সবুজ প্রবৃদ্ধি, অর্গানিক কৃষি ও নিরাপদ খাদ্য


ড. আতিউর রহমান : গত ৭ মার্চ ২০১৯ তারিখে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে বাংলাদেশ অর্গানিক প্রোডাক্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোগে আয়োজিত আলোচনা অনুষ্ঠানে প্রধান বক্তা ছিলাম। সবুজ প্রবৃদ্ধির অংশ হিসেবে অর্গানিক কৃষি ও নিরাপদ খাদ্য বিষয়ে দীর্ঘক্ষণ কথা বলেছিলাম।

আন্তর্জাতিক অর্থনীতিবিদ, উন্নয়ন পর্যবেক্ষক, নীতিনির্ধারক মহলসহ সবাই মেনে নিয়েছেন, বাংলাদেশের উন্নয়ন অভিযাত্রাটি আসলেই অভাবনীয়। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই বঙ্গবন্ধু অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের যে ধারা সূচনা করেছিলেন, পরে বহু প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে সেই ধারাবাহিকতা ধরে রাখা গেছে। এর ফলে বাংলাদেশ প্রকৃত অর্থেই ধ্বংসস্তূপ থেকে সম্ভাবনার দেশে পরিণত হয়েছে। বিশ্বের সামনে টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে উপস্থিত হয়েছে। স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে বেরিয়ে এসে উন্নয়নশীল দেশ হয়েছে এবং উন্নত দেশ হওয়ার স্বপ্ন দেখতে পারছে। আমাদের অগ্রগতি ম্যাক্রো-অর্থনৈতিক সূচকগুলোর পাশাপাশি সামাজিক/মানবিক উন্নয়ন সূচকগুলোতেও প্রতিফলিত হয়েছে ও হচ্ছে। সমআয়ের দেশগুলোর তুলনায় বহু ক্ষেত্রেই আমরা উল্লেখযোগ্য মাত্রায় এগিয়ে রয়েছি। এখন দুই অঙ্কের প্রবৃদ্ধি অর্জন এবং ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত দেশ গঠনের মতো বড় বড় লক্ষ্য অর্জনের কৌশল নির্ধারণ করে তা বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছি।

উন্নয়ন অভিযাত্রায় কৃষি খাতের অর্জন ও ভূমিকা :স্বাধীনতাপরবর্তী কালে আমাদের জনশক্তির ৮০ শতাংশই জীবিকার জন্য কৃষির ওপর নির্ভরশীল ছিল। অর্থনীতির বিকাশের স্বাভাবিক ধারাতে এ অনুপাত কমে এলেও এখনও ৪০ শতাংশ মানুষ কৃষি খাত থেকে জীবিকা নির্বাহ করে (সরসারি না হলেও কোনোভাবে সংযুক্ততা ধরলে এ অনুপাত ৬০ শতাংশের কাছাকাছি)। ফলে দারিদ্র্য হ্রাসে যে চমৎকার সাফল্য আমরা দেখিয়েছি (বিশেষত গত এক দশকে দারিদ্র্য প্রায় অর্ধেক কমিয়ে ২৩ শতাংশে নামিয়ে আনা গেছে), তাতে কৃষিতে কর্মসংস্থানের যে বিশেষ ভূমিকা রয়েছে, তা নির্দি্বধায় বলা যায়। এ খাতে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে; বেড়েছে দৈনিক মজুরিও।

