তারা বলতেন, তিনি ছিলেন স্বর্ণ চোরাচালানের রিং লিডার। তার প্রধান কাজ ছিল বিমানবন্দরে আসা সোনার চালান নিরাপদে ছাড়িয়ে এনে সীমান্ত পার করে দেওয়া। এই সোনায় লগ্নি করতেন ভারতের কয়েকজন ব্যবসায়ী। ভারত থেকে গরুর যে চালান আসত তার সঙ্গে সোনার দামের সমন্বয় করা হতো। অর্থাৎ সোনার বদলে গরু আসত ওপার থেকে।
সোনা পাচারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বিমানবন্দর এলাকার নিয়ন্ত্রণ রাখা। তবে পাচার হয়ে সোনা যেহেতু তাঁতিবাজারে আসত, সে কারণে তাঁতিবাজারের নিয়ন্ত্রণও বড় ব্যাপার ছিল। এই নিয়ন্ত্রণ নিয়েই মুরগি মিলনের সঙ্গে বিরোধ বাঁধে কালা জাহাঙ্গীর ও টোকাই সাগর নামে পরিচিত আমিন রসুল সাগরের। একপর্যায়ে কালা জাহাঙ্গীর তাঁতি বাজারের নিয়ন্ত্রণ নিতে চান, আর টোকাই সাগর চাইলেন বিমানবন্দরের। দুজনের স্বার্থ মিলে গেলে পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়ায় মুরগি মিলন। এরপর তারা মুরগি মিলনকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু সেটাও সহজ কাজ ছিল না। মুরগি মিলন সব সময় পাহারায় চলতেন। তাকে মারতে হলে বিশাল আয়োজন করতে হবে। ২০০০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর এলে সেই মোক্ষম সময়। এদিন ক্যান্টনমেন্ট থানার একটি চোরাচালান মামলায় হাজিরা দিতে আদালতে যান মুরগি মিলন।
জনকণ্ঠের আদালত প্রতিবেদক ছিলেন এখনকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালতের পিপি আলী আসগর স্বপন। সব বিপদে তিনি আমার পাশে থাকেন। স্বপন ভাইয়ের ফোন পেয়ে দুপুরের দিকে ছুটে গেলাম আদালতে। গিয়ে শুনলাম ঘটনা ঘটেছে বেলা দেড়টার দিকে। মুরগি মিলন তখন আদালত থেকে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামছিলেন। হঠাৎ জজ আদালতের বাইরে দুটি ককটেল বিস্ফোরণ হয়। ককটেলের শব্দে সবাই দৌড়ে পালাতে শুরু করেন। এই সময় মুরগি মিলন তার গাড়ির দিকে দৌড়াতে থাকেন। খুনিরা তাকে ফাঁকা পেয়ে যায়। একসঙ্গে ৭ /৮টি রিভলবার থেকে গুলি ছোড়া হয়। ১৪টি গুলি তাঁর গায়ে লাগে। তিনি মাটিয়ে লুটিয়ে পড়েন। অস্ত্রধারীরা রাজার দেউড়ির দিকে পালিয়ে যায়। আহত হয়ে অনেকক্ষণ মাটিতে পড়ে থাকলেও কেউ তাকে উদ্ধারে এগিয়ে আসেনি। পরে এক ভাসমান দোকানি এসে টেনে তোলেন।
আদালতের বারান্দা থেকে অনেকের সঙ্গে সেদিন এই হামলার দৃশ্য দেখেছিলেন কারাগারে থাকা আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী। একটি মামলার হাজিরা দিতে তাকে আদালতে আনা হয়েছিল। বন্ধু লিটন হায়দারের কাছে তিনি সেই ঘটনার পুরো বিবরণ দিয়েছিলেন।
ডিবির একজন কর্মকর্তা আমাকে বলেছিলেন, এই খুনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন টোকাই সাগর। গাড়িতে বসে মোবাইল ফোনে তিনি সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছিলেন। আর কিলিং মিশনে সরাসরি মাঠে ছিলেন কালা জাহাঙ্গীর, সুব্রত বাইন, বিহারি মুন্না, কচি, ওসমান, আখতার, সায়েদাবাদের মুন্নাসহ ৩০-৩৫ জন। তাদের হাতে ছিল ২০টির বেশি অস্ত্র। ঢাকায় এর আগে কোন সন্ত্রাসী হত্যাকাণ্ডে এত অস্ত্রের ব্যবহার হয়নি।
মুরগি মিলনের লাশ ঢাকা মেডিকেলের মর্গে আনার পর আওরঙ্গ ও লিয়াকতের শত শত অনুসারী ছুটে আসেন। মিলনের স্ত্রী টোকাই সাগরকে প্রধান আসামি করে মামলা করেন। কিন্তু পুলিশ তাকে ধরতে পারেনি। একদিন সপরিবারে আমেরিকায় পাড়ি জমান টোকাই সাগর। এখন তিনি সেখানেই আছেন। মুরগি মিলনের পরিবার অবশ্য ঢাকাতেই ছিলেন। মৃত্যুর সময় তিনি বিপুল সম্পদ ও ব্যবসা-বাণিজ্য রেখে গেলেও কোন উত্তরাধিকার রেখে যেতে পারেননি। তিনি ছিলেন নিঃসন্তান।
১৯৯৫ থেকে ২০০০ পর্যন্ত সময়ে ঢাকায় সবচেয়ে বেশি গোলাগুলি হতো কোতোয়ালি-সূত্রাপুর এলাকায়। কোতোয়ালির ওসি মুজিবুল হক প্রায়ই বলতেন, সন্ত্রাসীদের চুল পাকে না। তার আগেই তারা ঝরে যায়। সেভাবেই ঝরে গেলেন আন্ডারওয়ার্ল্ডের ভয়ংকর সন্ত্রাসী মুরগি মিলন। নিহত হওয়ার সময় তার বয়স হয়েছিল ৪৭ বছর।
লেখক: সিটি এডিটর, দৈনিক প্রথম আলো