সময় ব্যবস্থাপনার কয়েকটি কৌশল

সময়-ব্যবস্থাপনা
ছাত্রজীবনের সবচেয়ে বড় সমস্যা হল সময়ের ব্যাপারে অসচেতনতা।

মুহাম্মদ আবুল হুসাইন:

ছাত্রজীবনের সবচেয়ে বড় সমস্যা হল সময়ের ব্যাপারে অসচেতনতা। আর এই সমস্যাটা সবচেয়ে বেশি হয় স্কুলের ছেলেমেয়েদের, বিশেষ করে অষ্টম থেকে দশম শ্রেণীর ছেলেমেয়েদের। কারণ, এই সময়ে আকস্মিক হরমোনের পরিবর্তনের কারণে তাদের মানসিক আবেগের তীব্রতা খুব বেশি থাকে এবং কম থাকে বাস্তবতাবোধ।সারাক্ষণ ফুরফুরে মেজাজে থাকে; কিন্তু সবকিছুকে হাল্কাভাবে দেখে, অনেকটা গা ছাড়া ভাব আর কল্পনার জগতে থাকতে বেশি ভালোবাসে।যার কারণে এই বয়সের ছেলেমেয়েরা শুধু যে পড়াশোনার ব্যাপারে অমনোযোগী থাতে তাই নয়, নিজেদের স্বাস্থের যত্নের ব্যাপারেও যথোচিত মনোযোগ দিতে চায় না।বন্ধু-বান্ধব আর ফেসবুক নিয়ে পড়ে থাকে এবং অহেতুক সময় নষ্ট করতে বেশি ভালোবাসে। এসব কারণে এই টিনেজ ছেলেমেয়েরা বেঘোরে সময় নষ্ট করে।অথচ এই সময়ে তাদের সামনে থাকে এসএসসি/দাখিল পরীক্ষার মত গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা।এটিকে বলা যায় তাদের জীবনের জন্য প্রথম ভাগ্যনির্ধারণি পরীক্ষা।এই পরীক্ষার ফলাফলের উপরই তাদের পুরো শিক্ষাজীবনের ভবিষ্যত নির্ভর করে। এ কারণে এই সময়ে তাদের জন্য সময় ব্যবস্থাপনা খুবই জরুরী। কেবলমাত্র যথাযথ সময় ব্যবস্থাপনাই পারে তাদেরকে পড়াশোনায় মনোযোগী হতে এবং ফেসবুজ আসক্তি ও আড্ডাবাজি থেকে রক্ষা করতে।

এখানে সময় ব্যবস্থাপনার কয়েকটি কৌশল নিয়ে আলোচনা করা হলো:

১. হতাশা-অস্থিরতা দূর করা

মন থেকে সব ধরনের হতাশা, আক্ষেপ, ক্ষোভ, বিষণ্নতা এবং অস্থিরতাকে একেবারে ধুয়ে-মুছে বিদায় করে দাও।কারণ এগুলো তোমার মনোযোগ নষ্ট করে এবং পড়াশোনা, অধ্যয়ন, ক্যারিয়ার গঠন তথা আত্মগঠনের কাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে, গড়িমসি করা-আলস্যকে প্রশ্রয় দেয়। যখন তুমি পড়াশোনা করছ বা লিখছ, তখন তোমার ফোনের রিংটোন এবং ভাইব্রেশন বন্ধ করে দাও এবং এটিকে এমন একটি ড্রয়ারের মধ্যে রাখ, যেখানে কল এবং ম্যাসেজের উত্তর দিতে তুমি প্রলুব্ধ হবে না। বড়জোর প্রতি ঘন্টায় একবার তোমার ফোন চেক করতে পার। ফেসবুক, মেসেঞ্জার, ইউটিউব এবং অন্যান্য ব্যাঘাত সৃষ্টিকারী গুলোকে বন্ধ করে দাও। যখন তুমি রিলাক্সে থাক, শুধুমাত্র তখন এগুলো একটু দেখতে পার।একটা কথা আছে না, ‘কাজের মধ্যে ডুবে থাকা’? আসলে এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।এর মাধ্যমেই কাজেই আনন্দ পাওয়া যায়। ইংরেজিতে একে বলে ঋষড়, বাংলায় একে বলা যায় সাবলীলতা। মূলত, এটি কাজে প্রচ- প্রাণশক্তি প্রদান করে, কাজের মধ্যে ডুবে থাকতে সাহায্য করে। কাজের মধ্যে যদি আনন্দ বা প্রাণশক্তি না থাকে, তাহলে সেই কাজে কখনো দক্ষতা অর্জন করা যায় না।