এ খাতে সংযুক্ত মানুষের অনুপাত যেমন কমেছে, তেমনি কমেছে জিডিপিতে কৃষি খাতের অনুপাত। ১৯৯০-এর দশকে জিডিপির ৪০ শতাংশ আসত কৃষি খাত থেকে। আর এখন এ অনুপাত ১৫ শতাংশের কাছাকাছি। তবে কত মানুষ কৃষির ওপর আয়ের জন্য নির্ভরশীল কিংবা জিডিপিতে এ খাতের অবদান দিয়ে কৃষিতে আমাদের অগ্রগতির চিত্রটি পরিস্কারভাবে ফুটে ওঠে না। আমরা যদি উৎপাদিত খাদ্যশস্যের পরিমাণের দিকে লক্ষ্য করি, তবেই বোঝা যাবে কী বিশাল সাফল্য এখানে এসেছে! স্বাধীনতার পরপর আমরা মাত্র ১০ মিলিয়ন টন খাদ্যশস্য উৎপাদন করতাম। আর এখন তা প্রায় চার গুণ- ৩৮ মিলিয়ন টনে পৌঁছেছে। বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ না ঘটলে প্রধান খাদ্যশস্য চাল আমাদের আর আমদানি করতে হয় না। আলু উৎপন্ন হচ্ছে চাহিদার তুলনায় অনেক। সবজি, মাছ, মাংস বা ডিমও আমদানি করতে হচ্ছে না। মোট কথা, আমাদের কৃষি খাতের বিকাশ একদিকে ১৬ কোটি মানুষের আহার জোগাচ্ছে, অন্যদিকে দারিদ্র্য নিরসনেও ভূমিকা রাখছে। সত্যি কথা হলো, দারিদ্র্য বিমোচনে অকৃষি খাতের প্রবৃদ্ধির তুলনায় কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি বেশি কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, কৃষি খাতের জিডিপি ১ শতাংশ বাড়লে তার ফলে দারিদ্র্র্য হ্রাস হয় ০ দশমিক ৩৯ শতাংশ, এবং এ অনুপাত অকৃষি খাতের তুলনায় প্রায় তিন গুণ। কাজেই আমরা নির্দি্বধায় বলতে পারি, অতীতের মতো আগামীতেও আমাদের কৃষি খাত জাতীয় ম্যাক্রো-অর্থনৈতিক লক্ষ্যগুলো অর্জনে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ :কৃষিতে আমাদের অর্জন প্রশংসনীয়- এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। তবে এতে আত্মতুষ্টির সুযোগ নেই। কারণ আমাদের সামনে রয়েছে নতুন নতুন বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জ। একদিকে আমাদের জনসংখ্যা বাড়ছে (অতীতের তুলনায় অনেক কম হারে হলেও), অন্যদিকে কৃষি জমির পরিমাণ কমে আসছে নগরায়ন ও শিল্পায়নের কারণে। অর্থাৎ খাদ্যশস্যের চাহিদা বাড়বে, কিন্তু জমির পরিমাণ আগের তুলনায় কমবে। মনে রাখতে হবে, বর্তমানে চাষযোগ্য জমির ৯৫ শতাংশই চাষাবাদ করা হচ্ছে। কাজেই উৎপাদন বাড়াতে হলে সমপরিমাণ জমিতে আগের তুলনায় বেশি পরিমাণ ফসল উৎপাদনের বিকল্প আমাদের সামনে নেই। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পূরণে প্রতি একর জমিতে আমাদের আগের তুলনায় দ্বিগুণ পরিমাণ ফসল উৎপাদন করতে হবে। অন্যদিকে শিল্পায়ন-নগরায়নের ফলে প্রতি বছর কৃষি জমি কমে আসছে ০ দশমিক ৭৫ শতাংশ হারে। রফতানি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি হতে হবে ৪ থেকে ৪ দশমিক ৫ শতাংশ। অথচ জনসংখ্যার বড় অংশটি তরুণ হলেও, তারা কৃষিতে যুক্ত হতে অতটা আগ্রহ দেখাচ্ছে না (কৃষিতে যুক্ত ব্যক্তিদের গড় বয়স এখন ৪৪ বছর)। আর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এসব চ্যালেঞ্জে যুক্ত হচ্ছে নতুন মাত্রা।

এ থেকে সহজেই বোঝা যাচ্ছে, কৃষি খাতের টেকসই বিকাশ নিশ্চিত করতে আমাদের উদ্ভাবনমূলক কৌশল নির্ধারণ ও তার কার্যকর বাস্তবায়নের বিকল্প নেই। ষষ্ঠ ও সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, রূপকল্প ২০২১ এবং ডেল্টা প্ল্যানে সরকার এদিকে বিশেষ মনযোগ দিয়েছে। তবে শুধু সরকারের উদ্যোগে এ ক্ষেত্রে সাফল্য আশা করা ঠিক হবে না। এগিয়ে আসতে হবে ব্যক্তি খাতকেও। পাশাপাশি আমাদের গবেষক-বিজ্ঞানী, তরুণ উদ্যোক্তাদেরও কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। কৃষির দীর্ঘমেয়াদি টেকসই বিকাশ ও কৃষকস্বার্থ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের একটি উক্তি এ ক্ষেত্রে খুবই প্রাসঙ্গিক। তিনি বলেছেন :’আজ শুধু একলা চাষির চাষ করিবার দিন নাই, আজ তাহার সঙ্গে বিদ্বানকে, বৈজ্ঞানিককে যোগ দিতে হইবে।’ আসলেই কৃষির টেকসই বিকাশের মাধ্যমে জাতীয় ম্যাক্রো-অর্থনৈতিক লক্ষ্যগুলো অর্জনের যাত্রা অব্যাহত রাখতে সমন্বিত উদ্যোগের বিকল্প নেই।

খাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়া হতে হবে নিরাপদ :’সবুজ বিপ্লব’উত্তর সময়ে বিগত কয়েক দশকে বর্ধিষ্ণু জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা মেটাতে আমরা ব্যাপক মাত্রায় নির্ভর করেছি রাসায়নিক সার-কীটনাশকের ওপর। ওই সময় হয়তো এই নির্ভরশীলতার খুব বেশি বিকল্পও আমাদের সামনে ছিল না। কিন্তু রাসায়নিকের নিয়ন্ত্রণহীন ব্যবহারে দীর্ঘমেয়াদে পরিবেশের ক্ষতি করেছে (মাটি ও পানিদূষণ), কৃষকের ক্ষতি হয়েছে, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ভোক্তারাও। অনেক সময় বাজার ব্যবস্থার বাস্তবতার কারণেও ক্ষতিকর রাসায়নিক ব্যবহূত হচ্ছে অযাচিতভাবে। যেমন মানসম্পন্ন নিরাপদ শুঁটকি প্রস্তুত করতে দীর্ঘদিন এগুলো শুকানোর দরকার হয়। কিন্তু এত দীর্ঘ সময় ব্যয় করলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। এমনকি অনেক সময় উৎপাদন খরচ উঠিয়ে আনতেও শঙ্কা তৈরি হয় বলে শুঁটকি উৎপাদকরা এতটা দিন সময় ব্যয় করতে চায় না। এদিকে ঠিকমতো না শুকানো হলে শুঁটকিতে পোকা ধরতে পারে। তাই বাধ্য হয়ে অনেক উৎপাদক শুঁটকিতে ক্ষতিকারক ডিডিটি রাসায়নিক প্রয়োগ করে থাকে। একই কথা সত্য বিভিন্ন শাক-সবজিতে ফরমালিনের অপপ্রয়োগ প্রসঙ্গেও।

সম্প্রতি পত্রপত্রিকায় আমাদের নিত্যদিনের খাদ্যে আশঙ্কাজনক মাত্রায় বিভিন্ন রাসায়নিকের উপস্থিতির খবর উঠে এসেছে। পোকা দমনে ফসলের ক্ষেতে যে বিষ দেওয়া হচ্ছে, তা মাটি, পানি হয়ে চালে চলে আসছে। গরুর দুধেও পাওয়া যাচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক (৯ শতাংশে গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে বেশি টেট্রাসাইক্লিন পাওয়া গেছে, ১৫ শতাংশে পাওয়া গেছে সিসা)। গরু যে ঘাস বা অন্য খাবার খাচ্ছে, সেগুলোতে থাকা রাসায়নিকের প্রভাবেই দূষিত হচ্ছে গরুর দুধ। দেশে রাসায়নিকনির্ভর কৃষির কারণে কী পরিমাণ দূষণ হচ্ছে, কী ধরনের ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে, তা নিয়ে বিস্তারিত গবেষণার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করছে সংশ্নিষ্ট কর্তৃপক্ষ। আমাদের নিজেদের ওই ধরনের ব্যাপকভিত্তিক গবেষণা না থাকলেও উন্নত বিশ্বে আজ রাসায়নিকনির্ভর কৃষির ঝুঁকির দিকগুলো সর্বজনস্বীকৃত।

আমাদের খাদ্য উৎপাদন বাড়ানো বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু রাসায়নিক প্রয়োগের ফলে যে ঝুঁকিগুলো তৈরি হচ্ছে, তা কমানো এবং সম্ভব হলে পুরোপুরি এড়াতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাতে হবে। প্রয়োজনবোধে চাষাবাদের ধরনে পরিবর্তন আনতে হবে। এ জন্য গবেষণা, অর্থায়ন, নীতি সহায়তা, জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। সর্বোপরি মনিটরিং জোরদার করতে হবে।