২. অগ্রাধিকার নির্ধারণ

অনেক ছেলেকে দেখি, ঘন্টার পর ঘন্টা ফেইসবুকে আড্ডা দিয়ে কাটায়।আবার, ফেসবুকের কারণে বন্ধু-বান্ধবের পরিধিও অনেক বেড়ে যাওয়ায় মোবাইলে কথা বলেও অনেক সময় নষ্ট করে।অনেকের তো এখন এগুলোতে রীতিমত আসক্ত হয়ে পড়েছে।তারা সারাদিন ফেসবুক-মোবাইল-আড্ডায় যত সময় ব্যয় করে পড়াশোনাতেও এত সময় ব্যয় করে না।তাই তোমাকে ঠিক করতে হবে, কোনটা তোমার জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ, নিজের ক্যারিয়ার, নাকি বন্ধু-বান্ধব।ফেসবুকে আসক্ত ছেলে-মেয়েরা সারাদিন যত সময় ফেইসবুক আর মোবাইলে কথা বলে কাটায়, কোন বড় ব্যবসায়ী বা ডিজিটাল মার্কেটাররাও এত সময় ব্যয় করে না।সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হল, এখন স্কুলের ছেলেদের মধ্যে বিভিন্ন গ্রুপ ভিত্তিক পেইজ দেখা যায়, যেগুলোকে কেন্দ্র করে তাদেরকে দলাদলিতে লিপ্ত হতে দেখা যায়।উঠতি বয়সের এসব ছেলেরা এসব গ্রুপের পাল্লায় পড়ে নিজেদের ক্যারিয়ার ধ্বংস করছে।কারণ, তারা পড়াশোনার পরিবর্তে সারাদিন এসব দলাদলি নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকে।এসব ছেলেরা একবারও কি ভেবে দ্যাখে- তারা কেন এসব মরীচিকার পেছনে ছুটে চলছে?তারা কি ভেবে দ্যাখে, তার ক্যারিয়ারের কী অবস্থা? লক্ষ্য পূরণের জন্য তার দিনে কত ঘন্টা পড়াশোনা করা প্রয়োজন আর একজন ছাত্রের সারাদিন সর্বোচ্চ কত ঘন্টা মোবাইলে কথা বলা বা ফেইসবুকে ব্যয় করা উচিত?হাতের কাজ ফেলে রেখে কোন পাগলে গল্প করে আড্ডা দিয়ে বেড়ায়?