প্রাকৃতিক কৃষি :প্রাকৃতিক কৃষির ক্ষেত্রে কৃত্রিম সার কিংবা কীটনাশকের ওপর নির্ভর করা হয় না। ফলে মাটি বা পরিবেশের ক্ষতি হয় না। বরং জৈব উপাদানের পরিমিত প্রয়োগ এবং ‘ক্রপ রোটেশন’-এর মতো কৌশল ব্যবহারের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি বা সংরক্ষণ নিশ্চিত করা হয়। এতে কৃত্রিম উপাদানের প্রয়োগ হয় না বলে সার-কীটনাশকে খরচও কম হয়। তাই সারা বিশ্বেই এখন প্রাকৃতিক কৃষি বা অর্গানিক ফার্মিং নিয়ে আগ্রহ তৈরি হয়েছে। এর প্রসারও ঘটছে দ্রুত।

ওই মাত্রায় না হলেও আমাদের দেশেও প্রাকৃতিক কৃষি নিয়ে কৃষক ও ভোক্তাদের মধ্যে আগ্রহ তৈরি হয়েছে। অনেক উদ্যোক্তা প্রাকৃতিক কৃষি নিয়ে স্বপ্ন দেখছেন। সচেতন ক্রেতাদের কাছ থেকে সাড়াও মিলছে। প্রাকৃতিক কৃষি অনুশীলন করতে খুব বেশি টেকনিক্যাল জ্ঞান কিংবা অর্থের দরকার হয় না বলে আমাদের কৃষকদের কাছেও এর গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। কৃষকদের মধ্যে প্রাকৃতিক কৃষির গ্রহণযোগ্যতা প্রসঙ্গে আমার একটি অভিজ্ঞতা তুলে ধরতে পারি। ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার মর্জিনা বেগম একজন ক্ষুুদ্র নারী উদ্যোক্তা, যিনি জৈব সার উৎপাদন ও বাজারজাতকরণে আগ্রহী। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করার সময় আমি এ খবর পাই এবং তার উদ্যোগে অর্থায়নের ব্যবস্থা করি। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই মর্জিনা জৈব সার উৎপাদন ও কৃষকদের কাছে তা বিক্রি করে সাফল্যের মুখ দেখেন। তার কাছ থেকেই জেনেছি, জৈব সার প্রয়োগের পর এর সুফল পেয়ে কৃষকরা খুবই সন্তুষ্ট। তারা আর রাসায়নিক সার বা কীটনাশক প্রয়োগে আগ্রহী নয়। মর্জিনা নিজেই কৃষকদের জৈব সার উৎপাদন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। তার এলাকায় এখন প্রায় কোনো কৃষকই রাসায়নিক সার ব্যবহার করেন না। জৈব সার ব্যবহার বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখায় মর্জিনা জাতীয় পুরস্কারও পেয়েছেন। এখন তার মতো আরও নারী উদ্যোক্তাকে জৈব সার উৎপাদন ও বাজারজাতকরণে উদ্বুদ্ধ করে চলেছেন। কয়েকশো নারী উদ্যোক্তা ইতিমধ্যে কাজও শুরু করেছেন।

মর্জিনার গল্প থেকেই বুঝতে পারি, আমাদের দেশে প্রাকৃতিক কৃষির গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। এমন আরও অনেক সাফল্যের গল্প রয়েছে, তা নিশ্চিত করেই বলতে পারি। এই গ্রহণযোগ্যতাকে পুঁজি করে আমরা প্রাকৃতিক কৃষির প্রসারে জাতীয় আন্দোলন গড়ে তুলতে পারি, যেখানে সরকারি ও ব্যক্তি খাত যুগপৎ কাজ করে আমাদের জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করবে।

তবে প্রাকৃতিক কৃষির প্রসারের ক্ষেত্রেও যথেষ্ট সতর্ক থাকা জরুরি। মনে রাখতে হবে, বিপুল জনগোষ্ঠীর খাদ্য চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি রফতানি আয়ের জন্যও আমরা কৃষি খাতের ওপর নির্ভরশীল। এ পরিস্থিতিতে আমরা রাতারাতি রাসায়নিকনির্ভর কৃষি ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে পারব- এমন আশা করা ঠিক হবে না। তা ছাড়া প্রাকৃতিক কৃষির ক্ষেত্রেও নানা ঝুঁকি রয়েছে। যেমন মোট উৎপাদিত ফসলের পরিমাণ কমে যাওয়া, পদ্ধতির যথাযথ প্রয়োগ না হওয়ায় ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ইত্যাদি। আমরা প্রাকৃতিক কৃষির বিকাশ চাই, তবে সেই বিকাশ হতে হবে টেকসই ও নিরাপদ।

প্রাকৃতিক কৃষির বিকাশে আর্থিক সেবা খাত :যে কোনো খাতের বিকাশেই অর্থায়ন খুব গুরুত্বপূর্ণ। মনে রাখতে হবে, একটি নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে সবকিছু সরকারি উদ্যোগ বা সরকারি অর্থায়নে করা সম্ভব নয় স্বাভাবিকভাবেই। এ কারণে প্রাকৃতিক কৃষির বিকাশে দেশের আর্থিক খাতের বিশেষ ভূমিকা রাখতে হবে। আমাদের সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতাও তাই বলে। কৃষি খাতের বিকাশে ব্যাংকের দেওয়া মোট ঋণের একটি অংশ কৃষিঋণ হিসেবে দেওয়ার বাধ্যবাধকতা তৈরি, বর্গাচাষিদের জন্য বিশেষ ঋণ কর্মসূচি চালু, কৃষকদের জন্য ১০ টাকার ব্যাংক একাউন্ট চালু করার মতো বিভিন্ন নীতি-উদ্যোগ নিয়ে আমরা কৃষির বিকাশে দেশের আর্থিক সেবা খাতকে (ব্যাংক ও নন-ব্যাংক) যুক্ত করার সফলতা দেখিয়েছি। কৃষির যান্ত্রিকীকরণেও ব্যাংকিং খাতকে কার্যকরভাবে যুক্ত করার যে চেষ্টা শুরু করেছিলাম, তা এখনও অব্যাহত আছে। এগুলোর ধারাবাহিকতাতেই প্রাকৃতিক কৃষির বিকাশে আর্থিক সেবা খাতকে যুক্ত করা যেতে পারে। এ জন্য কী ধরনের কর্মসূচি নেওয়া যায়, তা নিয়ে বিস্তারিত ভাবা দরকার হলেও কিছু সম্ভাব্য উদ্যোগ এখানে আলোচনা করতে পারি-

কম সুদে (৪ থেকে ৫ শতাংশ) প্রাকৃতিক কৃষিঋণের পুনঃঅর্থায়ন স্কিম চালু করা যেতে পারে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ নীতিতে মোট প্রদত্ত ঋণের ১০ শতাংশ মাছ চাষে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। একই রকম নির্দেশনা প্রাকৃতিক কৃষির জন্যও নেওয়া যেতে পারে।

প্রাকৃতিক কৃষির বিকাশে আইসিটি রাখতে পারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা : আগেই বলেছি, প্রাকৃতিক কৃষিপণ্য বাজারজাতকরণে আইসিটিভিত্তিক সল্যুশনগুলো খুবই কার্যকর হতে পারে। তবে শুধু বাজারজাতকরণই নয়, পুরো প্রাকৃতিক কৃষির বিকাশেই আইসিটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। একদিকে কৃষকদের মধ্যে প্রাকৃতিক কৃষি বিষয়ে আগ্রহ তৈরি করতে আইসিটি প্রয়োগ করা যেতে পারে, অন্যদিকে প্রাকৃতিক কৃষি পদ্ধতিগুলোর কার্যকর প্রয়োগ শেখানোর জন্য ভিডিও বা ইন্টারঅ্যাকটিভ টিউটোরিয়ালও অনলাইনে ছড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে। অল্প সংখ্যক বিশেষজ্ঞ নিয়ে ইউটিউব বা ফেসবুকের মতো কোনো একটি জনপ্রিয় প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করেই এটা করা যেতে পারে। শুধু উৎপাদকরাই নন, যারা প্রাকৃতিক কৃষিপণ্যের ভোক্তা হবেন, তাদের মধ্যেও এ বিষয়ে সচেতনতা তৈরিতে ভূমিকা রাখতে পারে আইসিটি।

dratiur@gmail.com

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গর্ভনর

আরও পড়ুন...