৩. ক্যালেন্ডার এবং রুটিন ব্যবহার

বছরের শুরুতে সবার আগে তোমার সিলেবাস বা বাৎসরিক কোর্স-আউটলাইনটা সামনে নিয়ে বসো।তারপর ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে দেখ তুমি আসলে কতদিন স্টাডি ডে পাচ্ছো।এটা বের করার জন্য তোমাকে দেখতে হবে সারা বছরে মোট কতদিন বিদ্যালয় বন্ধ বা ছুটি থাকবে।এই ছুটির দিনগুলো বাদ দিলে যে কদিন হাতে থাকবে তাই আসলে স্টাডি ডে।কারণ ছুটির দিনগুলোতে আসলে পড়াশোনা হয় না।বিশেষ করে স্কুলের স্টুডেন্টরা তো একটা অজুহাত পেলেই আর পড়াশোনা করতে চায় না, আর ছুটির দিনগুলোতে তো নয়ই।দেখা গেছে, সারা বছরে সাপ্তাহিক ছুটি, উৎসব, পার্বন নানা কিছু মিলে আমাদের দেশে নব্বই দিনেরও বেশি সময় ছুটি বাবদ চলে যায়।এই সময়টায় বিশেষ করে ছেলেরা হৈ হৈ রৈ রৈ করে পার করে দেয়।কাজেই ছুটির দিন বাদ দিলে বাকি যে সময়গুলো থাকে তার মধ্যেই তোমার সিলেবাস বা কোর্স আউট লাইনের পড়া শেষ করতে হবে।আর রেজাল্ট যদি ভাল করতে চাও, তাহলে এই সময়েরও অন্ততঃ এক তৃতীয়াংস সময় আগে সিলেবাসের পড়া শেষ করতে হবে, আর বাকি সময়টাতে রিভাজ এবং প্রস্তুতিমূলক পরীক্ষা দিতে হবে।আর এটা করতে হলে তোমাকে আসলে ছয় মাসের মধ্যেই পুরো সিলেবাসের পড়া শেষ করার টার্গেট নিয়ে সেই অনুযায়ী প্রতিটা সাবজেক্টের জন্য ডেইলি রুটিন তৈরি করতে হবে।তোমাকে বের করতে হবে ছয় মাসের মধ্যে সিলেবাস শেষ করতে হলে প্রতিদিন কোন সাবজেক্টটি কত সময় করে পড়তে হবে।এইভাবে পুরো বছরের পড়াশোনার ছক যদি তুমি বছরের শুরুতেই করে ফেলতে পারো, তাহলে তোমার সময়গুলো অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে ব্যয় হবে এবং কোন সময় নষ্ট হবে না।ফলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই তুমি তোমার সিলেবাস শেষ করতে পারলে তুমি অনেক হাল্কা বোধ করতে পারবে এবং বাকি সময়টাতে তুমি অত্যন্ত স্বাচ্ছন্দের সাথে রিভাইজ দিতে পারবে বা বিভিন্ন টেস্ট পরীক্ষার মাধ্যমে নিজেকে ঝালাই করে নিতে পারবে।এজন্য অত্যন্ত সিরিয়াসলি তোমাকে অবশ্যই ডেইলি রুটিন অনুযায়ী পড়াশোনা করতে হবে এবং কোন মিস দেয়া যাবে না।যদি হঠাৎ কোন দিন মিস হয়েই যায়, তাহলে বন্ধের দিন সেটি পূরণ করে নিতে হবে।

৪. মাসিক পাঠ-পরিকল্পনা এবং চেকলিস্ট ব্যবহার

এইভাবে ডেইলি রুটিন অনুযায়ী পড়াশোনার পাশাপাশি প্রতি মাসের শুরুতে তুমি একটি পাঠ পরিকল্পনা তৈরি করতে পারো এবং মাস শেষে পাঠ-পর্যালোচনা করে দেখতে পারো যে, তোমার মাসিক পাঠ পরিকল্পনা বা এসাইনমেন্টগুলো কতটুকু সম্পন্ন করতে পেরেছো।যদি না হয়ে থাকে তাহলে নতুন মাসে ঘাটতি পুষিয়ে নিতে পারো।এজন্য তুমি একটি চেকলিস্ট ব্যবহার করতে পারো।

চেকলিস্ট হল একটি to do list।তুমি তোমার কাজের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে what to do লিস্ট বা তালিকা তৈরি করতে পার।এটি প্রতিদিনের জন্য হতে পারে; অথবা এক সপ্তাহ বা এক মাসের জন্যও হতে পারে। তবে সবচেয়ে ভাল হয় প্রতি মাসের জন্য করলে।তাহলে পুরো মাসের কাজের ছক তোমার মাথার মধ্যে থাকবে। এটি কাজের প্রতি তোমার মনোযোগ নিশ্চিত করার একটি দুর্দান্ত উপায়।প্রতিদিন সকালে এই তালিকা চেক করতে হবে এবং তালিকা ধরে ধরে একটি একটি করে কাজ শেষ করতে হবে।যে কাজটি সম্পাদন করা হবে, সেটির পাশে টিক চিহ্ন দিতে হবে।তাহলে কয়টি ও কি কি কাজ শেষ হল সে সম্পর্কে একটি ধারণাও তুমি পেয়ে যাবে।

৫.নির্দিষ্ট কাজের জন্য নির্দিষ্ট সময়সীমা তৈরি বা সময় বন্টন

টুডু লিস্টের কাজ গুলোর জন্য সময়সীমা নির্ধারণ কর এবং তাতে স্থির থাকার চেষ্টা কর।অর্থাৎ, কোন কাজের জন্য কতটুকু সময় ব্যয় করবা তার সময়সীমা নির্ধারণ করা বা সময় বন্টন করা। এটি করতে পারলে সময় নষ্ট হবে না এবং অল্প সময়ে বেশি কাজ করা যাবে।
পিবিএ/এএইচ

আরও পড়ুন...